৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, রবিবার

জলদূর্গের শহরে

Advertisement

মেটে রঙের ইট। শহরের প্রান্তে গুরুগম্ভীর অবয়ব। দূর থেকে নিজের স্বকীয়তার জানান দেয়, রাশভারী গড়ন দিয়ে। কাছে গেলে দেখা মেলে দেয়ালে ফোকড়। এসব ফোকর থেকেই গুলি করা হতো ‘বর্গী’দের। তখন নদী ছিল দূর্গের কাছাকাছি। দূর্গের ভেতর উঁচু ঢিবি থেকে গর্জে উঠতো কামান। বর্গীতে আর সৈন্যদের সংঘর্ষের পর পাড়ে উঠতে না পারলে ফিরে যেত জলদস্যুর দল। ফের শান্তির নিঃশ্বাস ফেলত ইছামতি তীর আর মানুষেরা।

সেই মানুষেরা কেউই নেই এখন আর । না রয়েছে বর্গী, না সেনা টহল। ফুরিয়েছে কার্তুজ ঠিক সময়ের মতোই। মীর জুমলাও চলে গেছেন নিজের পথ ধরেই। গতিপথ থেকে সরে গেছে বিভূতীভূষণের ‘ইছামতী’। শুধু সময়কে দেয়া কথা রাখতে অতীত বুকে নিয়ে রয়ে গেছে পুরু দেয়ালের ইদ্রাকপুর জলদূর্গ।

আর সেই দূর্গ দর্শনেই শুক্রবার সকালে রওনা দেই মধ্যাঞ্চলের শহর মুন্সীগঞ্জে। দুপুর হয়ে গেছে ততক্ষণে। পথে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জকে একসুঁতোয় বাধা মুক্তারপুর সেতুতে উঠতেই লিলুয়া বাতাসের স্পর্শ। প্রবল নয়, একদম ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে বাতাস। নিচে নিস্তরঙ্গ ধলেশ্বরী, শুধু বিশাল বিশাল লঞ্চ গেলেই ব্যস্ত হয় ঢেউয়েরা। প্রকৃতিও জিরিয়ে নিচ্ছে উইকেন্ড পেয়ে।

সেতু পেরিয়ে গেলেই বুঝলাম চলে এসেছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর অতীশ দীপঙ্করের ভূমিতে। তবে সেই মমতামাখা গ্রাম তো আর নেই, শহর হবার দৌড়ে শামিল হয়েছে অনেক আগেই। অটো, রিকশা, লেগুনা, সিএনজি, বাসে একদম লোকারণ্য। তবে উইকেন্ড বলে ভীড় কম।

যে কোন মফস্বলই আমাকে বিস্তর টানে। মনে করায় মফস্বলের আঁচ পাওয়া শৈশব। শান্ত শহরের নদীর পাড় ঘেষে যাওয়া রাস্তায় তখন রিকশা। বাঁধে ঢেউয়ের শব্দ পাই ‘ছলাৎ ছলাৎ’। মনে হয় সব জেলা শহরের রাস্তাই বোধহয় এক। নাকে থাকে না ঠিক, কিন্তু মাথায় থেকে যায়। চেনা ঘ্রাণ, চেনা দৃশ্যপট। বড় শহরে নিজস্ব ঢঙে বলা ‘স্মল টাউন’। তাতে ‘মফস্বল’ শব্দের যে দরদ, তা নেই। পা, চোখ আর মাথায় যেন ঢেলে দিচ্ছে সব স্মৃতি। অটো নিয়ে চলে গেলাম ইদ্রাকপুর দূর্গ। দূর্গের পাশেই চমৎকার এক পুকুর। টলটলে সবুজ পানিতে নীরব দূর্গের ছায়া।

সেই সময়, যখন বাংলা মানেই নদী। আর নদী মানেই শহর। আর শহর মানেই নিরাপত্তা আর দখলের নিশ্চয়তা। ইদ্রাকপুর এলাকাটি ইছামতি-ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার সংগমস্থল ছিল। সাড়ে তিনশো বছরের একটু বেশি বয়স এই জলদূর্গের। নির্মাতা ছিলেন মুঘলদের তারকা সেনাপতি মীর জুমলা। বাংলার সুবাদার তখন তিনিই ছিলেন।

ধারণা করা হয় ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে ইদ্রাকপুর দূর্গ তৈরী সম্পন্ন হয়। সাধারণত জলদস্যু নির্মূলের কথা বলা হলেও এই দূর্গ নির্মাণের আরেকটি লক্ষ্য ছিলো বারো ভূঁইয়াদের একহাত দেখে নেয়া। পাশাপাশি স্থানীয় অঞ্চলে মুঘল সামরিক ও প্রশাসনিক প্রভাব বলয় তৈরী। এখনকার মুন্সীগঞ্জ শহরের দিকে তাঁকালে মনে হয় এই দূর্গ কেন্দ্রীকই গড়ে উঠেছিলো জনবসতি।জলদূর্গের শহরে


ইছামতীর জল গড়ায়। বারোভুঁইয়াদের পতন যেমন হয়েছিলো মুঘলদের হাতে। মুঘল সূর্যও ডুবে যায় ইংরেজ আগ্রাসনে। সিপাহী বিদ্রোহের পর সব সামরিক স্থাপনার মতো ইদ্রাকপুরও নিয়ন্ত্রণে নেয় ইংরেজরা। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেই দূর্গ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ কর্তৃপক্ষ।

কেল্লার নকশা
একদিনের ভ্রমির চোখ স্থাপনা বর্ণনায় হুবুহু হয় না। তাই মুন্সীগঞ্জ জেলার ওয়েবসাইটের সাহায্যও নেই, দূর্গের উত্তর দিকে বিশালাকার প্রবেশদ্বার রয়েছে। ঢুকতেই টলটলে পানির ছোটপুকুর। সিঁড়ি দিয়ে মূল দূর্গের চূড়ায় উঠা যায়। মূল ভূমি হতে ২০ ফুট উঁচু। দেয়ালের বর্তমান উচ্চতা প্রায় ৪/৫ ফুট। প্রাচীরের দেয়াল ২-৩ ফুট পুরো।

কেল্লাটি দুই ভাবে বিভক্ত- পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশ। ড্রামের মধ্যখান বরাবর একটি ৫ ফুট উচ্চতার দেয়াল রয়েছে। প্রাচীরের উত্তরপাশে কামান বসানোর তিনটি মঞ্চ। দক্ষিণ পাশেও তিনটি থাকার কথা কিন্তু সেখানে রয়েছে ২টি।

চতুর্দিকে প্রাচীর দ্বারা আবৃত দূর্গের মাঝে মূল দূর্গ ড্রামের মধ্যে। দূর্গের প্রাচীর শাপলা পাপড়ির মতো। প্রতিটি পাপড়িতে ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্র দিয়ে কাঁসার ব্যবহার করা হতো। ২১০ দৈর্ঘ্য ২৪০ ফুট আয়তনের এ দূর্গখানি এখনও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

কেল্লাকাহিনী
সহস্র বছরের কেল্লার পরতে পরতে ঝিম ধরে আছে অতীত। অস্ত্র, রক্তপাত, দখল, প্রভাব, ভূরাজনীতি আর যুদ্ধের মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের ইতিহাসে বেঁচে আছে ইদ্রাকপুর দূর্গ। দূর্গে প্রবেশদ্বারের উত্তর পাশে একটি পথ রয়েছে। কথিত আছে, এ গুপ্ত পথ দিয়ে লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যেত। এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এখন আর এর অস্তিত্বই নেই। তবে কেল্লা হিসেবে পালানোর পথ থাকা স্বাভাবিক।

মীর জুমলার বর্ণাঢ্য জীবন ছিলো। বিশেষত বাংলার দস্যুদমন আর আসাম অভিযান তাকে দিয়েছে বিশেষ মর্যাদা। বেশকিছু যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো এখান থেকেই। মুন্সিগঞ্জ জেলা ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় আব্দুল্লাহপুরের মঙ্গত রায়ের বিরুদ্ধে হওয়া যুদ্ধ এই দূর্গ থেকেই পরিচালিত হয়েছিলো।

সেই যুদ্ধে দূর্গের পদাতিক বাহিনী প্রধান ও মীর জুমলার সেনাপতি সদলি খান মারা যান। নিহত হন মগ রাজা মঙ্গত রায়ও। অনেকেই ধারণা করেন মঙ্গত রায় ছিলেন শাহ সুজার সেনাপতি।

‘Life is stranger then fiction’ কথাটি যথার্থই বটে। যে শাহ সুজা ছিলেন স্বয়ং মুঘল শাহজাদা, সেইসাথে বাংলার সুবাদার। সেই সুজাকেও জড়াতে হয়েছিলো ভাতৃঘাতী সংঘাতে। পিতা শাহজাহানকে সরিয়ে আওরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে। শাহ সুজা বাংলার সফল সুবাদার হলেও বিদ্রোহ দমনে তখনও ব্যস্ত।

ভাইয়ের ক্ষমতা দখলের খবরে দিল্লিমুখী হলে খাজোয়াতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় মীর জুমলার বিরুদ্ধে। মীর জুমলা তখন বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সেনাপতি। শাহ সুজাকে তিনি ঢাকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। শাহ সুজা আরাকান পালিয়ে যান। মীর জুমলার সফল অভিযানের পর নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেন।

তারকা সেনাপতি, মীর জুমলা বাংলার ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যান ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করবার মাধ্যমে। সেই মীর জুমলার স্মৃতি বিজড়িত দূর্গ ‘ইদ্রাকপুর’।

পথের খবর
ঢাকার গুলিস্তান থেকে “দিঘীরপাড় ট্রান্সপোর্ট”এর মাধ্যমে মুক্তারপুর আসা যায়। মুক্তারপুর থেকে অটো রিক্সায় বা রিক্সা যোগে যেতে হবে ইদ্রাকপুর দূর্গে। খরচ পড়বে ১০ থেকে ৪০ টাকা। তবে কেউ না চিনলে রিকশাওয়ালাকে বলতে হবে এভিজেএম গার্লস স্কুল। স্কুলের পাশেই পেয়ে যাবেন দূর্গের দেখা।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement