২৯ মার্চ, ২০২৪, শুক্রবার

আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের বিতর্ক

Advertisement

‘অসম’ চুক্তির শর্ত নিয়ে গোপনীয়তা, কয়লার মান ও দামের সীমা নিয়ে ধোঁয়াশা, উৎপাদন খরচের হার, ক্যাপাসিটি চার্জ এবং ঝুঁকির দায়ের শর্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানির যে চুক্তি করেছে, তার কঠোর সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি খাত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা কয়েক জন বিশ্লেষক ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, চুক্তি দেখে তাদের মনে হয়েছে ‘বাংলাদেশকে ধরেবেঁধে’ রাজি করানো হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ সাড়া দেননি।

চুক্তিটি হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দেশটির ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে কোম্পানিটি। বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়েছে এই মার্চে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরের জন্য কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনবে।

২০১৭-২০২৩ দীর্ঘ এই সময়ে চুক্তির বিষয়ে তেমন কিছুই জানা যায়নি। এর ভেতর গত ৯ ডিসেম্বর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একটি খবরে বলা হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কেনার যে চুক্তি করেছে তাতে প্রতিবেশী দেশটির তুলনামূলক বেশি খরচ পড়বে। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গণমাধ্যমটি ১৬৩টি পাতার ‘গোপন চুক্তিপত্র’ দেখতে পেয়েছে। এরপর গত ৭ ফেব্রুয়ারি আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানির সঙ্গে করা চুক্তিতে বাংলাদেশ নতুন শর্ত যোগ করতে চেয়ে কোম্পানিটিকে একটি চিঠি দিয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ‘৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ডের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে আদানি গ্রুপ জানায়, বাংলাদেশ ডিসকাউন্ট বিবেচনার জন্য আমাদের অনুরোধ করেছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রয়চুক্তির শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা করতে চায় না কোম্পানিটি।

ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে প্রশ্ন

চুক্তির ধারা ৩.১(বি) অনুসারে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪ শতাংশের চেয়ে কম বিদ্যুৎ কিনলে পিডিবিকে নির্দিষ্ট অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে। এ ছাড়া উৎপাদন না করলেও বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হবে সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।

এই শর্ত দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘৩৪ শতাংশের বিষয়টি অসম। পুরো বিষয়টি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশকে ধরেবেঁধে চুক্তি করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে এসে বাংলাদেশ যদি মনে করে আমি কিনব না, তাহলে সেটি অসম্ভব। কারণ চুক্তিতে এই অপশন নেই। কিনতেই হবে। অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক কারণে কোনো বৈরিতা সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে আসতে পারবে না।’

কয়লার মূল্য

বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে কয়লা ব্যবহার হবে, তার দাম নির্ধারণ নিয়ে চুক্তিতে যা বলা হয়েছে, তাকে ‘বিস্ময়কর’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আদানি গ্রুপ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করেছে, রামপাল এবং পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই শর্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও খনিজসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ম. তামিম সন্দেহ প্রকাশ করে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই চুক্তির সঠিক খরচের বিষয়ে কেউ তথ্য দিচ্ছেন না। তথ্য গোপনের এই প্রবণতা সন্দেহ সৃষ্টি করছে।’

ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, অস্বাভাবিক শর্তগুলোর মধ্যে কয়লার দামের কোনো সীমা উল্লেখ করা হয়নি। তার অর্থ হলো- বিদেশে অবস্থিত আদানির নিজস্ব যে কয়লাখনি আছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সেখান থেকে তারা ভারতে কয়লা আনবে। এজন্য তারা নিজেদের শিপিং নেটওয়ার্ক এবং কয়লা-হ্যান্ডলিং পোর্ট ব্যবহার করবে। এতে বাংলাদেশের হাতে তারা বেশি দামের তালিকা ধরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে।

বদরূল ইমাম দিলেন আরেক তথ্য, ‘ইন্দোনেশিয়া কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় আদানির যে কোলমাইন এবং পরিবহনের লজিস্টিক আছে, সেগুলো এতদিন বসে ছিল। আদানির কয়লা কেউ কিনছিল না। এখন যে কোল প্ল্যান্ট চালু করা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের ঘাড়ে হাত দিয়ে। বিষয়টা তো এমন না যে পৃথিবীতে আদানি ছাড়া কেউ কয়লা উৎপাদন করে না। আদানি তাদের স্বার্থেই খনিটা চালু করল।’

খরচের বিষয়ে বদরূল ইমাম বলেন, ‘এখানে সমস্যা হলো উৎপাদনের বিষয়টি আপনার হাতে নেই। কারণ এমন একটা জায়গায় প্ল্যান্টটা বসানো হয়েছে, যেখানে গিয়ে পরীক্ষা করতে পারছেন না। কী কয়লা তারা ব্যবহার করছে, কোন কোয়ালিটির কয়লা, ভ্যালু কেমন, কী আর্দ্রতা আছে-এসব বাংলাদেশের অজানা থাকছে। বিদ্যুতের দাম নির্ভর করে কয়লার ওপরে। এখন আদানি নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করার সুযোগ পাবে। এখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আদানি অন্যায্যভাবে দাম বুঝিয়ে দিয়ে বলবে এই কয়লার মূল্য এমন। তখন সেটাই দিতে হবে। এতে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়বে।’

ঝুঁকির দায়

চুক্তি অনুযায়ী বেশির ভাগ শর্তের ঝুঁকির দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে বর্তাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ২৫ বছরের করের অর্থ বাংলাদেশকে বহন করতে হবে। অন্যদিকে গোড্ডা প্রকল্পটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ায় ভারতসরকারের থেকে কর ছাড় পেয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আগেভাগেই উল্লেখ থাকায় পুরো সময়েই করের অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে পরিশোধ করতে হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

তবে আদানি বিবৃতিতে বলেছে, ‘এখান থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী প্রযোজ্য কর, শুল্ক ও সেস দিতে হবে না।’

চুক্তি পর্যালোচনা করে সামগ্রিকভাবে বদরূল ইমাম বলছেন, ‘‘আমার মনে হয় চুক্তিটা আদানিকে ফেভার করতেই করা হয়েছে। চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের আচরণ আমার কাছে উইয়ার্ড লাগছে। সরকারে যারা আছেন, তারা কথা বলতে ডিনাই করছেন। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আদানিকে বাড়তি সুবিধা কেন দেওয়া হয়েছে তার কোনো যুক্তি তাদের (বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের) কাছে নেই। এটা কি কোনো গোপন চুক্তি যে ওনারা কোনো কথা বলতে পারবেন না? এটা তো কোনো মিলিটারি চুক্তি না। পাবলিক বিষয়।’’

বিপাকে আদানি গ্রুপ

যে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি করেছে তারা নিজেরাই এখন বিপাকে। ভারতে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া গ্রুপটির বিরুদ্ধে সম্প্রতি শেয়ার জালিয়াতি ও কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে। এরপর তারা গুজরাটে ৪.২ বিলিয়ন ডলারের একটি পেট্রোকেমিক্যাল প্রজেক্ট স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কোম্পানিটিকে উদ্ধৃত করে পিটিআইয়ের খবরে ১৯ মার্চ (রবিবার) বলা হয়েছে, ‘আদানি গ্রুপ জানিয়েছে গ্রাহক এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে তারপর ফের প্রজেক্টটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা হবে।’ 

গ্রুপটির সাথে বাংলাদেশ সরকারের যেভাবে চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে কংগ্রেস এমপি রাহুল গান্ধী পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন। ১৪ মার্চ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে রাহুল গান্ধী তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কংগ্রেস নেতার দাবি, আদানিকে আরো ধনী বানানোই সরকারের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফর থেকে বড় আকারে লাভবান হয়েছে আদানি গ্রুপ।’

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement