একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সানোয়ার হোসেন বলেন, এই মহামারীর প্রথম দফার ধাক্কা সামলাতে ধার করে আবার ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম। গুছিয়েও অনেকটা এনেছিলাম। এখন কাজকর্ম বন্ধ হয়ে পড়ায় মাথায় হাত পড়েছে। এছাড়াও কর্মচারীদের বেতন, দোকানের ভাড়া-সব মিলিয়ে কঠিন এক সময়ের মধ্য অনেক কষ্টে জীবন-যাপন অতিবাহিত করছি। এমন এক পরিস্থিতি না পারি কাউকে বলতে, না পারি নিজে সইতে। এ সময় লকডাউন জীবনের গতিটাকেই একেবারে লক করে দিয়েছে। শুধু সানোয়ার হোসেনই নন, এই কঠোর লকডাউনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুঃখ-কষ্টের ধরন অনেকটা একই রকম।
চলমান এই লকডাউনে সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষই কোনো না কোনো দুর্ভোগে পড়েছেন। তবে সকলের সমস্যা একরকম তা নয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে চলছে কঠোর লকডাউন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও স্থবির হয়ে পড়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে । হয়তো তারা অনেকে চাকরিও হারিয়েছেন, আবার অনেকের বেতনও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে কাজকর্ম না থাকায় বড় একটি অংশের আয়ের পথ বন্ধ যায়। প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা, কর্মী ছাঁটাই, বেতন কর্তন, – প্রভৃতি কারণে আয় হারিয়ে অনেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। পরিবারের আহার, বাড়ি ভাড়া এসব নানা দিক বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অনেকে। সামাজিক মর্যাদার দিকে তাকিয়ে কারও নিকট কিছু চাইতেও পারছেন না। যার কারণে কষ্ট সহ্য করছেন অনেকে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা যে পর্যায়ে আছে, তা হয়তো এখনও সহনীয়। আবার যদি অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হয়ে যায় তাহলে তারাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন। এখনও দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য রয়েছে। কিন্তু বণ্টন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তাছাড়াও মধ্যবিত্তদের কোনো পরিসংখ্যান সরকারের নিকট নেই। যার কারণে তাদের কাছে খাবার পৌঁছানো খুব কঠিন। নিম্নবিত্তরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও মধ্যবিত্তদের সিংহভাগ একটি অংশই কিন্ত অসহায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রথমে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে। সে জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সমাজবিজ্ঞানীদের ও অর্থনীতিবিদ মতে, মধ্যবিত্ত তারাই যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে। সে অনুযায়ী তাদের মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি মৌলিখ অধিকার গুলোর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকেও মানদন্ডের আওতায় আনতে হবে। এ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা চার কোটির মতো।এর উল্লেখযোগ্য অংশই নিম্নবিত্ত। তাদের মধ্যে অনেকে ছোট বেসরকারি চাকরি, ছোট ব্যবসা এবং দৈনন্দিন কাজসহ বিভিন্ন কাজের সাথে নির্ভরশীল। পূর্বের বছরের লকডাউনে সরকারের পক্ষ থেকে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। যারা উচ্চবিত্ত তাদরে জন্য ছিল শিল্পের প্রণোদনা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীরা কিছু প্রণোদনা পেলেও , মধ্যবিত্তদের জন্য মোটা দাগে তেমন কিছুই ছিল না। বলা যায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের জন্য‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে এবারের লকডাউন। তবে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর (ক্যাব) রিপোর্টে বলা হয়, মহামারির প্রভাবে নিম্নবিত্তদের আয় ব্যাপকভাবে কমেছে। তাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা ।
সানোয়ার হোসেন ১৮ বছর পূর্বে গ্রাম থেকে শহরে এসে একটি প্রেসে কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেন। তবে বর্তমানে ৩৪ বছর বয়সী এ উদ্যোক্তা পুরান ঢাকায় ‘এসএমএস প্রিন্টিং প্রেস’ নামে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন । তিনি সহ আরও দুজন কর্মচারী কারখানায় কাজ করেন। তিনি আরও বলেছেন, লকডাউনের শুরু হওয়া থেকে ৪ মাস প্রেস বন্ধ ছিল। তারপর আবার কয়েক মাস কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপর আবার লকডাউন, আবার প্রেস বন্ধ। ঘর ভাড়া, দোকান ভাড়া, দুজন কর্মচারী, পরিবারের খরচ-সব মেটাতে প্রতিমাসে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সামান্য স্বস্তি পেতে না পেতেই অস্বস্তি কাজ করে।