৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, রবিবার

অর্থনীতির বাইরে চলে যাচ্ছে ছাগলের চামড়ার দাম

Advertisement

বাজারে ছাগলের মাংস সবচেয়ে দামি হলেও কোরবানির এই পশুর চামড়া মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। জাপানসহ বেশ কিছু দেশে ছাগলের চামড়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকলেও অযত্নে-অবহেলায় সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে কম দামে গরুর চামড়া বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়া একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না। এবার কোরবানিতে বাধ্য হয়ে কেউ ছাগলের চামড়া মাটিতে পুঁতেছে, কেউ বা ফেলে দিয়েছে নদীতে।

দাম না থাকায় বিনা মূল্যে পাইকারদের কাছে ফেলে রেখে গেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ছাগলের চামড়া কেনাবেচায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে দাম বেঁধে দিয়েছিল, তা-ও কেউ মানেনি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার দেশে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে ছাগল ও ভেড়া কোরবানি হয়েছে ৪২ লাখ ২০ হাজার ৮২০টি। তবে কতগুলো ভেড়া, তা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়নি।

সাধারণত বড় আকারের একটি খাসির চামড়া পাঁচ বর্গফুট হয়। সেই হিসাবে লবণযুক্ত একটি চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১২০ টাকা। কোরবানি দেওয়া ৪২ লাখ ২০ হাজার ৮২০টি ছাগল ও ভেড়ার চামড়ার দাম প্রতিটি ১২০ টাকা করে ধরলে ৫০ কোটি টাকার বেশি হয়। কিন্তু চামড়া যথাযথভাবে বিক্রি না হওয়ায় এই অর্থের বড় অংশই কোরবানির অর্থনীতির বাইরে থেকে গেছে।

এবার সরকারের পক্ষ থেকে গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে বাড়িয়ে ৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৪৪ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৫ থেকে ১৭ টাকা। পাশাপাশি বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা, গত বছর যা একই ছিল।

ব্যবসায়ীদের দাবি, আকারে ছোট এবং সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে চামড়াপ্রতি খরচ বেশি হওয়ায় ছাগলের চামড়া নিতে আগ্রহ নেই আড়তদারদের। ছাগলের চামড়া না নেওয়ার কারণ হিসেবে আড়তদাররা বলছেন, ছাগলের একটি চামড়া সংরক্ষণের পেছনে তিন কেজি লবণ প্রয়োজন। এতে খরচ হচ্ছে ৩০ টাকা। এর সঙ্গে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে মোট ৬০ টাকা খরচ হয়। সে হিসাবে ছাগলের চামড়ায় সরকার নির্ধারিত পরিমাপে খরচ বেশি পড়ে যায়। তাই ছাগলের চামড়া নিতে চান না তাঁরা।

পোস্তার আড়তদার শফিকুর রহমান জানান, একজন বিক্রেতা গরুর চামড়ার সঙ্গে চার পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে এসেছেন। তাঁরা ওই ছাগলের চামড়া কিনতে অপারগতা জানান। এরপর বিক্রেতা ওই চামড়া রেখে যেতে চান এবং অন্তত ১০ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। পরে ১০ টাকা নিয়েই চারটি চামড়া রেখে যান তিনি।

কেন এই অবস্থা জানতে চাইলে বেঙ্গল লেদার কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে গরুর চামড়ার চাহিদা থাকলেও ছাগলের চামড়ার চাহিদা নেই। আমাদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় চামড়ার কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছি না। সিইটিপি সমস্যার কার্যকর সমাধানও পাচ্ছি না আমরা। ’

বিশ্ববাজারে ছাগলের চামড়ার চাহিদা কেমন, জানতে চাইলে টিপু সুলতান বলেন, ‘ছাগলের চামড়ার সবচেয়ে ভালো বাজার জাপান। দেশটির বয়স্ক নাগরিকরা ছাগলের চামড়ার পাদুকা পছন্দ করেন। কিন্তু এই বাজার ধরতে খুব বেশি উদ্যোগ নেই। ’

কোরবানির ছাগলের চামড়ার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে :

বরিশাল : বরিশাল নগরীর চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের পাইকারি বাজার পদ্মাবতীসহ বিভিন্ন এলাকায় ছাগলের চামড়া বিক্রি হতে দেখা যায়নি। বেশির ভাগ কোরবানিদাতা পশুর চামড়া বিনা মূল্যে মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করেছেন।

বিক্রি করতে না পেরে ছাগলের চামড়া নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন চরকাউয়া এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন। তিনি বলেন, কোরবানিদাতারা বলছেন, কয়েক বছর আগেও ছাগলের চামড়া বিক্রি হতো ২০০ থেকে ৭০০ টাকায়। কিন্তু এখন আর দাম নেই। আড়তদাররা গরুর চামড়া রাখলেও ছাগলের চামড়া ফেরত দিয়েছেন। তাই বাড়ি গিয়ে মাটিচাপা দেব।

ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কারণেই গত কয়েক বছর ধরে ছাগলের চামড়া কেউ নিচ্ছে না। ট্যানারি মালিকরা নিলে এবং ন্যায্য মূল্য দিলে আমাদের ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করতে সমস্যা নেই। ’

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহে খাসির চামড়া অনেকে ফেলে দিয়েছেন। কেউ বা মাদরাসায় দান করেছেন। কোরবানিদাতা রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘দুটি খাসি কোরবানি দিয়েছিলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ দামই করেনি। ’

দিনাজপুর : দিনাজপুরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানির ছাগলের চামড়া সংগ্রহের পর বিক্রি করতে না পেরে আড়তে ফেলে আসা কিংবা পৌরসভার বর্জ্যবাহী গাড়িতে ফেলে দিয়েছেন।

দিনাজপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র তৈয়ব আলী দুলাল জানান, তাঁদের বর্জ্যবাহী গাড়ি সোমবার সকালে রামনগর চামড়াবাজার থেকে ছাগলের শত শত চামড়া তুলে নিয়ে পৌরসভার ডাম্পিংয়ে ফেলে দেয়।

কাওগাঁ এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সোলায়মান ও বিরল উপজেলার হুসেন আলী জানান, অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ছাগলের চামড়া বিক্রিই করতে পারেননি। রামনগর চামড়া বাজারে ছাগলের শত শত চামড়া ফেলে রেখে চলে গেছেন তাঁরা। কারণ চামড়া ফেরত নিয়ে গেলে বাড়তি খরচ তাঁদেরই করতে হবে। আবার তা মাটিতে পুঁতে ফেলার কষ্ট করতে হবে।

বগুড়া : বগুড়ার অনেক জায়গায় ছাগলের চামড়া কেনা হয়নি। লোকজন সেসব নর্দমা ও রাস্তার পাশে ফেলে গেছে। আবার কিছু এলাকার চামড়া পাশের জেলার ব্যবসায়ীরা কিনেছেন। শহরের চামড়ার বাজার চকসূত্রাপুর ও বাদুড়তলা এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার অবিক্রীত অনেক ছাগলের চামড়া ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা ফেলে দিয়েছেন।

বাগেরহাট : বাগেরহাটেও কোরবানির ছাগলের চামড়া ব্যবসায়ীরা কেনেননি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ অনেক বেশি হওয়ায় সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যে চামড়া ক্রয় করা সম্ভব নয়।

বাগেরহাট শহরের চমড়া ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম খান জানান, ছাগলের ছামড়ার চাহিদা না থাকায় কেনেননি। অনেকে ছাগলের চামড়া ফেলে রেখে গেছে।

ব্যবসায়ী নেতারা যা বলছেন

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের বেশির ভাগ ট্যানারি মালিক গরুর চামড়া নিয়ে কাজ করেন। ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়ার পদ্ধতি আলাদা। হাজারীবাগে ২০ থেকে ৩০টির মতো কারখানা ছিল, যারা শুধু ছাগলের চামড়া নিয়ে কাজ করত। কিন্তু সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে পুঁজি ও জায়গার সংকটে সেখানে মাত্র ছয় থেকে সাতটি কারখানা স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলো সক্ষমতার অভাবে স্থানান্তরিত হতে পারেনি। তাদের সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ’

তিনি বলেন, ‘ট্যানারি স্থানান্তরের পর থেকেই ছাগলের চামড়ার এই অবস্থা চলছে। আগে ছাগলের চামড়া আসত এবং ভালো দাম ছিল। কিন্তু এখন ইন্ডাস্ট্রিগুলো না থাকা একটি বড় সমস্যা। যারা আছে তারাও বিনিয়োগ করে টিকে থাকতে পারছে না, যার কারণে সবাই ছাগলের চামড়ায় নিরুৎসাহ হচ্ছে। ’

তিনি বলেন, ‘সাভারে আমাদের ছয় থেকে সাতটি ইন্ডাস্ট্রি আছে, যারা ছাগল ও খাসির চামড়া প্রসেস করে। এটার একটা বিরূপ প্রভাব কয়েক বছর ধরে পড়েছে। এ ছাড়া ছাগলের চামড়ার চাহিদা বিশ্বব্যাপী কমেছে। ’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০.৭৭ শতাংশ বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০৩ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement