১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, রবিবার

ডেলটায় কুপোকাত চীন : উহানে আবার ফিরল করোনা

Advertisement

চীনে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অতিসংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তিন শতাধিক সংক্রমণ গত দশ দিনে শনাক্ত করা হয়েছে। নতুন করে বিধিনিষেধও আরোপ করা হচ্ছে। ২০২০ সালের পর একজনের মৃত্যুর খবরও এসেছে উহান থেকে।

চীনের যে নগরী হতে করোনাভাইরাস প্রথম ছড়িয়েছিল, সেই উহান নগরীতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, উহানে মোট সাতজনের সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে।

ডেল্টার কারণে চীন খুব ঝুঁকির মধ্যে আছে কীনা তা নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করছে। চীনের গণমাধ্যমে এখন করোনার প্রাদুর্ভাবই শিরোনাম দখল করে আছে। দেশটির শীর্ষস্থানীয় একজন বিশেষজ্ঞ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন শহরে নতুন করে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। কোটি কোটি মানুষকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। চীনে কত মানুষ পুরোপুরি টিকা পেয়েছে তা স্পষ্ট নয়, তবে চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, এ পর্যন্ত ১৬০ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে।

এখন চীনের মোট ১৫টি প্রদেশ ও পৌর এলাকায় কোভিডের সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি এলাকার সংক্রমণই চীনের পূর্বাঞ্চলীয় জিয়াংশু প্রদেশের নানজিং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনে নতুন করে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য কর্তৃপক্ষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং সেখানকার পর্যটন মৌসুমকে দায়ী করছে। তবে চীনে শনাক্ত হওয়া সংক্রমণ অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বেশ কম।

কিন্তু গত বছর প্রথম সেদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার পর এই প্রথম এত বেশি সংখ্যায় এবং এত বেশি এলাকায় সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এই দফায় প্রথম কোভিডের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল নানজিং বিমানবন্দরে। রাশিয়া থেকে আসা বিমান পরিস্কারের কাজ করেছিলেন যে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা, তারাই প্রথম আক্রান্ত হন। এরপর চীন দ্রুত শহরটির ৯২ লাখ মানুষের সবাইকে পরীক্ষা করেন এবং স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারি করেন।

কিন্তু এই সপ্তাহান্তে চীনের হুনান প্রদেশের জাংজিয়াজি শহরে বেশ কিছু সংক্রমণ ধরা পড়ে। মনে করা হয়, নানজিং এর কিছু মানুষ সেখানে গিয়েছিলেন এবং তাদের মাধ্যমেই সেখানে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখন শহরের একটি থিয়েটারে যে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ গিয়েছিলেন, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এই থিয়েটারে একদিনের প্রদর্শনীতেই প্রায় দুই হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিলেন।

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, নগরীর আকর্ষণীয় স্থানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পর্যটকদের শহর ছাড়ার আগে কোভিড টেস্ট করতে বলা হয়েছে।

জাংজিয়াজি নগরীকে এখন চীনের করোনাভাইরাসের নতুন ‌‘গ্রাউন্ড জিরো’ বলে বর্ণনা করেছেন চীনের শীর্ষ এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঝং নানশান। নতুন দফা করোনার সংক্রমণ এখন বেইজিং পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেখানে স্থানীয়ভাবেও কিছু সংক্রমণ ঘটেছে।

যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে, সেসব এলাকার সঙ্গে বেইজিং এর সব ধরনের বিমান, বাস এবং অন্যান্য ভ্রমণের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে সব ধরনের পর্যটকদের বেইজিং ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেবল জরুরি কাজের বেলাতেই কোভিড টেস্ট নেগেটিভ হলে শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে।

উত্তরের হেনান প্রদেশের জাংজু শহরেও সংক্রমণ ঠেকাতে জোর চেষ্টা চলছে। এই শহরে মারাত্মক বন্যার পাশাপাশি করোনাভাইরাসও ছড়িয়েছে।

চীনের ক্ষমতাসীন দলের মূখপাত্র গ্লোবাল টাইমস পত্রিকায় এবারের সংক্রমণকে উহানের পর সবচেয়ে মারাত্মক বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। এক পৃথক সম্পাদকীয়তে চীনের রাষ্টায়ত্ত পত্রিকায় বলা হয়েছে, কোভিড প্রতিরোধের ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি ছিল।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘কেবল একটি ত্রুটির কারণে যদি দেশজুড়ে এতগুলো প্রদেশ এবং অঞ্চল আক্রান্ত হয়, তাহলে তো সেটা বেশ উদ্বেগজনক। এ থেকে বোঝা যায় মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের যে ধারাবাহিক অগ্রগতি, সেটা আরও জোরদার করতে হবে।’

এই নতুন দফা সংক্রমণের কারণে টিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ টিকা নিয়েছে এমন অনেক মানুষও আক্রান্ত হয়েছে। চীনে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের গবেষক শাও ইমিং বলেছেন, টিকা নেওয়া লোকজনের মধ্যেও সংক্রমণ হতে পারে, এটা প্রত্যাশিত।

চীনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুটি টিকা হচ্ছে সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্মের। বিশ্বজুড়ে অনেক ক্লিনিকাল পরীক্ষায় এই দুটি টিকা কোভিডের সংক্রমণ ঠেকাতে যথাক্রমে ৫০ শতাংশ এবং ৭৯ শতাংশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। তবে মৃত্যু বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অসুস্থতা ঠেকাতে এই দুটি টিকা খুবই কার্যকর বলে দেখা গেছে।

এদিকে, কয়েকটি প্রদেশ ও শহরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় কঠোর লকডাউন জারি করেছে চীন। উহানের মতো এবারও বন্দি হয়ে পড়লেন কয়েকটি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ।

সোমবার থেকে জারি করা হয়েছে এ নতুন লাকডাউন। গত কয়েক মাসের মধ্যে নতুন করে ফের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং গণহারে লোকজনের করোনা পরীক্ষা করছে কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়ভাবে চীনে সোমবার নতুন করে ৫৫ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। করোনার অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণেই দেশটিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।

চীনের ডজনখানেক প্রদেশ এবং ২০টির বেশি শহরে ইতোমধ্যেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।

রাজধানী বেইজিংসহ অন্য বড় শহরের স্থানীয় সরকার তাদের লাখ লাখ বাসিন্দার করোনা পরীক্ষা করছে। খবর এএফপির।

হুনান প্রদেশের কেন্দ্রীয় ঝুঝোউ শহরে সোমবার ১২ লাখ বাসিন্দাকে কঠোর বিধিনিষেধের আওতায় বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন দিনের জন্য ওই শহরে লকডাউন জারি করা হয়েছে।

সরকারি এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এ সময়ে গণহারে লোকজনের করোনা পরীক্ষা এবং ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালানো হবে।

ঝুঝৌ সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সেখানকার পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ এবং জটিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই কঠোরভাবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে চীন। এ কাজে তারা বেশ সফলও হয়েছেন।

কয়েক মাসের কঠোর প্রচেষ্টায় স্থানীয়ভাবে করোনা সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয় বেইজিং। কিন্তু নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় দেশটিতে আবারও উদ্বেগ বেড়ে গেছে। কারণ এখন পর্যন্ত পাওয়া করোনার বিভিন্ন ধরনের মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক ধরন হচ্ছে ডেল্টা।

সূত্র : এএফপি, গ্লোবাল টাইমস-চায়না এবং বিবিসি।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement