বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন এবং অন্তরে গুমরে মরা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । যুগের দাবিকে সাহসে, শৌর্যে ভাষা দিয়েছিলেন ৭ই মার্চের ভাষণে। দখলদার বাহিনীর কামান, বন্দুক ও হেলিকপ্টার গানশিপের যে কোনো মুহূর্তে গর্জে ওঠার ভয়াল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। পৃথিবীর কোনো নেতা এভাবে স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করার সাহস দেখাননি। এমন নজিরবিহীন নেতৃত্বের জন্যই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের আই টিভিতে প্রচারিত গ্রানাডা টেলিভিশনের ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে দেওয়া সাক্ষাতকারে আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর রশীদ ও তার ভায়রা ভাই মেজর ফারুক উপস্থিত ছিলেন। এ সময় মেজর রশীদ স্বীকার করেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা। মেজর রশীদ স্বীকার করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শাসনক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রায় এক বছর পর তারা এ সাক্ষাতকার দেন। সেখানে এই দুই খুনির নানা বক্তব্যে ও আলোচনায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়নি। আপনারা কি তাকে (শেখ মুজিব) পদত্যাগে বাধ্য করতে পারতেন না? তাকে হত্যা করার প্রয়োজন ছিল কি? ম্যাসকারেনহাসের এ প্রশ্নের জবাবে মেজর রশীদ বলে, ‘শেখ মুজিব শাসনের কিছুই জানতেন না। শুধু একটা ভালো গুণ তার ছিল, তিনি জনগণকে উত্তেজিত (সংগঠিত) করতে পারতেন। কাজেই তিনি বেঁচে থাকলে সমস্যার সমাধান করা আমাদের পক্ষে কঠিন হতো। কারণ, তিনি রাজনীতির ব্যাপারে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ছিলেন। ম্যাসকারেনহাস প্রশ্ন করেন, কাজেই তাকে হত্যা করতে আপনারা বাধ্য হন…উত্তরে রশীদ বলে, হ্যাঁ, আমাকে তা-ই করতে হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পর এই খুনি চক্র খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বসান। এই খুনি চক্র যে আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সঙ্গে চক্রান্ত করছিল সে কথাও তারা স্বীকার করে। মেজর রশীদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই দেখা করে। তখন খন্দকার মোশতাককে রশীদ আভাসে জানায় যে, শেখ মুজিব ও তার সরকারকে বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে এবং এর ফলে মুজিব নিহত হতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে রশীদ খোলাখুলি তুলে ধরে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার কী কী কথা হয়েছিল।
রশীদ বলেন, মোশতাককে আমি প্রশ্ন করি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এদেশ কি উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারে? উত্তরে মোশতাক বলে, এর কোনো সম্ভাবনা নেই। এক পর্যায়ে খন্দকার মোশতাক বলে, কারো যদি সাহস থাকে, তাহলে ভবিষ্যত্ নেতার জন্য (শেখ মুজিবকে অপসারণের পর যিনি নেতা হবেন) তা ভালোই হবে।
তবে মেজর রশীদ জানান, ১৫ আগস্টেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে—এটা মোশতাককে জানাইনি। আমরা শঙ্কিত ছিলাম যদি এটা তিনি শেখ মুজিবের কাছে ফাঁস করে দিয়ে তার আস্থাভাজন হতে চান? কিন্তু খন্দকার মোশতাক তা করেননি। যদিও সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি জানতেন যে বঙ্গবন্ধুকে যে কোনো সময় হত্যা করা হতে পারে।