বিনোদন জগতের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে ঢাকায় আসেন সাতক্ষীরার তরুণী গৃহবধূ শামসুন্নাহার স্মৃতি। এরপর ধারণ করেন পরীমণি নাম। মডেলিং দিয়ে শুরু হয়েছিল তার পথচলা। এরপর বেশকিছু টিভি অনুষ্ঠান ও নাটকে কাজ করেন। তবে একের পর এক সিনেমায় যুক্ত হয়ে ঝড়ের মতো মুহূর্তেই তিনি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন।
২০১৫ সালে মুক্তি পায় পরীমণি অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘ভালোবাসা সীমাহীন’। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, ওই সিনেমা মুক্তির আগেই তিনি প্রায় ২৩টি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন! যা বাংলাদেশ তো বটেই, যেকোনো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির নায়িকাদের ক্ষেত্রেই বিরল। যদিও সবগুলো সিনেমা শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলো দেখেনি। এর পেছনে কারও কারও সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতাকে কারন হিসেবে দেখা হয়, যাদের মধ্যে একজন খ্যাতিমান বিনোদন সাংবাদিকও ছিলেন।
‘ভালোবাসা সীমাহীন’ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরীমণি আলোচনায় আসেন ‘রানা প্লাজা’ সিনেমার মাধ্যমে। কেবল ২০১৫ সালেই তার এক ডজন সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। রাতারাতি ঢালিউডের তারকা বনে যান তিনি। সেই সঙ্গে তার হাতে আসতে থাকে নতুন নতুন সিনেমার কাজ আর কাড়ি কাড়ি অর্থ। শুরু হয় তার বিলাসবহুল জীবন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীতে ফ্ল্যাট নেন পরীমণি। লেকের ধারে তার সেই রাজকীয় বাসার অন্দরমহল বিভিন্ন সময় ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে। এছাড়া একাধিক বিলাসবহুল গাড়িও রয়েছে এই অভিনেত্রীর।
কিছুদিন আগে এক দুর্ঘটনায় তার আগের গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র এক দিন পরেই নতুন আরেকটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনে ফেলেন পরী। তখন অবশ্য অনেকে তার এত অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
কিছুদিন আগে পরীমণি দুবাইতে সবচেয়ে দামি হোটেলে থেকে বিলাসবহুল জলযান ইয়টে করে ঘুরে বেড়ানোর ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। সেই ছবিগুলোও ব্যাপক আলোচিত হয়।
সিনেমায় পরীমণির জনপ্রিয়তা বাড়ে ২০১৬ সালে। ওই বছর মুক্তি পায় জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত সিনেমা ‘রক্ত’। সেখানে বেশ সাহসী চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক আলোচিত হন তিনি। এর পরের বছর ‘অন্তর জ্বালা’ সিনেমায় কাজ করেও প্রশংসিত হয়েছিলেন এ নায়িকা।
তবে পরীমণির ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রশংসিত সিনেমা ‘স্বপ্নজাল’। যেটি নির্মাণ করেছেন ‘মনপুরা’ খ্যাত গিয়াসউদ্দিন সেলিম। এটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে।
সিনেমায় পরীমণির সাফল্য খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। কেননা তার অভিনীত কোনো সিনেমাই খুব একটা দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। তিনি ব্যক্তিগত নানা কর্মকাণ্ডেই পরিচিতি পেয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলামেলা রূপে হাজির হওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কাজ ও মন্তব্য করে চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়েছেন তিনি।
গত জুন মাসে উত্তরা বোট ক্লাবে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছেন পরিমণি। সেই ঘটনার রেশ কাটিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলেন পরী।
বুধবার বিকেলে তাকে আটক করেছে র্যাব। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এ সময় তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়।
২০১৫ সালে বিদ্যুতের মতো যে পথচলা শুরু করেছিলেন পরীমণি, সেটা যেন ২০২১-এ এসে ধ্বংসের মুখে পড়ে গেল। যেমন রাতারাতি তার উত্থান হয়েছিল, তেমন রাতারাতিই যেন পতনের খাতায় নাম লেখালেন ঢালিউডের এই গ্ল্যামারগার্ল।
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকায় এতদিন পরীমনিকে নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তার অতীত ও বর্তমানের নানা কাহিনী জানা থাকলেও কেউ মুখ খোলেনি। তবে তাদের সবার এক কথা, পরীমনি যতটা না নায়িকা হতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী মহলে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কথা অনুযায়ী, আজকের পরীমনি হয়ে উঠার পেছনের নানা চমকপ্রদ ঘটনা এখন প্রকাশিত হচ্ছে।
পরীমনির বাবার ছিল রিকন্ডিশন গাড়ির ব্যবসা। তার বাড়ি যশোর হলেও ব্যবসায়িক কারণে তাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসাভাড়া করে বসবাস করতে হতো। ২০০৭-০৮ সালের দিকে পরীমনির মা অগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়টি অনেকটা রহস্যাবৃত। এরপর থেকে পরীমনিকে তার বাবা সঙ্গে রাখতেন। পরী মাঝে মাঝে বরিশালে তার নানা বাড়ি গিয়ে থাকতেন। ২০১১ সালের দিকে পরীমনিকে নিয়ে সাভারের ব্যাংক টাউনে এক সাবেক নামকরা পুরুষ মডেলের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এ বাড়ির দোতালায় তারা বসবাস করতেন। এ সময় পরীমনি সাভার কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। তবে নিয়মিত ক্লাস করতেন না।
২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটে তার বাবার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় বলে পরীমনির ঘনিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ধারণা করা হয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ তাকে খুন করেছিল। এরপর থেকে পরীমনি একা হয়ে পড়েন। সাভারে তার এক খালার বাসায় থাকতেন। এ সময় উক্ত মডেল পরীমনিকে মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য চেষ্টা চালান। ২০১৪ সালে এক নাট্যপরিচালকের একটি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেয়া হয়। নাটকটি এসএ টিভিতে প্রচার হয়েছিল।
সেই থেকে পরী মিডিয়ার নানা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় চলে যান। নাটক থেকে চলচ্চিত্রে গিয়ে প্রভাবশালীদের ছায়ায় থেকে একের পর এক সিনেমা শুরু করেন। কোনো নতুন নায়িকার পক্ষে একসঙ্গে বিশ-পঁচিশটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া নিয়ে তখন চলচ্চিত্রাঙ্গণে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। যদিও এসব চলচ্চিত্রের সিংহভাগই নির্মিত কিংবা মুক্তি পায়নি। এ পর্যন্ত পরীমনি অভিনীত চার-পাঁচটির বেশি সিনেমা মুক্তি পায়নি। মুক্তিপ্রাপ্ত এসব সিনেমা ব্যবসা সফল হয়নি। তারপরও পরীমনি ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠেন।
চলচ্চিত্রের এক সময়ের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাকে বিএমডব্লিও গাড়ি উপহার দেন বলে জানা যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান থেকে পরীমনিকে নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়নি। চলচ্চিত্রে অভিনয় করাকালেই তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ হয়। বছর কয়েক আগে ঢাকার বাইরে একটি সিনেমার শুটিং চলাকালে পরীমনিকে শুটিং স্পট থেকে হেলিকপ্টারে করে তার এলাকায় নিয়ে যান। এ নিয়ে তখন চলচ্চিত্র পাড়ায় বেশ গুঞ্জন ছড়ায়।
এছাড়া বরিশালে আরেকটি সিনেমার শুটিং চলাকালে সেখানে পরীমনির নিরাপত্তার জন্য সেই জনপ্রতিনিধির অনুসারীরা দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পরম্পরায় সেই জনপ্রতিনিধির সাথে পরীমনির দূরত্ব বাড়ে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পপতিদের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে।
এক বিনোদন সাংবাদিকের সাথে তার প্রেম এবং বাগদান হলেও শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করেনি। পরবর্তীতে রনি নামে এক নাট্যাভিনেতার সাথে বিয়ে হয় এবং সে বিয়েও টিকেনি। সে সময় মিডিয়ায় আসার আগে তার আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে খবর ছড়ায়। বোট ক্লাবের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নাসির উদ্দিন আহমেদের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল বলে পরীমনির ঘনিষ্টজনরা জানায়। এছাড়া একটি বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সাথেও তার সম্পর্কের কথা শোনা যায়।
মাস দুয়েক আগে পরীমনি দুবাই বেড়াতে গিয়েছিলেন। সূত্রের তথ্যমতে, সে সময় তার সঙ্গে এক শিল্পপতি ছিলেন। দুবাই গিয়ে তারা বুর্জ আল খলিফার প্রেসিডেন্ট স্যুটে গিয়ে উঠেন। পরীমনি বেশ জাঁকজমকের সাথে তার গত জন্মদিনের আয়োজন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। এসব ঘটনায় চলচ্চিত্রাঙ্গণে প্রশ্ন উঠে, পরীমনির এই শানশওকতে চলার অর্থ কোথা থেকে পান। যার কোনো সিনেমা হিট হয়নি, হাতেও তেমন কাজ নেই-এ অবস্থায় অল্প সময়ে এত টাকার মালিক হলেন কিভাবে?
যেখানে অনেক নামকরা ও সুপারহিট সিনেমা উপহার দেয়া চিত্রনায়িকা যুগের পর যুগ অভিনয় করেও এত অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেননি, সেখানে পরীমনির মতো নায়িকা যার উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার নেই, মাত্র অল্প কয়েক বছরে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চলচ্চিত্রাঙ্গণের বেশ কয়েকজন শিল্পী বলেন, শোবিজে পরীমনি তার অভিনয় দিয়ে যতটা না পরিচিতি পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মহলে তার ঘনিষ্ট চলাফেরা দিয়ে।
ক্যারিয়ারে সাফল্যহীন একজন নায়িকার পক্ষে বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে বসবাস এবং দামী গাড়ি কেনাসহ অল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অসম্ভব। তারা বলছেন, পরীমনির আয়ের উৎসের খোঁজ নিলে তিনি তার সঠিক হিসাব দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, নায়িকার তকমা লাগিয়ে একজন ‘কমফোর্ট গার্ল’ হিসেবে প্রভাবশালী মহলে তিনি ঘুরে বেড়ান। তাদের দ্বারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে ধরা কে সরা জ্ঞান করতে থাকেন পরিমণি।