মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলাধীন একটি গ্রাম জোড়পুকুরিয়া। কিছুদিন হয় ঐ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ২৪ জনের কবর একটি কবরস্থানে এক সারিতে। সেখানে বাঁশের রেলিং দিয়ে ঘেরা কবরে সমাহিত বিভিন্ন বয়সী মানুষ। নানারকম ভয়ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে গ্রামটির মানুষের মাঝে। এর কারণ হলো কিছুদিন যাবৎ গ্রামটিতে মৃত্যু বেড়েছে।
গ্রামটিতে এমন অবস্থা ছিল যে একজনের মরদেহ দাফন সম্পন্ন করে বাড়ি ফেরার আগেই আরেকজনের মৃত্যুর খবর শুনা যেত। এ গ্রামের এটাই প্রথম ইতিহাসে এতো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা। গাংনী উপজেলার আরেক গ্রাম গাড়াডোব সেখানে গত এক মাসে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। জেলার অনেক গ্রামের চিত্র এমন হলেও স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করছে।
তারপর খোঁজ নিয়ে জানা যায় জোড়পুকুরিয়া ও গাড়াডোব এ দুই গ্রামে যারা মারা গেছে তাদের বিভিন্ন রকম কারণ বিরাজ করে যেমন কেউ করোনা আক্রান্ত, আবার কাউরও বার্ধক্যজনিত কারণে, কারও আবার দীর্ঘদিনের রোগাক্রান্ত এবং কিছু মানুষের করোনা উপগর্সও ছিল। তা ছাড়া বেশিরভাগ সংখ্যক মানুষ সর্দি, জ্বর ও করোনার উপসর্গ নিয়ে করোনা পরীক্ষার আওতার বাইরে রয়েছেন।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামের একজন পল্লীচিকিৎসক জানান, প্রতিদিন অন্তত ৩০ জন মানুষ তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসত। তাদের মধ্যে আবার অনেকে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসত। তারা করোনা পরীক্ষায় অনেকটাই অনাগ্রহী ছিল এদের করোনা পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না বলে এই পল্লীচিকিৎসক অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন। তিনি আরও জানান, জোড়পুকুরিয়া ও আশপাশের গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির মানুষেরই করোনা উপসর্গ আছে। করোনা পরীক্ষা করলে তাদের মধ্যে ৮০ ভাগের ওপরে পজিটিভ হবে।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামে গত এক মাসে যে ২৪ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে একজন করোনা আক্রান্ত ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে কেউ করোনা পরীক্ষা করেননি। পরীক্ষা করলে তাদের মধ্য থেকেও অনেকের করোনা পজিটিভ পাওয়া যেত। এত মৃত্যুর পরও গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানা ও করোনা পরীক্ষার বিষয়ে নানা অজুহাত, টালবাহানা দেখাচ্ছেন।
উপজেলার শাহারবাটি ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জানান. গ্রামের মানুষকে করোনা পরীক্ষার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে মানুষ তো সতর্ক হচ্ছে না, সাবধান হচ্ছে না। গাড়াডোব গ্রামও জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মতো একই চিত্র। গাড়াডোব গ্রামে মৃত্যুবরণকারী ২১ জনের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন পাঁচজন। এছাড়া বাকি যারা মারা যায় তাদের কারও করোনা পরীক্ষা হয়নি।
গাড়াডোব গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, করোনা আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ও করোনা পরীক্ষা নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যাচারে বেশিরভাগ মানুষ। যার কারণে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত হলেও পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। জ্বর, সর্দিসহ করোনার অন্যান্য উপসর্গ থাকা কেউ যখন অক্সিজেন সঙ্কটে পড়েন তখন তাকে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তাদেরই কেবল চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাকিরা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিতেই অভ্যস্ত।
তাছাড়াও গাড়াডোব গ্রামের ১নং ইউপি সদস্য (মেম্বার) হাবিবুর রহমান তিনি জানান, অনেকে মৌসুমি জ্বর ভেবে করোনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার অনেকে রোগ গোপনও করছেন। যখনই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তখন সাথে সাথে কেবল জেলা হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করেন। এ অবহেলার কারণে বেশি লোক মারা গেছে। উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখের উজ্জামান তিনি বলেন, করোনা ও উপসর্গে ২১ জন মানুষ মারা গেছে। তারপরও মানুষ সচেতন হয়নি। অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করেন না ।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দীন বলেন করোনা পরীক্ষা ও আক্রান্ত হলে কোনো ভীতি নেই। যাদের ঠান্ডা, কাশি যাদের হচ্ছে তারা যদি সচেতন হন তাহলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদের হাসপাতালে এসে প্রয়োজনে পরীক্ষা করাতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি করোনা পরীক্ষায় কেউ পজিটিভ হন তাহলে তার সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব। আর গোপন করলে একদিকে তিনি যেমন শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন অন্যদিকে এ ভাইরাস তার মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে। এরকম ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নেয়ার আহ্বানও জানান তিনি।