১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, শনিবার

লাইভে এসে করজোড়ে মিনতি এক চিকিৎসকের

Advertisement

দেশে প্রতিদিন সরকারি হিসেবেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, শনাক্ত এবং মৃত্যু সবই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শনাক্তের দৈনিক হারও যে কোন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আজ রবিবারও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এভাবে রোগী বাড়লে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। এবার ঢাকার বাইরে বিভাগীয়, জেলা এমনকি গ্রামেও ব্যাপকহারে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি কাশি। অনেকে উপসর্গ নিয়ে মারাও যাচ্ছেন পরীক্ষা না করিয়েই।

হাসপাতালে ঠাঁই নেই। আইসিইউ তো দূরের কথা- বিশেষায়িত কভিড হাসপাতালের একটি সাধারণ বেডও এখন সোনার হরিণ। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগী আর তার স্বজনদের ভিড় বাড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও। সরকার সংক্রমণের লাগাম টানতে কঠোর বিধিনিষেধ জারি রেখেছে। কিন্তু এতকিছুর পরও ঘুম ভাঙছেনা সাধারণ মানুষের। সবকিছুই চলছে- এমনকি এই মহামারির দুর্যোগে নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিনের বিশাল আয়োজন তো বটেই- মাইক বাজিয়ে নেচে গেয়ে নৌ বিহারেরও কারবার চলছে। ঈদের পরদিন এমন একটি বিনোদনে ভরপুর নৌকাডুবিরও ঘটনা ঘটেছে। রাজধানী ঢাকা সহ ঘনবসতিপূর্ন এলাকাগুলোতে পুলিশ, র‌্যাব বা সেনা সদস্যদের চোখের সামনে না দেখলে মাস্ক পকেটেই থাকছে। দিব্যি চলছে মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানের আড্ডা। শুধু যাদের পরিবার সংক্রমিত হচ্ছে, যারা প্রিয়জন হারাচ্ছেন- তারাই লড়াই করছেন পরিস্থিতির সঙ্গে।

সরকার টিকার ব্যবস্থা করেছে। আগামী কয়েকদিনে ষাট লাখ ডোজ টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপরও অনেক সময়ের ব্যাপার জনবহুল এই দেশে প্রাপ্তবয়স্ক সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে। এমন পরিস্থিতিতে গেল বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেসবুক লাইভে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কৃষ্ণা মজুমদার রুপা। তিনি হাসপাতালে করোনা রোগীর ভয়াবহতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে এবং অক্সিজেনের সাপ্লাই থাকার পরও রোগী সেই অক্সিজেন নিতে না পেরে কীভাবে মারা যাচ্ছে তার বর্ণনা দেন। একইসাথে তিনি মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য মিনতি জানিয়ে বলেন, দেশকে করোনামুক্ত করার দায়িত্ব শুধু সরকার ও সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নয়, এ দায়িত্ব প্রত্যেকটা মানুষের!

লাইভে অত্যন্ত মর্মাহত, হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা এবং সামনের দিনগুলো কেমন যাবে সেই বিষয়েও কথা বলেন তিনি। ডা. কৃষ্ণা বলেন, ‘একবার একজন করোনা রোগীর সঙ্গে এসে দেখা করে যান। আমি প্রায় শখানেক রোগী আজকে দেখেছি। কোনো স্বজনের চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আপনারা এই জগৎ দেখেন নাই, কিন্তু কখনো দেখবেন না সেই গ্যারান্টি ওপরওয়ালা ছাড়া কেউ বলতে পারেন না। অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্তভাবে বলছি, একেক জনের কষ্ট সহ্য করার মতো না। সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু জানি না আজকের দিনটা বাঁচবেন কি না।’

ডা. কৃষ্ণা বলেন, ‘এবার ঈদে হাসপাতালে ডিউটি করেছি। এর আগেও ঈদে ডিউটি করেছি, কিন্তু রোগীদের অবস্থা এত শোচনীয় ছিল না। সবাই মৃত্যুর যন্ত্রণায় ভুগছেন। অক্সিজেনের অভাবে কত কষ্টে একজন মানুষ মারা যেতে পারে, সামনে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অক্সিজেন সাপ্লাই থাকার পরও নিতে পারছে না। কারণ, তাদের ফুসফুস অক্সিজেন নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।’

ডা. কৃষ্ণা বলেন, ‘পিপিই পরে আমরা ডিউটি করি। দম বন্ধ অবস্থায় এই পোশাক পরে ডিউটি করতে হয়। যেখানে ডিউটি করি সেখানে এসি নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। এই পোশাকে অক্সিজেন পাওয়া যায় না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, অনেক কষ্ট, জীবনটা মনে হয় বের হয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রথম থেকে আমরা যে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি, কোনো কিছুতেই সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, ঈদের পরে করোনার ভয়াবহতা হয়তো এমন করুণ পর্যায়ে পৌঁছাবে যে রোগীকে বিছানা দেওয়া সম্ভব হবে না। প্রত্যেককে অক্সিজেন দেওয়া আছে। কারো স্যাচুরেশন ৬৫, কারো ৭৫। গর্ভবতী মায়েদের কষ্ট দেখেছি। করজোড়ে অনুরোধ, এটাকে কেবল সরকার বা ফ্রন্টলাইনারদের যুদ্ধ ভাববেন না, এটা সবার যুদ্ধ। করোনাযুদ্ধ কবে শেষ হবে জানি না। এই আমি এতগুলো পজিটিভ রোগীর চিকিত্সা দিয়ে বাসায় যাব, তখন আমি কী করে পরিবারের সদস্যদের কাছে যাব? এই বাস্তবতা নিয়েই প্রত্যেক চিকিৎসক যার যার দায়িত্ব পালন করছেন। এর শেষ কোথায়? শেষ তখনই হবে যখন আপনারা সচেতন হবেন।

তিনি বলেন- অনুরোধ, যুদ্ধটাকে শুধু সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। আপনারা হাসপাতালে ভর্তি না হলেই আমরা খুশি। যে অবস্থা দেখছি, হাসপাতালে এসেও রোগী আগামীতে আর ভর্তি হতে পারবে কি না, বলা যাচ্ছে না।’

ডা. কৃষ্ণা আরও বলেন, আমাদেরও তো পরিবার আছে, স্বজন হারানোর ভয় আছে। অনুরোধ আপনাদের কাছে, যুদ্ধটাকে শুধু সম্মুখসারির ঘাড়ে না চাপিয়ে দিয়ে, সচেতন থেকে, ঘরে থেকে, মাস্ক পরে এ যুদ্ধে সামিল হন। করোনা রোগীর সাথে হাত মেলাতে হবে না। সে অবস্থা দেখছি হাসপাতালে এসে রোগী ভর্তি হতে পারবে কী না সেটা বলা যায় না। কোনো জায়গাই হয়তো থাকবে না। মনটা খারাপ, এত কষ্ট দেখা যায় না। আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে আমাদের সাহায্য করুন। দেশকে বাঁচান, নিজেদের বাঁচান। যুদ্ধে কখনো একা জয়ী হওয়া যায় না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে জয়ী হতে হয়। আমরা আপনাদের পাশে সবসময় আছি। আপনারাও আমাদের সহযোগিতা করুন।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement