১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়, তার অশুভ চিহ্ন এখনো মিলায়নি। রাজনীতি এখনো তিক্ত মতাদর্শগত বিভক্তিতে আচ্ছন্ন।
প্রবৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টির মাপকাঠিতে যদি উন্নয়নকে বিচার করা হয়, তাহলে মানতেই হবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জোর কদমে এগিয়েছে। এই বাংলাদেশ দেখে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত খুশিই হতেন।
তবে যে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কার্যত উপেক্ষিত রয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের গ্রাম। গ্রামই বাংলাদেশ, দেশের অধিকাংশ মানুষের বাস গ্রামেই, অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি। এমনকি যাঁরা শহরে বাস করেন, তাঁদের নাড়ির টান যে গ্রামেই, সে কথাও বেশ বোঝা যায় ঈদের আগে তাঁদের গ্রামমুখী হতে দেখে। এই গ্রামকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। এখনো পারে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণে প্রস্তাব রেখেছিলেন, ‘গ্রামের প্রত্যেকটি কর্মঠ মানুষ এই বহুমুখী সমবায়ের সদস্য হবে। যার যার জমি সে-ই চাষ করবে, কিন্তু ফসল ভাগ হবে তিন ভাগে—কৃষক, সমবায় ও সরকার।’ এই গ্রামীণ সমবায়কে তিনি নতুন গ্রাম সরকার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের হাতেই উন্নয়ন বাজেটের অংশবিশেষ তুলে দেওয়া হবে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামও থাকবে তাঁদের হাতে। তিনি বলেছিলেন, ‘এরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে একসময় ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদের বিদায় দেওয়া হবে।’
বঙ্গবন্ধু যে সমবায়ের কথা বলছেন, তা চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের কলখোজ বা কালেকটিভ ফার্মিংয়ের থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও তা সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা দ্বারা অনুপ্রাণিত, তাতে ভুল নেই। চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবের ফারাক হলো- তিনি কৃষকদের মালিকানাধীন জমি ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব করেছিলেন চাষ হবে যৌথভাবে, আর সে চাষের ফসল সবাই ভোগ করবে। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাস থেকেই এই সমবায়–ব্যবস্থার প্রস্তাবনা। বস্তুত, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু নিজেই সমাজতন্ত্রে তাঁর আনুগত্যের কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না।’
সমবায় গ্রামের এই প্রস্তাব করার আগে বঙ্গবন্ধু ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে যে ভূমিস্বত্ব আদেশ তিনি জারি করেন, তাতে পরিবারপিছু সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং আরোপিত হয়। এর অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে সরকার অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু নিজ দলের ভেতরে প্রতিরোধের কারণে এই আদেশ কার্যকর হয়নি—যাঁরা দলের নেতা বা পার্লামেন্টের সদস্য, তাঁদের অধিকাংশই জোতদার। ফলে এই আইনের মাধ্যমে খুব সামান্য জমি উদ্ধার করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব হয়।
ভূমি সংস্কারের বদলে সমবায়ভিত্তিক যৌথ চাষের যে প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু করেন, তা রাজনৈতিকভাবে আপসমূলক হলেও এটি ছিল অধিক বাস্তবসম্মত। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ এত কম যে বাধ্যতামূলক সিলিং আরোপ করে যে উদ্বৃত্ত জমি মিলবে, সব ভূমিহীনের মধ্যে তা বণ্টন অসম্ভব। তা ছাড়া বণ্টিত জমির আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ায় তা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই জমির নতুন মালিক প্রতিবেশী জোতদারের কাছে তা বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। এই অবস্থায় একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে জমির যৌথভিত্তিক চাষাবাদ।
বঙ্গবন্ধু শুধু যে যৌথ চাষাবাদের প্রস্তাব রাখেন তা-ই নয়, তিনি পুরো গ্রামকে একটি সমবায়ী ব্যবস্থাপনার অধীনে আনার কথা ভেবেছিলেন। এ কথার অর্থ, গ্রামের যাবতীয় সম্পদ—তার জমি, ফসল ও পানি—এর ব্যবস্থাপনায় থাকবে গ্রামের মানুষের যৌথ ভূমিকা। এই সমবায়ী গ্রামের প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তৃতভাবে বলার সময়-সুযোগ তিনি পাননি, তবে তিনি কী চান, তার নানা ইঙ্গিত রেখে গেছেন। যেমন গ্রাম সমবায়ের মাধ্যমে যে বাড়তি আয় হবে, তার সুষম ব্যবহার ও বণ্টনের জন্য বঙ্গবন্ধু একটি ‘গ্রাম তহবিলের’ কথা ভেবেছিলেন। এই তহবিলের আয় আসবে উৎপাদিত ফসলের একাংশ থেকে, বাকিটা আসবে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে। বঙ্গবন্ধুর এই সমবায়ী গ্রামের প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এখনো প্রাসঙ্গিক।
১৯৭২ সালের জুন মাসে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’