২০১৬ সালে হলি আর্টিসান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়লে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো গা ঢাকা দেয়। তার ঠিক তিন বছর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পুলিশ বক্সে হামলা ও হামলাচেষ্টায় ‘ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ ব্যবহার করে নতুনভাবে আলোচনায় আসে জঙ্গিরা।
এসব হামলার সঙ্গে জড়িত নব্য জেএমবির সদস্যদের কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। কিন্তু তারপরও বোমা তৈরি বন্ধ করা যায়নি। সর্বশেষ গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়।
সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে বোমা উদ্ধার করার এ ঘটনায় অভিযুক্ত জেএমবির সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলারকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। গত রোববার (১১ জুলাই) সাইনবোর্ডে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা রাখার অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া কেরানীগঞ্জ থেকে জেএমবির আরেক সদস্য- কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামাকে গ্রেফতার করা হয় ১১ জুলাই রাতে।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার হওয়া এই দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে বোমা তৈরির এক কারিগর হিসেবে জাহিদ হাসানের নাম পাওয়া যায়। হলি আর্টিসান হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার এক জঙ্গির থেকেও এই জাহিদ হাসানের বিষয়ে প্রথম তথ্য পেয়েছিল সিটিটিসি।
তদন্ত করে জানা যায়, জাহিদ হাসান ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক পাস করেছিলেন। ওই বছরই অনলাইন দাওয়াতের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ২০১৪ সালে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পেয়েছে সিটিটিসি। বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি হিসেবে জাহিদ হাসান পলাতক রয়েছেন।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি- “শরিফুল ইসলাম”কে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। হলি আর্টিসান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই শরিফুল ইসলাম। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায় যে, জেএমবির বোমা তৈরির মূলে আছেন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র। আর তিনিই নব্য জেএমবির সদস্যদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন। তবে শরিফুলের কাছ থেকে জাহিদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় নি।
যেভাবে শনাক্ত হলেন জঙ্গি জাহিদ
সিটিটিসির একটি সূত্র জানায়- পুলিশ বক্সে বোমা হামলাগুলোর ঘটনার তদন্তে বুঝা যায় যে বোমাগুলো একই ধরনের এবং সেগুলো দেশীয়ভাবে তৈরি। অর্থাৎ বোমাগুলো নির্দিষ্ট একজনের ফর্মুলায় তৈরি। অন্যদিকে এসব হামলায় জড়িতরা গ্রেফতার হলেও বোমা তৈরি অব্যাহত ছিল।
পুলিশ বক্সে হামলাগুলোর তদন্তে সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এই বোমার কারিগর জেএমবির একজন পুরোনো সদস্য। এরপর গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি ওসামা এবং আব্দুলাহ আল মামুনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জাহিদ হাসানকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
জঙ্গি জাহিদের বিষয়ে ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান- এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানান যে, দেশে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ তৈরির প্রমাণ পাওয়ার পর থেকেই ধারণা ছিল যে এর সাথে রসায়ন পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী জড়িত। তখন থেকেই জাহিদকে খুঁজে যাচ্ছিলেন তারা। নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জাহিদের বিষয়ে তথ্যগুলো পাওয়া যায়।
অনলাইনে বোমা বানানো শেখান জাহিদ
সাধারণত একসাথে চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট বাসায় বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন জাহিদ। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরও বোমা বানানোর কাজ রপ্ত করতে না পারলে, সরাসরি ভিডিও কলের মাধ্যমে সব কিছু আবারও বুঝিয়ে দিতেন তিনি।
সর্বশেষ সাইনবোর্ড ট্রাফিক পুলিশ বক্স হামলায় গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবির সদস্য মামুন সিটিটিসিকে জানান যে, তিন দিন বোমা বানানোর পরেও তা কাজ না করলে আরেক জঙ্গি মাহাদি হাসানের দেওয়া আইডিতে ভিডিও কল দেন মামুন। ভিডিও কলে জাহিদের পরামর্শ অনুযায়ী বোমা বানালে, সেই বোমা কাজ করে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা করে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। এসব ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গিরা সবাই বোমা বানাতে পারেন। এত জঙ্গি কিভাবে বোমা বানাতে পারে; তার উত্তরে চলে আসে জাহিদ হাসানের নাম।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে অনলাইন সেল (ইদাদ) খুলেন জাহিদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করার জন্যই এই সেল খোলা হয়। এমন তিনটি ইদাদে ২০ জন করে সদস্য জাহিদ হাসানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। তবে তাদের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে গ্রেফতারের এড়াতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন তারা।
জাহিদ হাসানকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন যে, শিক্ষাজীবন থেকেই জাহিদ হাসান জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। এবং এই বড় মাপের জঙ্গিকে গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।