১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, বুধবার

বড় ধরনের নাশকতার ছক ছিল বোমা জাহিদের

Advertisement

নব্য জেএমবির ‘বোমাগুরু’ জাহিদ হাসান রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকান ওরফে বোমা জাহিদ (২৭) রাসায়নিক পদার্থ সরবরাহ করে এমন কয়েকটি কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল চাকরির আড়ালে বিপুল পরিমাণের বিস্ফোরক বা এক্সপ্লোসিভ প্রিকারসর সংগ্রহ করে শক্তিশালী বোমা বানানো।

জাহিদের পরিকল্পনা ছিল এই বোমা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বিদেশিদের যাতায়াত আছে এমন স্থানে হামলা করা। সেই লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫টি স্লিপার সেলও তৈরি করে জাহিদ। যার প্রতিটিতে ৩ জন করে সদস্য রয়েছে।

তবে জাহিদের ভয়াবহ এই পরিকল্পনা সফল হতে দেয়নি ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আগেই মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এরপর তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

জানা যায়, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর কেমিক্যাল কেনা-বেচায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয় দেশে। আর সেই কারণে জাহিদ বোমা বানানোর কেমিক্যাল সংগ্রহ করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে সিটিটিসির তৎপরতার কারণে সে কোনো ভাবেই বোমা তৈরির কেমিক্যালে বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারবে না- এরক একটা ধারনা তার মধ্যে তৈরি হয়েছিল। তাই এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকে সে। জাহিদ তখন সিদ্ধান্ত নেয়, যদি রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে যুক্ত থাকে তাহলে সহজেই তার প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবে।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সর্বশেষ কয়েক বছরে রাসায়নিক পদার্থ সরবরাহ করে এমন কয়েকটি কোম্পানিতে সিভি দিয়েছিলেন নব্য জেএমবির এই বোমাগুরু। চাকরি হলেই নিজের অবস্থান কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণে এক্সপ্লোসিভ কেমিক্যাল সংগ্রহ করার ইচ্ছা ছিল জাহিদ। সংগ্রহ করা উপাদান দিয়ে বোমা বানিয়ে ড্রোনের সাহায্যে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসসহ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা ছিল। তবে চাকরি পাওয়ার আগেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, পুলিশ বক্সে বোমা হামলাগুলোর ঘটনার তদন্তে একটি বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হামলায় ব্যবহার করা বোমাগুলো একই ধরনের এবং সেগুলো দেশীয়ভাবে তৈরি। তখন তদন্তকারীরা বুঝতে পারেন, বোমাগুলো নির্দিষ্ট একজনের ফর্মুলায় তৈরি হচ্ছে। এসব বোমার কারিগর নব্য জেএমবির কোনো নতুন সদস্য নয়, বরং তিনি একজন পুরোনো সদস্য।

অন্যদিকে এসব হামলার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও বোমা তৈরি থেমে ছিল না। কোথা থেকে এই বোমা আসছে আর নতুন নতুন পুলিশ বক্সে হামলা হচ্ছে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।

সর্বশেষ গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর থেকে শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই নব্য জেএমবির সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলার ও কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামাকে গ্রেফতার পর জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদের বিষয়ে জানতে পারে সিটিটিসি। তারা জানায়, জাহিদ নব্য জেএমবির বোমাগুরু। যদিও হলি আর্টিসান হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার এক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জাহিদ হাসানের বিষয়ে প্রথম তথ্য পায় সিটিটিসি।বোমা জাহিদ

সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, এক সঙ্গে চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট বাসায় বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর এ আশঙ্কা থেকে অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে জাহিদ। জাহিদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নব্য জেএমবির কোনো সদস্য বোমা বানানোর পর যদি কাজ না করতো তাহলে তারা তাকে সরাসরি ভিডিও কল দিতেন। পরে জাহিদ তাদের ভিডিও কলের মাধ্যমে সব কিছু আবারও বুঝিয়ে দিতেন।

সর্বশেষ সাইনবোর্ড ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার নব্য জেএমবির সদস্য মামুন সিটিটিসিকে জানান, তিনি ৩ দিন বোমা বানানোর পরেও কাজ করেনি। নব্য জেএমবির আরেক জঙ্গি মাহাদি হাসান জন তাকে একটি অনলাইন প্লাটফর্মের আইডি দেয়। সেই আইডিতে জাহিদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে তার পরামর্শ অনুযায়ী বোমা বানান মামুন। পরে সেই বোমা কাজ করে।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা করে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। এসব ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গিরা তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, তারা সবাই বোমা বানাতে পারেন। এত জঙ্গি কীভাবে বোমা বানাতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন, নব্য জেএমবির বোমা বানানোর সেল রয়েছে। এই সেলের প্রধান জাহিদ হাসান।

সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে অনলাইন সেল খোলেন জাহিদ। এই সেলগুলোকে বলা ‘ইদাদ’। এমন তিনটি ইদাদ রয়েছে। প্রতিটি ইদাদে ২০ জন করে সদস্য জাহিদ হাসানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে অনলাইনের মাধ্যমে। এই তিন অনলাইন সেলে ৫০-৬০ জন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যাদের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তারা গ্রেফতারের এড়াতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করার জন্যই এই সেল খোলা হয়।

এদিকে গতকাল বুধবার  ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাহিদের বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, রসায়নে পারদর্শী হওয়ার কারণে তার মেধা এবং সাহসের জন্য তাকে এই সংগঠনের সামরিক শাখার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি অল্পদিনে গ্রেনেড ও বোমা বানানোর অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন। নিত্য-নতুন কৌশলে আইইডি, বোমা ও গ্রেনেড তৈরিতে পারদর্শী জাহিদ বিশ্বস্ত সহযোগীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement