১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, রবিবার

আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে উঠে এসেছে সরকারি দুই সংস্থার গাফলতি

Advertisement

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মালিক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি দুটি সংস্থার গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেনি। তারা ঠিকঠাকমতো দায়িত্ব নিয়ে মনিটরিং (তদারকি) করলে এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত। তদন্তে কারখানায় নানা ধরনের অনিয়মের চিত্রও উঠে এসেছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে তদন্ত কমিটি আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী জেলা প্রশাসকের কাছে ৪৪ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। (রোবরার) ৮ জুলাই রাতে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে করোনার ভাইরাসের কারণে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানানো যায়নি বলে জানান তিনি।

আগুন লাগার কারণে সম্পর্কে তদন্ত কমিটির ব্যখ্যা অনুযায়ী, নিচতলায় কেন্দ্রীয় কমপ্রেসারের কক্ষে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত কারখানার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। কারখানায় এই ধরনের প্রাণহানি রোধে তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশও করেছে।

এর আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে আসে, অতিরিক্ত তাপে কারখানার নিচতলার একটি এগজস্ট ফ্যানের ট্রুটির কারণে তার গলে আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানায় অনেক দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ওই কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাও ছিলো না তাই প্রানহানির ঘটনা ঘটে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের পাঁচতলার সিলিংয়ের একটি অংশ ধসে পড়ে এই অগ্নিকান্ডের কারণে। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্‌ গণমাধ্যমে বলেন, ওই কারখানায় অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা, আগুন নেভানোর জন্য কারখানায় প্রশিক্ষিত জনবল ছিলো না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এনওসিও পাওয়া যায়নি, ছিলো না পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, বিল্ডিং কোডও মানা হয়নি ভবন নির্মানের সময়। এছাড়াও শিশুশ্রমসহ নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

জেলা প্রশাসক বলেন, কারখানার নিচতলার কেন্দ্রীয় গুদামের কমপ্রেসারের রুমের এক পাশে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর ধোঁয়া বের হলে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তখন চতুর্থ তলার ফ্লোর ইনচার্জ শ্রমিকদের আশ্বস্ত করেন, আগুন নিভে যাবে। এরপর শ্রমিকদের তাঁর রুমে নিয়ে যান। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকেরাসহ তিনি ওই রুম থেকে আর বের হতে পারেননি, সেখানেই একটি কক্ষে আগুনে পুড়ে তাঁদের মৃত্যু হয়। তদন্ত কমিটি কারখানার প্রতি তলায় নেট দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রমাণ পেয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, তদন্ত কমিটি আগুনে বেঁচে যাওয়া ওই কারখানার শ্রমিক, সংশ্লিষ্ট মোট ২১ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন। তদন্ত কমিটি সরকারি নয়টি সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে তদন্ত কাজ করেছে।

তদন্ত কমিটি সেখানে নিয়মিত তদারকি করছে শিশুশ্রম বন্ধে, শ্রম আইন অনুসরণ করে মৃত শ্রমিকদের কারখানার মালিকপক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান,দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের কর্মক্ষম কাউকে মালিকের অন্য কারখানায় চাকরির ব্যবস্থাসহ ২০ দফা সুপারিশ পেশ করেছেন।

জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, প্রতিটি বিভাগ যদি ঠিকভাবে কারখানা মনিটরিং (তদারকি) করত, তাহলে সেখানে শিশুশ্রম থাকত না, বিল্ডিং কোর্ডের অসংগতি থাকত না। ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পর্যাপ্ত থাকত। তাহলে এই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত। তাদের তদারকির কমতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন শ্রম মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৪৮ জনসহ মোট ৫১ (লাফিয়ে পড়ে ৩ জন) জনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৪৮ ঘণ্টার চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আলাদা আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষা শেষে নিহত ব্যক্তিদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ৪৫ জনের লাশ হস্তান্তর করেছে সিআইডি। তিনজনের লাশ ডিএনএ পরীক্ষা শনাক্ত হওয়ার পর হস্তান্তর করবে সিআইডি।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement