(চার)
একের পর এক বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ আর একেকটি বড় ডিলে যোগ দেয়ার মাত্র দু’মাসের মাথায়ই আলাউদ্দিন টি এস্টেট চা রপ্তানিতে দেশের শীর্ষ তিন কোম্পানিতে ঠাঁই করে নিল। মালিকপক্ষ যার পর নেই খুশি। দু’মাসেই বেতন বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হল, সেইসঙ্গে দ্বিগুন হল ব্যস্ততাও। প্রতিদিনই পলি, পল্লব বা ডা. পারমিতার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলেও একবারের জন্যও যেতে পারিনি হবিগঞ্জ।
এ নিয়ে পলির সঙ্গে তুমুল মনকষাকষিও চলেছে দিনের পর দিন। নেদারল্যা-স এর একদল বায়ারের সঙ্গে মিটিং সারতে সিলেট গেলেও হবিগঞ্জে ঢুঁ মারার অবকাশটুকু ছিলনা। এ নিয়ে পলির মন দেদার খারাপ। কথাই বলেনি প্রায় তিনদিন। কিছুতেই বোঝাতে পারছিনা ব্যস্ততার কথা।
আজ শুক্রবার। শুক্রবার একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করি বরাবরই। আজ যেন কী হল। সেই ভোরবেলাতেই জেগে বসে আছি। শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখছি। ছাদে দুটো টিকটিকি দীর্ঘ সময় ধরে মুখোমুখি রোমান্স করছে। একজন এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আরেকজনের মুখ। আবার পিছিয়ে যাচ্ছে দুজন। আবার এগিয়ে এসে একই ভঙিতে মুখ ঘসে দিচ্ছে মুখে। কত কী যে মনে আসছে, অবেলায় ঘুম ভেঙে। জানালা খোলা। শীতের দাপট কিছুটা কমেছে।
মিষ্টি রোদ জানালা গলে ঢুকে পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। ভাল লাগছে রোদের এই আদুরে স্পর্শ। আড়মোড়া ভাঙতেও ইচ্ছে করছেনা। খাইওনি সকাল থেকে কিছু। অলস অলস লাগে। এপাশ ওপাশ করছি অনবরত। ভাবছি ছোট্ট এই জীবনটার কথা। কোথা থেকে কী করে এই চা বাগানে এসে থিতু হলাম। কী করে পলির সঙ্গে পরিচয়। ডা. পারমিতার পরিবারই বা কেন এত আপন করে নিল।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। উপেনের গলা।
বাবু, বাবু। উঠেছেন।
এমন অসময়ে উপেন কখনো ডাকেনা। ব্যাপার কী! আজ এমনিতেই তো শুক্রবার। দরজা খুললাম। ক্যাঁক করে একটা শব্দ হল। হাসিমুখে দাঁড়ানো উপেন। হাতে নাশতার ট্রে।
প্রণাম বাবু। এখনো দেখি ওঠেননি।
হুম, উপেন। শুক্রবার তো।
বাবু জলদি নাস্তা সেরে নিন। বড় স্যার আসবেন।
এমপি সাহেব আসবেন!
জ্বি বাবু। সকালে ম্যানেজার বাবুকে ফোন করেছেন। উনি হঠাৎ করেই আসছেন এদিকটায়। ম্যানেজার বাবু আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
ওহ আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি খাবার টা রেখে যান। আমি আসছি।
উপেন চলে গেল। ঝটপট নাস্তা সেরে রেডি হলাম। পলিকে সকালে ফোন দেয়া হয়নি। ফোন দেয়ার কথা ছিল আমারই ঘুম থেকে উঠে। শুক্রবার একটু বেশি ঘুমাই বলে পলি ফোন করেনা সকালটায়। পাছে ঘুম ভেঙে যায়। আলসেমি করে আমারও দেয়া হল না। এখন দেয়ার সময়ও নেই তেমন। মাথায় চিরুনি বুলাতে বুলাতে টেক্সট মেসেজ লিখে ফেললাম একটা।
লাভ ইউ মাই ডিয়ারেষ্ট পলি। এ ভেরি গুড মরনিং। আই এম বিজি নাউ। টক ইউ ল্যাটার।
শুধু ওকে লিখেই জবাবটা ফিরে এল ঝড়ের গতিতে। এই ‘ওকে’ , ‘ ঠিক আছে’, ‘ঠিক আছি’ ‘আচ্ছা’ ‘ সমস্যা নেই’ – শব্দগুলো কী মিনিং ক্রিয়েট করে, এর ভাবার্থ কী খুব ভাল করেই বুঝে গেছি এই কটা দিনে। মুখ না দেখেও টেক্সট মেসেজ দেখলেই চট করে মুড বোঝা যায় দুজনের বোঝাপড়া থাকলে। পলি এখন এংগরি মুডে আছে। এংগরি উইথ টাচিনেস মুডে আছে। গোলাপী গাল লাল হয়ে গেছে নিশ্চই এতক্ষণে। ফোনটা আছাড় মেরে রেখে দিয়েছে বিছানায়। এখন আর ফোন করবে না। ফোন করলেও কথা বলবে ছেড়ে ছেড়ে। এটা তো নৈমত্তিক ব্যাপার। এমন মান অভিমান না থাকলে কী ভালবাসা হয়! যাকে বেশি ভালবাসা যায়, তার সাথে অভিমান না করলে কী চলে!
দরজা লাগালাম। বিশ্রী একটা শব্দ কব্জায়। ক্যাঁ…আ…ক। নারিকেল তেল দিতে হবে কব্জা দুটোয়। বিশ্রী শব্দটা মাথায় গিয়ে লাগে। হনহন করে হেঁটে চলে গেলাম টিলার ওপর। অফিসঘরে গমগম করছে লোকজন। টি এস্টেটের মালিক আলাউদ্দিন চৌধুরীর ঘর ঝাড়পোছ করা হচ্ছে। উপেন গিয়ে কিছুক্ষণ পর পর এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে আসছে। আবার গিয়ে ঘরের গন্ধ শুঁকে দেখছে, কোথাও বাসি বাসি বা বদ্ধ গন্ধ রয়ে গেল কি না। মালি রঞ্জন কোথা থেকে হরেক বুনো ফুল আর এক গাদা শাদা গোলাপ এনে পরিপাটি করে সাজিয়েছে ঘরটা। ম্যানেজার সেলিম চৌধুরীর দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ার মত।
শ্রমিক কলোনী থেকে গায়েন দল আর ঢুলি বাইরে অপেক্ষা করছে মাথায় গামছা বেঁধে। সবার চেহারায় রাজস্থানী ভাব। যেন পাতৌদির জমিদারের উঠোনে কোন উৎসবের আয়োজন। আমি যোগ দেয়ার পর আলাউদ্দিন চৌধুরী আসেননি। তিনি আসেন বছরে দু’তিনবার। এবার তার আসাটা অন্যরকম। আমেরিকার নেভাদা থেকে তার মেয়ে অবনী আসছে। অবনী নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাজুয়েশন করছে। সেই ছোটবেলায় একবার এসেছিল অবনী। লাল টুকটুকে ফ্রক পরে পরীর সাজে নেচে বেড়িয়েছিল ক’টা দিন।
অবনীর মা নেই। ভাই বোনও নেই। একা অবনী। আলাউদ্দিন চৌধুরীও ব্যস্ত। সময় দিতে পারেনা বলে অবনীর অনেক ক্ষোভ- অভিমান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপেন একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল অবনীকে নিয়ে। উপেনের ভাষায় অবনী যেন সাক্ষাত পরী। খুভ ভাল মেয়ে। অনেক বছর পরে চা বাগানে আসছে। এখানে ভিআইপি ভিলায় থাকবে ক’টা দিন। অবনীকে ঘিরেই তাই এত আয়োজন।
হৈ হৈ করতে করতে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার আবদুল করিম টিলায় উঠলেন। তার পেছনে একটা রিকশা ভ্যান ঠেলে উঠাচ্ছে কিছু শ্রমিক। ভ্যানের ওপর তিনটি বড় ড্রাম রাখা। ভ্যান এনে রাখা হল অফিসের সামনে। দুজন মানুষ পালা করে ভ্যানে উঠে ড্রামের পানি নাড়াচাড়া করছে। দু’পাটি দাঁত বের করে এগিয়ে এলেন করিম সাহেব। সেলিম চৌধুরীকে টেনে নিয়ে গেলেন ভ্যানের কাছে।
এক্কেবারে তাজা মাছ স্যার। বিলের মাছ। বিলে জাল টেনে বাইছ্যা আনছি।
ভেরি গুড। কী মাছ আনলেন। মরে ভেসে উঠলে কিন্তু আপনার চাকরি নট।
মরার চান্স পাইবো না স্যার। দুইজন লোক হায়ার করছি। বদ্ধ পানিতে মাছের অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। তারা দুইজন পানি নেড়ে অক্সিজেন সাপ্লাই করতে থাকবো। আপনি বললে- মৌলভীবাজার থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনাই স্যার। পাইপে করে ড্রামে অক্সিজেন দেয়া হবে। সাতদিন দশদিন অক্সিজেন খাইয়া খাইয়া ভুস কইরা উপরে মাথা উঁকি দিয়া চা বাগান দেইখ্যা যাইবো মাছ। হে হে হে।
আপনি থামেন। কী মাছ আনছেন।
স্যার, একটার মধ্যে বড় রুই কাতলা। একটার মধ্যে শিং মাগুর কই। এক্কেবারে দেশি স্যার। আরেকটার মধ্যে সাত পদের ছোট মাছ স্যার।
সেলিম চৌধুরীর বিশ্বাস হল কী না জানিনা। ভ্যানে লাফিয়ে উঠে ড্রামে মুখ লাগিয়ে পরখ করে নিলেন। শ্রমিক সর্দার মোহন্ত ছররা বন্দুক নিয়ে বসে আছে বারান্দায়। ব্যারেল খুলে গান অয়েল লাগিয়ে ঝেড়ে মুছে চকচকে বানাচ্ছে। অবনী এখানে এসে কখন কী চাইবে তার সব আগে থেকেই রেডি। আলাউদ্দিন চৌধুরী গাড়ি নিয়ে আসবেন।
কিন্তু অবনীর ব্যবহারের জন্য সেই সাতসকালে একটা চকচকে ল্যা-রোভার রাখা হয়েছে ভিআইপি ভিলার সামনে। পুরো চা বাগান জুড়ে উৎসবের আমেজ।
রুমে গিয়ে বসলাম। পলিকে ফোন দেয়া উচিৎ। উপেন আসলো চা নিয়ে। টেবিল আলমিরা ঝাড়পোছ শুরু করলো।
বাবু। বড় লোকদের অনেক দেমাগ থাকে।
হুম। কেন!
বড় বাবু মেয়ে বিদেশ থাকেন। অনেক পড়াশোনা। অনেক বন্ধু বান্ধব। আধুনিক দেশ।
হুম, বুঝেছি।
শুনছি ওনার দেমাগ নাই। উনি মাটির মানুষ।
শুনছেন। দেখেন তো নাই।
জ্বি না বাবু। ছোটবেলায় দেখছি। সাক্ষাত পরী।
হুম। ভাল তো, এবার বড় বেলাটা দেখবেন।
ম্যানেজার বাবু আমাকে বলছেন তার দেখভাল করতে।
গুড, তাহলে আমার খাবার দেবে কে এই কটা দিন। নাকি বাইরে খেয়ে নেব!
না না বাবু। আমি আমার ছেলে হরেনকে বলে রাখছি।
আচ্ছা ঠিক আছে। না হলে কিন্তু রান্না করে খেতে পারব। কোন সমস্যা নাই।
না না বাবু।
পলিকে কল দিতে ফোন হাতে নিলাম। হঠাৎ ম্যানেজার আর অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার কানে ফোন লাগিয়ে ছুটে গেল বাইরে। উপেনও আমাকে টেনে বের করল ঘর থেকে। ঢাকের শব্দ হচ্ছে। চা বাগানের নারী শ্রমিকরা ঝুড়ি থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করছে। সামনে আলাউদ্দিন চৌধুরী। পেছনে অবনী। গোলাপী স্যালোয়ার কামিজ। উচ্চতা অন্তত পাঁচফুট ছয়। মাথায় সুন্দর করে খোঁপা বাঁধা। খোঁপায় কয়েকটা তাজা গোলাপ।
এ আসলেই সাক্ষাত পরী। ঝকমকে দাঁত বের করে হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ করছে সবাইকে। মুখ হাসি হাসি করে আমিও হাত নাড়ালাম। ম্যানেজার, অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার ছুটে গেল আলাউদ্দিন চৌধুরীর সামনে। করমর্দন করলেন। আমার সামনে এসে থেমে গেল ওরা দুজন। ম্যানেজার দুপাটি দাঁত বের করে হাত ঘষে দাঁড়াল সামনে।
স্যার। ওর নাম সাগর। সেলস অফিসার পদে নতুন জয়েন করেছে।
ওহ, আই সি। তুমি সাগর। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। বায়াররা তোমার উপর ভেরি মাচ প্লিজড। বলতে পার আমিও। ওহ- সাগর, আমার মেয়ে অবনী।
স্লামালেকুম।
হাই।
পাশ্চাত্য কায়দায় মুখ হাসি হাসি করে মাথাটা একটু নুয়ে হাতের চার আঙুল দিয়ে ছোট্ট একটা হাই দিল অবনী। আঙুলগুলো একঝলক দেখলাম। মখমলের মত তুলতুলে, দু আঙুলে ঝকমক করছে হীরের আঙটি। আর কোন কথা হল না। গটগট করে চলে গেল অফিস ঘরে। বাইরে কমে এল ঢাক আর সানাইয়ের আওয়াজ।
ঘন্টাখানেক পর ডাক পড়ল। আলাউদ্দিন টি এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের রুমে মানুষ চারজন। অবনী মুখ হাসি হাসি করে বসে আছে এমডির চেয়ারে। তার বাবা পাশে আরেকটি চেয়ারে বসে ফাইল ঘাটছেন। সামনের তিনটি চেয়ারের একটি খালি। সালাম দিয়ে রুমে ঢুকতেই অহনা উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল।
কংগ্রাচুলেশন মিষ্টার সাগর।
ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস ম্যাডাম। কিন্তু কেন এই অভিনন্দন।
বসুন সাগর সাহেব। আমাকে ম্যাডাম বলার কোন মানে নেই। আমার বাবা আপনাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমি কিন্তু বলতে গেলে কাগজে কলমে কেউ না। আর আমি পার্সোনালি বসিং সিস্টেমটা একদম লাইক করিনা।
জ্বি, ম্যাডাম।
আবার ম্যাডাম!!
হো হো করে হেসে উঠল অবনী। রুমের অন্যদের মধ্যেও হাসির রোল পড়ল। কিছুটা লজ্জা পেলাম।
শুনুন সাগর সাহেব। আমি আপনার বিষয়ে সব জানি। আলাউদ্দিন টি এস্টেট সঠিক মার্কেটিং পলিসি ও যোগাযোগের অভাবে রুগ্ন হয়ে যাচ্ছিল। আপনি যোগ দেয়ার দু’মাসের মাথায় আমাদের কোম্পানি এখন বেশ সচল। বাইরে থেকে নতুন নতুন বায়াররাও আগ্রহ দেখাচ্ছে। সবই আপনার অবদান।
এটা আমার দায়িত্ব।
হুম, আর তাইতো দায়িত্ব আরও সঠিকভাবে পালন করার জন্য আপনার প্রমোশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর শুনুন আপনি আগামী সপ্তাহে শ্রীলংকা যাচ্ছেন। ক্যান্ডিতে আমাদের যে প্রজেক্টটা আছে, ওটার মার্কেটিং পলিসি নিয়ে ওখানকার অফিসারদের সঙ্গে বসে প্ল্যান করবেন। এই খামে সব ব্যবস্থা করে দেয়া আছে। আর ম্যানেজার সাহেব আপনার যাবার সব বন্দোবস্ত করে দেবেন।
থ্যাংক ইউ সো মাচ।
আলাউদ্দিন চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। বসে খামটা খুললাম সবার সামনে। সেলস অফিসার থেকে এক লাফে মার্কেটিং ম্যানেজার পদে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। বেতন দেড় লাখ টাকা। আর শ্রীলংকায় যাবার যে প্রপোজাল লেটার তাতে ছয়মাসের জন্য শ্রীলংকা পোস্টিং, খাবার, প্লেন ফেয়ার, থাকা আনুসাঙ্গিক মিলিয়ে মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা বেতন ধরা হয়েছে।
বোকা হয়ে গেছি চিঠিটা পড়ে। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিনা। টানাটানির সংসারে একটা চাকুরিই বেশি ছিল, এত কিছু তো আশা করিনি। মাকে খবরটা জানানো দরকার। পলিও অপেক্ষা করে আছে ফোনের। কতক্ষণে এই ঘর থেকে বের হব তাই ভাবছি। চেয়ার ঘুরিয়ে মুখোমুখি হলেন আলাউদ্দিন চৌধুরী।
সাগর, অবনী এখানে সাতদিন থাকবে। ওর ইউনিভার্সিটির একটা রিসার্চ ওযার্ক করতে বেসিক্যালি এখানে আসছে। আপনার তো শ্রীলংকা যাবার দেরি আছে পনের দিন। আপনি অহনাকে সময় দেবেন। সহায়তা করবেন। দেখভাল করবেন।
জ্বি। অবশ্যই করব।
অহনা আপনার সঙ্গে প্রোগ্রাম সেট করে নেবে।
জ্বি স্যার।
ঘুরে তাকালাম অবনীর দিকে। বাইরে লোকজনের ভিড়ে একঝলক দেখেছিলাম। এবার তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখ সরিয়ে নিলাম। ড্যাবড্যাব করে অদ্ভুত সুন্দর চোখে তাকিয়ে রইল অবনী। মুখে সারাক্ষণ একটা হাসির রেখা ঝুলে থাকে। বাইরে উপেন বলছিল বড় বাবুর মেয়ে অবনী- সাক্ষাত পরী। কথাটা কানে ঘুরতে থাকল। আসলেই পরীর মত সুন্দর অবনী। এমন সুন্দর মেয়ে খুব কম দেখা যায় আশপাশে। আসলে দেখারও অধিক কিছু অদেখাই থেকে যায়।
মানুষ আইসবার্গের মত। যতটুকু সে দেখায়, ততটুকুই অন্যরা দেখে। অদেখা অংশটুকু থেকে যায় তার ভেতরেই। অদেখা অংশটুকু থেকে যায় রহস্যময়, অন্ধকারাচ্ছন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদেখা অংশটুকুই মানুষের জীবনের দেখা অংশের চেয়ে বড়। মানুষের জীবন যদি আইসবার্গ হয়, সময় হল সাগর। জীবন সাগরে ভাসতে ভাসতে হয়ত কখনো কোন উষ্ণ ছোঁয়ায় ভেতরের জমাট সে বরফটুকুও আলগা করে দেয় দেখার জন্য। কিন্তু সেই উষ্ণতা দেয়ার মত মানুষের সংখ্যা, তেমন বোঝাপড়া তৈরি করার মত আপনার চেয়েও আপনের সংখ্যা হাতে গোনা।
মানুষ হয়ত একজীবনে এক-দুজন এমন আপনার চেয়ে আপন পেয়ে থাকে। অনেকে সেই অদেখা রহস্যময় ভূবন বয়ে চলে নিজের ভেতরেই। সে ভূবনের সন্ধান কেউ কখনো পায়না। অবনীর আইসবার্গের ভেতরটাও হয়ত তেমন রহস্যময়, অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেখানে প্রবেশাধিকার রয়েছে শুধু তার নিজেরই।
সাগর সাহেব আপনার নাম্বারটা দিন।
আচমকা রিনরিনে গলায় বলে উঠল অবনী। নাম্বার দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
আমার নাম্বার নেবেন না? শুধু কী আমি ফোন করব?
জ্বি নেব। জ্বি দরকার হলে অবশ্যই ফোন দিব।
টুকরো একটা স্লিপে গোটা গোটা অক্ষরে নিজের পুরো নাম আর ফোন নাম্বার লিখল অবনী। হাত বাড়িয়ে নিয়ে পকেটে পুরে রাখলাম।
এখন তো বারটা বাজে। সাড়ে তিনটায় আমরা বেরুব। এবার আপনি আসতে পারেন। ঠিক তিনটা কুড়ি মিনিটে ভিআইপি ভিলায় চলে আসবেন।
জ্বি। আসব।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। টিলা থেকে নেমেই মাকে ফোন দিলাম। ছয়মাসের জন্য শ্রীলংকা যাব শুনে মা ফিচ করে কেঁদে দিল। আড়াই লাখ টাকা বেতনও তুচ্ছ মায়ের কাছে। ছেলের সঙ্গই যে বহু মূল্যবান। পাশে থেকে বাবার গলা শুনতে পেলাম। ছুটে এসে ফোন হাতে নিল।
হ্যালো সাগর। খুব খুশির খবর রে।
হুম বাবা। মালিকপক্ষ আমার কাজে সন্তুষ্ট।
হবে না! কার ছেলে দেখতে হবে তো। আমার বিশ্বাস ছিল তুই লাইফে ভাল কিছু করবি। আচ্ছা শোন কবে যেতে হবে তোকে।
বলল তো পনের দিন পর। এখনো ঠিক হয়নি দিন তারিখ।
হুম, বুঝেছি। শোন শ্রীলংকা যাবার আগে বাসায় ক’টা দিন থেকে যাস।
আসব বাবা। রাখি এখন। পরে আবার কথা বলবো।
আচ্ছা বাবা। ভাল থাকিস। এই শোন শোন তোর মা আরেকটু কথা বলবে।
ফোন হস্তান্তরের পর ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না। আচ্ছা বাঙালি মায়েরা কেন এমন হয়! ছেলেদের যেন বড় হতে নেই! কাজে যেতে নেই। সারাক্ষণ খালি আচলের নিচে লুকিয়ে রাখার বাহানা।
মার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নিজের ঘরে ফিরে এলাম। বিছানায় আধাশোয়া হয়ে ফোন দিলাম পলিকে। প্রথমবার রিং হলেও ধরেনি। দ্বিতীয় কলে ফোন রিসিভ করলেও কোন সাড়া শব্দ নেই।
হ্যালো, পলি। শুনছ।
কোন শব্দ নেই। ফুলে আছে নিশ্চিত। মান ভাঙাতে হবে। মেয়েরা অনেক সময় ইচ্ছে করেই ফুলে থাকে, যাতে মান ভাঙানোর কসরত করতে হয়। এটাতে তাদের মানসিক তৃপ্তি আসে, ভালবাসাও মজবুত হয়- মান অভিমানের খেলায়।
হ্যালো পলি.. শুনছো। হ্যালো… কথা বল। আরে বাবা সরি বলছি তো। হঠাৎ করে এমডি স্যার আর তার মেয়ে চলে আসছে বাগানে। শুনছো?
খানিক চুপ থেকে মুখ খুলল পলি। গলা ঝাঁঝালো।
ওহ, বুঝেছি। এমডি সাহেবের মেয়ে বুঝি খুব সুন্দরী।
ধুর, তা হতে যাবে কেন! তার মত কদাকার, কুৎসিৎ প্রাণী দুনিয়ায় আর আরেকটি দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
ওহ আচ্ছা। তেল মারা হচ্ছে তাইনা! একজনকে তেল মারতে গিয়ে আরেকজনকে কদাকার, কুৎসিৎ এসব বলা যে অন্যায় তা কী ভুলে গেছেন।
আরে বাবা, ছাড় না এবারের মত। হল তো। শোন একটা ইমপরট্যান্ট খবর আছে।
কী! বিয়ে করছেন বুঝি শিগগির।
হুম, করবোই তো। শিগগির বিয়ে করব। তার কনেও তো রেডি। ফোনের ওপাশে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
থাক আর ঢং করা লাগবে না। এমডির মেয়েকে নিয়েই থাকেন।
শোন পলি, একটা ইমপরট্যান্ট খবর আছে।
বলেন শুনি, কী এমন ইমপরট্যান্ট খবর।
আমার প্রমোশন হয়েছে। দেড় লাখ টাকা বেতন। মার্কেটিং ম্যানেজার পোষ্ট।
ওয়াও… কনগ্রাচুলেশনস।
ফোনের ইয়ারপিসে চপ চপ করে টানা কিছুক্ষণ শব্দ, চুমু দিয়েই যাচ্ছে একনাগাড়ে।
শোন, আরেকটা খবর আছে।
কী খবর!!
আমাকে ছয়মাসের জন্য শ্রীলংকা যেতে হচ্ছে। ওখানে বেতন আড়াই লাখ টাকা।
দমকা বাতাসে ফুলে ফেপে ওঠা আগুনের শিখা যেন নিভে গেল দপ করে।
মানে কী! ছয়য়য়য়য়য়য় মাসসস। নো। যেতে হবেনা কোথাও।
পাগলি। না গেলে কী চলবে বল! চাকুরি করে খেতে হবে না।
যান, আপনার সাথে কোন কথা নেই। আড়াই মাস হতে চললো আপনি কুলাউড়া। একটা দিন সময় করতে পারলেন না। কচুর ভালবাসা। কচুর প্রেম।
শোন পলি, রাগ করনা প্লিজ। অদেখা তোমাকে নিয়েই তো কত স্বপ্ন আঁকি। মুহুর্তগুলোকে সাজিয়ে নেই মনের রঙতুলি দিয়ে।
অদেখা হব কেন! আমাকে দেখেননি বুঝি!
সেই এক পলকের দেখা! ভাল করে তাকাতেও পারিনি তোমার দিকে। পাছে কিছু ভাবো। সংশয়। নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। এখন বড্ড আফসোস হয় জানো, সেদিন যদি আরেকটু মন ভরে দেখতে পারতাম।
সেদিন মন ভরে দেখলে কী তবে দেখার ইচ্ছে উবে যেত?
আরে না, কী যে বল! একজীবন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও দেখার সাধ মিটবে না।
ইশশশ…. আসছে একজন। একবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক কবি। আপনার সাথে কথা বলবো না, যান।
রাগ করনা প্লিজ।
রাগ করব না তো কী করব। মা আপনাকে আসার জন্য সেই কবে থেকে বলছে। আপনি আসছেন একটা দিন? মানুষ প্রেম করে লুকিয়ে, আড়ালে আবডালে। আমার মা নিজে থেকে আমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে আপনার দাম বেড়ে গেছে তাই না!
তা হবে কেন গাধা। বুঝতে পারছ না, নতুন চাকুরি।
হ্যাঁ, বুঝেছি। এই যে ছয়মাসের জন্য শ্রীলংকা যাবেন। তারপর তামিল একজনরে বগলদাবা করে নিয়া আসবেন।
হাহাহাহাহহাহাহাহা। আর হাসাইওনা। শোন, দেখি আগামী সপ্তাহে একবার আসা যায় কী না।
আর আসছেন!
খুব চেষ্টা করব পলি, যাবার আগে একবার দেখা করে যেতে।
ঠিক আছে, দেখব। খেয়েছেন দুপুরে?
না, খাব। সকালে উঠেই তো ব্যস্ত হয়ে গেলাম আজ।
ঠিক আছে, খেয়ে নিন। রাখি।
ওকে, বাই। লাভ ইউ।
বলবো না।
সত্যি বলবানা?
হুম। বলবোনা।
মন খারাপ করে থাকব।
থাকেন। যেদিন হবিগঞ্জ আসবেন। সেদিন বলব। তার আগে না। প্রমিজ।
ওহ। ঠিক আছে। আসব। রাখি এখন।
বাই।
ফোনটা রেখে মনটা বিষন্নতায় ভরে উঠল। ভাল লাগছেনা কিছুই। এত আনন্দের খবরও যে বিষাদের কারণ হতে পারে কখনো কখনো, তা জানা ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার দিয়েও যায়নি। গোসল সেরে বেরুতেই ম্যানেজার সেলিম চৌধুরীর ফোন।
হ্যাঁ সাগর।
জি¦ স্যার।
শোন, উপেন তো অবনীর দেখাশোনায় ব্যস্ত। খাবার দিতে পারেনি। তুমি বাসায় এসে খেয়ে যেও। দেরি করনা। তোমাকে আবার বেরুতে হবে।
জ্বি স্যার আসছি।
আমার টিলা থেকে একটা সমতল ভূমি। তার ওপাশে গাছপালা ঘেরা উঁচু প্রাচীর দেয়া বাড়িটা জেনারেল ম্যানেজারের। আড়াইমাস হতে চলল চাকুরির। কখনো আসা হয়নি। এক-দু বার ম্যানেজারের স্ত্রীকে দেখেছি উঠানে পায়চারি করতে। কথা হয়নি কখনো। প্রচ- ব্যস্ততা, ছুটোছুটির মধ্যে আসলে আশপাশে তাকানোর সময়ইবা কোথায়। আর আমি এমনিতেই ছোটবেলা থেকে লাজুক আর ঘরকুনো। বাবার ঘনিষ্ট বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে উচিত ছিল আমার উপযাচক হয়ে যোগাযোগ রাখার।
খেয়ে আর ঘরে ফেরা হবেনা। আড়াইটা বেজে গেছে। জিন্সের প্যান্ট, আকাশী রঙের টি শার্ট আর কেডস। হাতে ঘড়ি, ব্রেসলেট। পারফিউম দিলাম এখানে আসার পর এই প্রথম। মালিকের মেয়ের সঙ্গে মুভ করতে হবে। একজন মার্কেটিং ম্যানেজারের গা দিয়ে পাঠার মত বোঁটকা গন্ধ বেরুলে তা নিশ্চই অসহ্য লাগবে। কড়া নাড়তেই বিশাল কাঠের দরজা খুলল। সতের আঠার বছরের একটি মেয়ে হাসিমুখে দাঁড়ানো।
আসুন। বাবা আপনার কথা বলেছেন। আমি সিমি।
থ্যাংকস।
আপনি ফ্রেশ হবেন?
না। বাসা থেকেই আসছি।
ওকে, সোজা টেবিলে চলে আসুন।
টেবিলে খাবার সাজানো। সিমির মা ভেতর থেকে আসলেন। সিমির ছোট একটা ভাই সোফার এক কোনে ট্যাব নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। দুনিয়ায় কী ঘটে যাচ্ছে তা দেখা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। ট্যাবের ভলিউম ফুল করা। অনবরত সাউ- আসছে টিয়াও..ঢিসুম…ঠা ঠা ঠা। সিমির মা চেয়ার টেনে বসলেন।
স্লামালেকুম আন্টি।
ওয়ালেকুম সালাম। ভাল আছ বাবা?
জ্বি আন্টি। আপনাদের সঙ্গে এতদিনেও পরিচয় হল না। এটা আমারই ব্যর্থতা।
আরে না না বাবা, এভাবে বলনা। আমাদেরই উচিত ছিল তোমাকে ডেকে আনা। আমি মাঝখানে ছিলাম না। সিমি আর রাতুলকে নিয়ে ব্যাসিকালি আমি আজিমপুর থাকি। সিমি আজিমপুর ভিকারুননুননিসায় পড়ছে। আর রাতুল অক্সফোর্ডে। ওদের সময় দিতে হয়। দেখাশোনা করতে হয়। সিমির এক্সাম শেষ হল। তাই কটা দিন এখানে ঘুরে যাব। নাও বাবা খাও।
জ্বি আন্টি।
সিমি, কই গেলি। এখানে বস। দেখি আমি ভিতরে অনেক কাজ পড়ে আছে।
আন্টি চলে গেলেন। মাথায় ওড়না জড়ানো সিমি সামনে এসে বসল। কিশোরীর সমস্ত চঞ্চলতা তার চোখে। নীল মনির বড় বড় চোখ। বিড়ালচোখা যাকে বলে আর কী। উজ্বল শ্যামলা। উচ্চতা সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মতই পাঁচফুট দুই-তিন হবে। দেখার মত হল সিমির চুল। ও যখন দরজা খুলে ভেতরে গেল, মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। পেছনটায় তাকিয়ে ছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর কাছে নুয়ে পড়েছে চুল।
যে কোন হেয়ার অয়েল কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের যথার্থ মডেল। আনমনা হয়ে খাচ্ছি। সাতকড়া দিয়ে মুরগির মাংস, বাধাকপি ভাজি, ডাল আর আলুভর্তা। সিমি মিটিমিটি হাসছে। হাসির কারন বুঝে উঠতে পারিনি। খাওয়া প্রায় শেষ। বোকার মত বসে আছি দু’জনেই। কারও মুখে কোন কথা নেই। ডালে চুমুক দিতে গিয়ে সুড়–ত করে শব্দ হল, মুচকি মেরে হাসল সিমি।
নীরবতা ভাংলাম আমিই।
তুমি কীসে পড়ছ।
সায়েন্সে।
সায়েন্সে তো বুঝলাম। কোন লেভেলে।
আমাদের তো কোন লেভেল নেই। আমি বাংলা মিডিয়াম। যারা ইংলিশ মিডিয়ামএ পড়ে- মধ্যরাতে অনলাইনে বসে পরীক্ষা দেয়, তাদের এ লেভেল, ও লেভেল থাকে।
হুম, বুঝেছি।
না মানে তুমি কোন ক্লাসে পড়।
ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ার। আপনি এখানে কতদিন আগে আসলেন। আগেরবার এসে আপনাকে দেখিনি কেন! ঢাকায় থাকতেন? এখানে থাকেন কোথায়। শুনুন, কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু খুব কম কথা বলি।
হুম, বুঝেছি। তুমি কমই কথা বল।
চা খাবেন?
