প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম এই পাট্টু আবার কে? বিকেএসপির ক্রিকেট বিভাগের প্রশিক্ষক মন্টু দত্তকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম এই পাট্টুটা কে? একটু মৃদু হেসে তিনি বললেন, এই পান্টু হলো আমাদের শামীম পাটোয়ারী, বিকেএসপির ক্রিকেট বিভাগের ক্যাডেট। আমি ওকে আদর করে পান্টু ডাকি। এর পরেই শুরু হলো পাটন্টুকে নিয়ে গল্প, তার ছোট বেলা, বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া, শামীমের বেড়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া।
পরের ঘটনাটি তো জানাই রয়েছে সবার। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া জয়ের নায়কও মন্টূ দত্তের সেই পাট্টু। পাটোয়ারীর ক্রিকেট জীবনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সববিষয় নিয়ে কে-স্পোর্টের সাথে কথা বলেছেন শামীমের গুরু মন্টু দত্ত:
প্রশ্ন: শামীমের ক্রিকেট জীবনের শুরুটা আসলে কিভাবে হয়েছিলো। বিকেএসপিতে ভর্তির সময়টা আপনি তাকে কেমন দেখেছিলেন?
মন্টু দত্ত: আমাদের এখানে তো ৭ দিনের ক্যাম্প হয়। সেই ক্যাম্পে যে ভালো পারফরম করে তাদেরকে আমরা বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ দেই।
৭ দিনের ক্যাম্পে আমরা তাদেরকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে থাকি। প্রতি গ্রুপে প্রায় ৩০ জনের মত করে ছেলে থাকে। ও যেবছর বিকেএসপিতে ভর্তি হতে আসে আমার গ্রুপে পড়েছিলো সে (শামীম পাটোয়ারী)। আমরা তাদের ম্যাচ খেলিয়ে দেখি আসলে কেমন করে।
শামীমের একটা ঘটনা বলি, ক্যাম্পের সময় প্রথম ম্যাচে শামীম করেছিলো ৭৭ রান। আমি তখনই প্রাথমিক ভাবে তাকে সিলেক্ট করে ফেলেছিলাম। পরের দিন আরও একটা ম্যাচ খেলতে নেমেছিলাম, কিন্তু শামীমকে দলে রাখিনি। যেহেতু তাকে সিলেক্ট করেই ফেলেছিলাম তাই পাটোয়ারীকে আর নামাইনি।
শামীমদের বিপক্ষ দল ২০ ওভারে রান করেছিলো ২০৫। জিততে হলে শামীমদের প্রয়োজন ছিলো ৪২ বলে ৮৭ রান। এমন সময় দেখি, শামীম আমার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। কিছুক্ষণ পরপর আসে আর যায়। একদম ছটফট করছে, আমি ওকে ডাক দিলে বললাম, নামালে ম্যাচ জেতাতে পারবে? শামীর উত্তর জি স্যার পারবো।
আমি কোন কিছু না ভেবে সত্যি সত্যি তাকে নামিয়ে দিলাম। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সত্যি সত্যি ক্রিজে গিয়ে ৬ ওভার ১ বলে ৮৭ রান তুলে ফেললো। ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়লো সেই ছেলে।
এটাতো গেলো ভর্তি ক্যাম্পের কথা, শামীম বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর আমরা রংপুরে গিয়েছিলাম তিনদিনের ম্যাচ খেলতে। টুর্নামেন্ট ফাইনালে ঢাকা দক্ষিণের সাথে আমাদের খেলা পড়েছিলো। দক্ষিণের দলে ছিলো নাইম শেখ, ফাইনালের প্রথম ইনিংসে আমরা ১৬৭ রানে অলআউট হয়ে যায়।
প্রথম ইনিংসে তারাও অলআউট হয়েছিলো ১৭১ রানে। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার সময় আমি জয় আর শামীমকে নিয়ে মিটিং করলাম, ওদের বললাম যে আমরা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবো। পরে জয় আর পাট্টু মিলে যে ব্যাটিং করেছিলো কি বলবো! দেড় ঘন্টা ব্যাটিং করে ২০০ রানের লিড ছুড়ে দেয় ঢাকা দক্ষিণের সামনে।
শামীম করেছিলো ৭৭ রান আর জয় করেছিলো ৮৫ রান। ওই ম্যাচটা আবার আমরা হেরেছিলাম, কিন্তু পাট্টুকে আমি যেভাবে বলেছিলাম ঠিক সেভাবেই সে খেলেছিলো। জিম্য়বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচেও ঠিক সেভাবেই খেললো শামীম। যেভাবে বললো রিয়াদ।
প্রশ্ন: পাটোয়ারীরকে আরও ভালো করতে হলে কী করতে হবে, আপনার কি মনে হয়?
মন্টুদত্ত: সে অনেক ছটফট করে। তাকে খেলার আগের দিনেও বুঝেয়েছি ম্যাচুরিটি কিভাবে আনতে হবে? আসলে এটা খেলতে খেলতেই চলে আসে। তবে তার জন্য কাউকে না কাউকে গার্ডিয়ান হিসেবে কাজ করতে হবে। ওর দিক নির্দেশনা আসলে খুব বেশি প্রয়োজন। ভালো করতে হলে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে হবে তাকে। যেমন দেখো, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রিয়াদ ওকে গাইড করেছে এবং ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাকে কোন ভুমিকা পালন করতে হবে। সে কিন্তু ঠিকই রিয়াদের কথামত সবকিছু একদম পারফেক্টলি করেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে যদি ও আর কিছুক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারতো তাহলে অবশ্যই আমরা ম্যাচটা হারতাম না।
প্রশ্ন: শামীমের ম্যাচুরিটি লেভেল বাড়াতে আসলে কি করতে হবে যদি একটু বলতেন?
মন্টু দত্ত: সে কিন্তু খুব রাফ এন্ড টাফ, মাঠে সে আসলেই বাঘ। তার ম্যাচুরিটি বৃদ্ধি করতে হলে, এখন থেকেই কোচ হোক বা সিনিয়র খেলোয়াড় হোক- যেমন সাকিবই বা মুশফিকই তাকে যদি সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে তবে সে আরও পরিণত হবে। সে বাংলাদেশের সম্পদ। যেমন ধরো, এক ওভারে সে ১০-১২ রান নিয়ে ফেলছে কিন্তু কোন সিনিয়র যদি তাকে বলে এখন মারার বল পেলে মারবে আর ভালো বল পেলে সিঙ্গেল নিবে বা রেখে দিবে এমন গাইডটা তার প্রয়োজন।
প্রশ্ন: শামীমের বর্তমান খেলা দেখে আপনার কি মনে হয়?
মন্টু দত্ত: এখনও তার খেলা দেখে আমি মনে করি যে সে যথেষ্ট পরিণত না। যেমন, আমি লিটনের কথায়ই বলি সে কিন্তু প্রথমে ওই ম্যাচুরিটিটাই ছিল না। এখন কিন্তু অনেকটাই স্ট্রং হয়েছে। তাকেও কিন্তু গাইড করতে হয়, এভাবে বলে দিতে হয় যে তুমি এভাবে এটা করেছো কেনো? এটা এমন না তেমন!
আপনিই দেখেন, প্রথম ম্যাচে ৯৫ রানে আউট হয়ে গেছে সে। আমি সাথে সাথেই ম্যাসেস পাঠিয়েছি যে ওই সময়টাটা কি এই শর্টটা না খেললে হতো না?। তারা ইচ্ছা করেই এমন বল দিয়েছিলো তোমার সামনে। তখন সে বলছে, স্যার এমন ভূল পরবর্তীতে আর হবে না। আমি বললাম তুই ১০০ টাকা হারায়লি। এমন করে আমরা সব সময়ই ছাত্রদের পাশে থাকি সবসময়। শামীমের সাথেও তার খেলা নিয়ে আলোচনা হয় এবং কোনটা ঠিক করতে হবে কোনটা ভুল হচ্ছে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে আমাদের।
বিকেএসপির কোচ মন্টু দত্ত কে-স্পোর্টকে আরও জানায় আসলে আমরাতো দুরে থাকি, এখন জাতীয় দলে ওদের কাছে যারা থাকে তাদেরকেই এসব সার্পোর্ট দিতে হবে।
প্রশ্ন: শামীম ম্যাচ শেষে বলেছিলো ভালো বল গুলোকেই মেরে রান বের করতে হবে আপনার পাট্টুর এই কথাটি কিভাবে দেখছেন?
মন্টু দত্ত: বেশির ভাগ ব্যাটাররা এমন কথা বলে না কিন্তু কেউ আবার বলে, কারণ কি একটি ভালো বল আসলে সে যদি ওটা মেরে দেয় তাহলে পরে আর ভালো বল আসে না। বোলার ঘাবরে যায়, তুমি খেয়াল করে দেখবা বোলার যখন খুব ভালো বল করতে থাকে তখন যে সব ব্যাটার এসব বল খেলে অভ্যস্ত না তারা কিন্তু বোলারকে সমিহ করে আরও ভালো বল করার সুযোগ করে দেয় কিন্তু যদি কোন ব্যাটার বোলারের ১-২ টা ভালো বল মেরে দেয় তখন যে ঘাবরে যায় আর এজন্য প্রয়োজন সাহস যেটা শামীমের মানে আমাদের পাট্টুর মধ্যে আছে।
শামীম পাটোয়ারী এখনও বিকেএসপির ক্যাডেট। অনুর্ধ্ব ১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ী আকবরের জুনিয়র। গেল বছর শামীম অটো পাসের যুগে ইন্টারপাস করেছেন। তার কোচ ও বিকেএসপির সকল ক্যাডেটদের প্রত্যাশা সাকিব মুশফিকদের মতই দেশের ভরসা হয়ে মাঠ মাতাবেন শামীম ওরফে পাট্টু।