বর্তমান সময়ে প্রায় ঘরে ঘরে জ্বরজারি লেগেই আছে। অনেকে আবার সর্দিজ্বরে ভুগছেন। আবার কেউ কেউ ভাইরাস জ্বরও আছে অনেকের। তবে কোনো জ্বরকেই অবহেলা করার কোনো কারণ নেই। তবে বিভিন্ন জ্বরের ভিন্ন চিকিৎসা। চিকিৎসা গ্রহণ করার পূর্বে সঠিক জ্বর চিহ্নিত করা জরুরি।
বিভিন্ন ধরনের জ্বরের উপগর্স ও লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. তানভীর আহমেদ।
জ্বরের অনেক ধরন থাকে। জ্বরকে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, ভাইরাল জ্বর এবং প্যারাসাইটিক জ্বরে ভাগ করা হয়।
ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন
শরীরে ব্যাকটেরিয়া কোষের ভেতর লুকিয়ে থেকে ইমিউন সিস্টেমে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। সেগুলোর কারণে সংক্রমণে কান ও গলার ইনফেকশন, ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, নেফ্রাইটিস ইত্যাদির ফলে জ্বর হয়। তবে রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন থেকে জ্বরে সর্দি, কফ ও শ্বাসকষ্ট থাকে। আবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে ঠাণ্ডা লাগা ভাব থাকে।
ভাইরাল জ্বর
একজন ব্যক্তির সংর্স্পশ থেকে অন্য আরেকজন ব্যক্তির যে রোগ ছড়ায় থাকে ছোঁয়াচে রোগ বলে। ঠিক তেমনি একটি রোগ হল ভাইরাল জ্বর, এটি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ভাইরাল হেপাটাইটিস ‘এ’, ভাইরাল হেপাটাইটিস ‘ই’ ইত্যাদি ভাইরাল জ্বর হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে সাধারণত হাঁচি, কাশি, লালা, হাই তোলা, কথা বলা ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগগুলো ছড়ায়।
প্যারাসাইটিক জ্বর
অনেক ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, টাইফয়েডের মতো ক্ষতিকর জ্বরগুলো প্যারাসাইটিক জ্বরের পর্যায়ে পড়ে এবং তা রোগীর জন্য বেশ অসহ্যদায়ক। বর্তমান সমেয় বেশি হওয়া ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, সর্দি-কাশি-ফ্লুর ধরন, লক্ষণ, করণীয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল।
ডেঙ্গু
কোনো ব্যক্তিকে ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশা কামড়ালে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ব্যক্তি ডেঙ্গিজ্বরে আক্রান্ত হয়। তবে অধিকাংশ ডেঙ্গিজ্বর এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গির ভয়াবহতা বেশি। এমনকি সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে ঝুঁকিও থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ-
- প্লাটিলেট হ্রাস পায়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা ও চোখ লাল হওয়া, চোখ থেকে পানি পড়া, বমি বমি ভাব, খাওয়ায় অরুচি ইত্যাদি দেখা দেয়।
- শরীরের বিভিন্ন স্থানে হামের মতো র্যাশ হতে পারে।
- যদি রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গি হয় তাহলে দাঁত ও মাড়ির গোড়া থেকে, নাক দিয়ে অথবা বমির সঙ্গে, পায়ুপথসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এমনকি শরীরে রক্ত জমে ছিটা ছিটা দাগ থাকতে পারে।
সেক্ষেত্রে চিকিৎসা-
- রোগীকে অবশ্যই পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
- পরিমাণ মতো পানি বা তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।
- জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ছাড়া ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাকজাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। তাতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে।
- যদি রক্তক্ষরণের লক্ষণ লক্ষ্য করা যায় সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
- কারও ডেঙ্গিজ্বর হলে মশারি ব্যবহার করে রোগীকে আলাদা রাখুন। তাতে অন্যরাও রক্ষা পাবে।
চিকুনগুনিয়া
এটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গির মতোই ভাইরাসজনিত একটি অসুখ। এটি স্ত্রী জাতীয় এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া হলে শরীরের ১০ বা তারও বেশি জয়েন্টে আক্রমণ করতে পারে।
চিকনগুনিয়ার লক্ষণ-
- চিকনগুনিয়া সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত থাকে এমনকি এক সময় নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গিজ্বরের মতোই। দেহের তাপমাত্রা একটু বেশি (প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত) থাকে।
- হাতের ও পায়ের আঙুল, কবজি, গোড়ালি, মেরুদণ্ড বা অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথার সঙ্গে তা ফুলেও যেতে পারে। তবে জ্বর সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা থাকতে পারে।
- তীব্র মাথাব্যথা এবং মাংসপেশির দুর্বলতা দেখা দেয়।
- আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জ্বর কমে যাওয়ার পর ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যথা চলে যায়। বাকি ৩০ শতাংশের ব্যথা কিছুদিন থাকে।
ম্যালেরিয়া কী?
ম্যালেরিয়া শুরু হয় সংক্রমিত অ্যানোফিলিসজাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে। পরে লালার মাধ্যমে এর জীবাণু প্রোস্টেটের সংবহনতন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে ও যকৃতে পৌঁছে। সেখানে পরিপক্ব ও বংশবিস্তার সৃষ্টি করে।
ম্যলেরিয়ার লক্ষণ- - এ জ্বর উচ্চমাত্রায় হলে বমি বমি ভাব ও মাথাব্যথা থাকে।
- এ রোগের প্রধান লক্ষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, যা ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।
- শীত শীত অনুভব হওয়া‘।
- মাথা ধরা, ঘুম কম হওয়া।
- খাবারে অনীহা।
- হজমে গোলযোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি ভাব বা বমি।
- খিঁচুনি, অত্যধিক ঘাম হওয়া, পিপাসা লাগা ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা- - দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
- রক্ত পরীক্ষা করার মাধ্যমের রোগটি কোন ধরনের ম্যালেরিয়া তা নির্ণয় করে জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। তা অবশ্যই ওষুধ শুরু করার আগে হতে হবে।
- যেসব এলাকা বা এরিয়ার মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগের প্রবণতা বেশি সেসব এলাকা বা এরিয়ায় গেলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
টাইফয়েড জ্বর কী?
টাইফয়েডের অন্যতম কারণ হলো দূষিত খাবার গ্রহণ। সাধারণত ‘সালেমানেলা টাইফি’ ও ‘প্যারাটাইফি’ জীবাণু থেকে টাইফয়েড নামের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গুরুতর ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারণে টাইফয়েড জ্বর হয়ে থাকে।
টাইফয়েড এর লক্ষণ- - টাইফয়েড এর প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হল- ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, চামড়ায় লালচে দানা দেখা দেয়া ইত্যাদি।
- প্রচণ্ড গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, পেট ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি।
- টাইফয়েড জ্বর আছে এমর রোগীর শরীরে তাপমাত্রা হতে পারে ১০৩-১০৪ ফারেনহাইট। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এই জ্বর প্রথম দিকে ধরা পড়ে না। দুই বা তিন সপ্তাহ পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে এবং তখন মারাত্মক হতে পারে।
টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা- - প্রথমেই অসুস্থ ব্যক্তির পরীক্ষা করতে হবে।
- পানি হালকা কুসুম গরম অর্থাৎ ফুটিয়ে পান করতে হবে। ঠান্ডা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সবসময় খাবার গরম করে খেতে হবে।
- স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।