না থাক, এখন আর না। আরেকদিন এসে খাব।
আরেকদিন কেন হবে। বাবা বলেছেন, অবনী ম্যাডাম থাকা পর্যন্ত আপনি আমাদের এখানে খাবেন। আর আমরাও চলে যাব সপ্তাহখানেক পর।
তোমাদের কষ্ট হয়ে যাবে।
কেন কষ্ট হবে? মানুষের কত ধরনের কষ্ট থাকে। জানেন, মানুষ খাওয়াতে পছন্দ করে। আপনি পেটপুরে খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে দরজা পার হবেন, আর ঢেকুরের শব্দ শুনে কবাটের এপারে কেউ খিলখিলিয়ে হাসবে তা তো একটা মজার ব্যাপার।
সব কিছু নিয়ে মজা করতে নেই সিমি। এটা তো শরীরবৃত্তীয় ব্যাপার। মানুষের খাবারের সঙ্গে শ্বাসনালী থেকে কিছু বাতাস পাকস্থলীতে ঢুকে যায়। বিপাক প্রক্রিয়ায় শরীর তা বের করে দেয়।
থাক, আর ডাক্টারী ফলাইতে হবে না। জান হাত ধুয়ে আসেন। ওই যে, ওদিকটায় বেসিন। হাত ধুয়ে বসেন। চা নিয়ে আসছি।
বলে গটগট করে ভিতরের ঘরে চলে গেল সিমি।
জেনারেল ম্যানেজারের বাংলো বলে পরিপাটি করে সাজানো। পুরনো আমলের দুটো হরিণের শিং, চামড়া, চা গাছের শেকড় দিয়ে বানানো হরেক রকম শিল্পকর্ম। দেয়ালে টাঙানো অন্তত গোটা ত্রিশেক ছবি। আর ভেতরের দিকের ঘরগুলো ঢাউস আকারের। হাত ধুয়ে রাতুলের পাশে এসে বসলাম। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এখন টেম্পল রানে ব্যস্ত। ট্যাব থেকে অনবরত সাউন্ড বেরুচ্ছে নানান স্বরে। সোফার এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছি। ফোন হাতে নিয়ে খামাখাই নাড়াচাড়া করছি। চা বানানোর কথা বলে সিমি ভেতরে গেল, আসবার কোন নাম নেই। এদিকে তিনটা বেজে গেল প্রায়। ভাবতে ভাবতেই ফোনের ডায়াল স্ক্রিণে লেখা ভেসে উঠল অবনী, এমডি স্যার।
হ্যলো, স্লামালেকুম।
ওয়ালেকুম সালাম। সাগর সাহেব আপনি কোথায় এখন।
জ্বি কাছাকাছি আছি ম্যাডাম।
আবার ম্যাডাম!!
সরি।
হাহাহাহা, কোন ম্যাডাম নয়, সরিও নয়, আমি আপনার ছোট। আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারেন। জানেন, আমি নেভাদায় থাকি। আমেরিকার নেভাদা। ওখানে কেউ কাউকে স্যার বলে না। ম্যাডাম বলে না। বারাক ওবামাকে মিস্টার প্রেসিডেন্ট বলে সবাই। আর এ তো অনেক দূর, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচারকেও নাম ধরে ডাকে জানেন। তাই বলে তাদের কী রেসপেক্ট কম! রেসপেক্ট, লাভ, হেট সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। এগুলো মুখে ঢোল পিটিয়ে বেড়ানোর বিষয় না। আপনি মুখে আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম বলে ফেনা তুললেন, আড়ালে গিয়ে আবার দুটো গালি দিলেন। এমনই তো হয় তাই না?
জ্বি , কিন্তু আপনাকে গালি দিব না।
হাহাহাহাহা, আচ্ছা দিয়েন না। শোনেন, ঝটপট চলে আসুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আমি রেডি। বেরিয়ে পড়ব।
জ্বি, আসছি। এক্ষুনি বেরুচ্ছি।
ফোন রেখেই ছুটলাম ভিআইপি ভিলায়। সিমিদের বাসার কাউকে বলাই হলনা। সদর দরজা খুলে ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রোদ পড়ে এসেছে। ধোঁয়ার মত কুয়াশা ঘিরে রেখেছে পুরো চা বাগান। চারদিকে নিঝুম নিস্তবদ্ধতা। ভিআইপি ভিলার সামনে শাদা রঙের ল্যা-রোভার দাঁড়ানো। ড্রাইভার গামছা দিয়ে অনবরত চারপাশ মুছে চলেছে। কোন ক্লান্তি নেই চোখে মুখে। ভিলার মূল ফটকের সামনে দারোয়ান সুবল দাঁড়ানো। দাঁড়াতে বলে কড়া নাড়ল। দরজা খুলল সুবলের বউ।
ও বাবু, আপনি এয়েচেন। দিদি অপেক্ষা করছেন।
জ্বি, বলুন আমি এসেছি।
সুবলের বউ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সদর দরজা খুলল। বেরিয়ে এল অবনী। নীল একটা শিফন শাড়ি, হালকা বেগুনি পাড়। পায়ে ফ্ল্যাট হিল। মাথায় খোপা করা। খোপায় বেলি ফুলের মালা। টেনে টেনে কাজল দেয়া চোখ। হালকা গোলাপী লিপস্টিকে দারুন মানিয়েছে। অপলক তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কীই বা করার আছে। মনে মনে গাইছি নজরুলের সেই বিখ্যাত সংগীত- তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ। পাশ্চাত্যে থেকে, পাশ্চাত্যে বড় হলেও এই মুহুর্তে অবনীকে বাঙালী নারীই মনে হচ্ছে পুরোদস্তুর। শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে।
ওহ সাগর সাহেব, আসুন।
ড্রাইভার ছুটে এসে পেছনের দরজা খুলে দিল। গটগট করে হেঁটে লাফিয়ে গাড়িতে উঠল। আমি ধীর লয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটের দরজা খুলতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করল অবনী।
আরে আরে করেন কী। ওখানে কেন। পেছনে আসুন।
না না, সমস্যা নেই।
সমস্যা আছে সাগর সাহেব। আপনি আমার যাত্রা সঙ্গী। আপনার সঙ্গে টুকটাক কথা বলব। সময়ও কাটবে। আপনি সামনে বসে বারবার ঘুরে পেছনে তাকাবেন, এটা শোভন দেখাবে না। আমারও ভাল লাগবেনা।
কথা না বাড়িয়ে পেছনের সিটে বসলাম। সিটের পেছনে রাখা সিডি থেকে বেছে শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রানী সেনের রবীন্দ্র সংগীতের এ্যালবাম ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। প্লেয়ারে বেজে উঠল।
‘‘ আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।
সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা
আমায় চেন কি।
চিনি তোমায় চিনি, নবীন পান্থ-
বনে বনে ওড়ে তোমার রঙিন বসনপ্রান্ত।
ফাগুন প্রাতের উতলা গো, চৈত্র রাতের উদাসী
তোমার পথে আমরা ভেসেছি।
ঘরছাড়া এই পাগলটাকে, এমন ক’রে কে গো ডাকে
করুণ গুঞ্জরি,
যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়াই সঞ্চরি।
আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
আমি আমের মঞ্জরী।
তোমায় চেয়ে দেখার আগে, তোমার স্বপন চোখে লাগে
বেদনা চোখে জাগে গো-
না চিনিতেই ভালো বেসেছি।
যখন ফুরিয়ে বেলা চুকিয়ে খেলা তপ্ত ধুলার পথে
যাব ঝরা ফুলের রথে-
তখন সঙ্গে কে লবি,
ল’ব আমি মাধবী।
যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে শুকনো পাতা যাবে উড়ে
সঙ্গে কে র’বি।
আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।
বসন্তের এই ললিত রাগে , বিদায়-ব্যাথা লুকিয়ে জাগে-
ফাগুন দিনে গো
কাঁদন-ভরা হাসি হেসেছি।’’
চা বাগান ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে জেলা বোর্ডের সড়ক ধরে। কারও মুখে কোন কথা নেই। গানের কথাগুলো যেন গেঁথে যাচ্ছিল বুকে। তাকিয়ে আছি জানালা দিয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে লুকোচুরি খেলা খেলছে রোদ। দুধারে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। শিশুরা খেলছে আপনমনে। গরু-ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরছে গৃহবধু। সার বেঁধে পিঠে ঝাঁকা নিয়ে ঘরে ফিরছে চা-শ্রমিকরা। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট বাজার, চায়ের দোকান, মানুষের জটলা, সারি সারি বাজার ফেরৎ মানুষ।
চাদরে মোড়ানো মাথা, আধা ময়লা লুঙি- পান খেয়ে লাল ঠোঁট, কারও হাতে বিড়ি- সিগারেট, কারও হাতে বাজারের ব্যাগ। হাসি খুশি এই মানুষগুলোকে দেখলে ঈর্শা হয়। এত এত সুখী মানুষ আছে বলেই তো আমাদের দেশটা এত সুন্দর। এত বর্ণময়। এত এত ভাল মানুষ চারপাশে আছে বলেই তো সোনার বাংলাদেশ। গাড়ি কোথায় যাবে জানিনা। কী কাজ কিছুই বলেনি অবনী। গাড়ি যাচ্ছে শ্রীমঙ্গলের দিকে। নীরবতা ভাঙলাম আমি।
আজ আপনার প্ল্যান কী?
ও, হ্যাঁ, আপনাকে তো বলাই হয়নি। আমরা শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। আজ ব্যাসিকালি কোন কাজ রাখিনি। চা বাগানে এলাম। জার্নির ধকলটা কাটুক। তারপর কাজে নেমে পড়া যাবে। আপনার সঙ্গে ডিসকাস করব অবশ্যই।
শ্রীমঙ্গল কী শুধু ঘুরতেই যাবেন? নাকি ওখানে কোন প্ল্যান আছে।
বলতে পারেন ঘুরতেই। ওখানে টি বোর্ডের একটা কটেজ বুকিং দেয়া আছে। কয়েকটা বাগান ঘুরে কটেজে কিছু সময় বসব। যদিও শীতের রাত। অন্ধকারে বসে চাঁদ দেখার মজাটা পাওয়া যাবেনা। তারপরও কম কী। খোলা বারান্দায় বসে তাজা চা খাব। হিম হিম বাতাস এসে ছুঁয়ে যাবে, শীতল করে দেবে হৃদয়।
বাহ, আপনি বেশ রোমান্টিক তো।
হাহাহাহাহা, রোমান্টিক না। এসব আমার ভাবনা। আসলে আপনি হয়ত ভেবেছেন, ফাষ্ট ওয়ার্ল্ডে বড় হয়েছি বলে, নিজের স্বত্তাকে, নিজের ভাবনাকে, নিজের স্বপ্নগুলোকে সিন্দুকে তুলে রেখেছি। আমি কিন্তু পুরোদস্তুর বাঙালী মেয়ে।
হুম, তা তো দেখতে পাচ্ছি। একটা বিষয় কী জানেন। শাড়িতে আপনাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
কিছুটা ঘুরে বসল অবনী। সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রহস্যমাখানো একটা হাসি দিল। ওই হাসিতে ভেঙে চুরে খানখান হয়ে যেতে পারে মনের নরম কাঁচের দেয়াল। বোকার মত আমিও হাসলাম।
থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট। আসলে শাড়ি খুব একটা পরা হয়না। সত্যি বলতে কী, নিজে থেকে পরতে পারি না ভালমত। এই যে দেশে আসলে এর ওর হেল্প নিয়ে পরি, বাট শাড়ি আমারও ফেবারিট। জানেন, নেভাদা ইউনিভার্সিটিতে আমার প্রত্যেকটা প্রেজেন্টেশনের দিন আমি শাড়ি পরেছি। আমার টিচার, ফ্রে-সরা শুধু একটা কথাই বলে – ওয়াও.. হাহাহাহা।
আসলেই আপনাকে শাড়িতে অনেক বেশি সুন্দর লাগে।
হাসি যেন থামছেই না। ফোন বেজে উঠল অবনীর। ফোন হাতে নিয়ে মুখটা কালো হয়ে গেল। ঝকমকে রোদের পর যেমন করে একখ- মেঘ আঁধার করে দেয় পৃথিবীর বুক। অবনীর মুখেও যেন কালো মেঘের আবরণে ঢেকে গেল। ধরবে কী ধরবেনা, খানিক ইতস্তত করে ফোনটা ধরল।
হ্যালো।
ওপাশে কিছু একটা বলতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল অবনী। সকাল থেকে অবনীর এই রুদ্রমূর্তি একবারও দেখা হয়নি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চিৎকার করে উঠল।
এই ড্রাইভার গাড়ি থামান। আরে.. আমি তো বলেছি আমি শ্রীমঙ্গলে না। কেন বার বার আমাকে ডিষ্টার্ব করছ। প্লিজ আমাকে খারাপ কিছু করতে বাধ্য করবা না। শাট আপ… তোমাকে লাস্টবারের মত বললাম, ফারদার আমাকে ফোন করবা তো, হয় মাস্তান লাগাবো, নয় পুলিশ দিয়ে ঠেঙাবো।
আছাড় মেরে ফোনটা ব্যাগে পুরে রাখল অবনী। গোলাপী মুখটা লাল হয়ে গেছে। এই শীতেও নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
সরি সাগর। ধুর, মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। এই আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। চা বাগানে ফিরে যান।
চুপ হয়ে রইলাম। অবনী সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল। গাড়ি ঘুরে উল্টো পথে চলা শুরু করেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষণে। অবনী সম্ভবত কোন বিপদের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ বিপদ। একা সেই বিপদের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। বলার মত কাউকেও খুঁজে পাচ্ছেনা। কিন্তু নিজে থেকে কী জানতে চাওয়াটা ঠিক হবে!
হয়ত মনের মধ্যে পুষে রাখা কথা, জটিলতাগুলো একটু বলে ফেললে ওর হালকা লাগত। এত হাসিখুসি সুন্দর মুখটা হাড়ির মত দেখতে ভাল লাগছে না। অবনীকে হাসাতেই হবে। অন্তত যে ক’টা দিন এখানে আছে, আমাকেই তো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দেখাশোনার। অবনী মন খারাপ করে দরজায় খিল লাগিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে এখানে আসেনি। চোখ খুলল অবনী।
সাগর, শ্রীমঙ্গলে টি রিসোর্টের বারান্দায় বসার কথা ছিল না? আমরা ভিআইপি ভিলার বারান্দায় বসব। আপনার কোন সমস্যা নেই তো?
না না, তা থাকবে কেন?
ঠিক আছে। আপনি রুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে ইজি হয়ে আসবেন। আজ সারা রাত গল্প করব। উপেনদাকে বলে দেবেন রাতে ভিলার সামনে ক্যাম্প ফায়ারে খাসির মাংসের কাবাব আর ছোট মাছের ফ্রাইয়ের ব্যবস্থা করতে। আপনার ড্রিংকস এর অভ্যেস আছে?
না, দু’একবার খেয়েছিলাম বন্ধুদের পার্টিতে।
আমারও নেই। তবে আজ করব। আপনার কোন আপত্তি নেই তো। শুনেছি চা শ্রমিকরা নিজেরা চু বানায়।
বাট, ওটা আপনার গলা দিয়ে নামবে না।
হাহাহা, কী যে বলেন। গলা দিয়ে নামাতেই হবে। এমনিতেই গলায় বিষকাঁটা আটকে আছে একটা। সেই কাঁটার চেয়ে এটা বেশি কিছু না।
বিষকাঁটা মানে!
ওহ, তেমন কিছু না। আছেন তো আমার সঙ্গে। বলব কোন এক সময়।
হুম, আই থিংক ইউ আর পাসিং এ ভেরি ব্যাড টাইম।
নেভার, নাউ আইএম পাসিং ভেরি গুড মোমেন্টস উইথ ইউ। হাহাহাহাহাহ।
হেয়ালির স্বরে কথাটা বললেও দুজনের হাসিটা ছিল আন্তরিক। গাড়ি ভিআইপি ভিলায় পৌঁছে গেছে। ড্রাইভার লাফিয়ে নেমে দরজা খোলার আগেই নেমে গেল অবনী। উপেন দৌড়ে এল সামনে।
উপেন দা। রাতে এখানে ক্যাম্পফায়ারের ব্যবস্থা করুন।
জ্বি, দিদি।
আর কোন কথা বললনা অবনী। গটগট শব্দ করে ঢুকে গেল ভিআইপি ভিলায়। কখন আসব, বা আদৌ আসতে হবে কী না তার কিছুই জানা হল না। সারা দিনের ধকলে শরীরটা কাহিল লাগছে। ঘরে ফিরে একটু ঘুমাতে পারলে বেশ হত। কে জানে আবার কখন ডাক পড়ে। বাংলোর দিকে হাঁটা দিলাম। সন্ধ্যাবাতিগুলো জ্বলেছে বেশ আগেই। চারপাশে শুনশান নীরবতা। আবছা অন্ধকারে কুয়াশা ঢাকা বাল্বগুলো জবুথবু বুড়োর মত গুটিশুটি মেরে আছে।
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম। একুশটা মিসড কল। অবনীর সাথে থাকার সময় কোন ফাঁকে চাপ লেগে মোবাইল ফোন সাইলেন্ট হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। পলির এতবার ফোন করেছে বুঝতেই পারিনি। ডায়ালে আঙুল রেখে কল দিলাম। ডা. পারমিতা। রিং হল। কেউ ধরলনা। আবার দিলাম। নিশ্চই ক্ষেপে আছে প্রচ-। তৃতীয়বারে ধরল ডা. পারমিতা।
হ্যালো, সাগর।
জ্বি স্লামালেকুম আন্টি।
ওয়ালেকুম সালাম। পলির সঙ্গে কী হল বাবা। ও ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেল।
ওহ, আন্টি কিছুই হয়নি। একটা মিটিংএ ছিলাম তো। ধরতে পারিনি ওর কল।
ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। ওকে বলব পরে ফোন ব্যাক করতে। বাসায় প্যাশেন্ট এসেছে তো, একটু দেখি।
ঠিক আছে আন্টি।
আলো আঁধারিতে অদ্ভুত রহস্যময়তা। পলি রাগ করে বসে আছে। এদিকে অবনী বসে আছে সারারাত গল্প করার আয়োজন নিয়ে। সিমি দুপুরে চা খেয়ে যেতে বলেছিল, খাওয়া হয়নি। জানিনা কী ভেবেছে। তিনজনই আপন করে নিয়েছে এক লহমায়। কিন্তু আমি তো ভালবাসি পলিকে। পলিই আমার জীবনমরণ। এলোমেলো ভাবনা খেলে যায় মস্তিস্কের নিউরণে। ঘরে ফিরে ট্রাউজার আর টি শার্ট পরে সটান শুয়ে পড়লাম বিছানায়। এপাশ ওপাশ ফিরছি। ভাল লাগছে না কিছুই।
পুরনো একটা ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে এলোমেলো চোখ বুলাতে লাগলাম। কত কিছু নিয়ে লেখা হয় ম্যাগাজিনে। সেলফি ম্যানিয়া নিয়ে লিখেছে একজন। খোলা কলম কলামে তানভীর আহমাদ খান লিখেছে ‘‘ বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে বইসা আছি। আশপাশের মানুষজন ধুমায়া সেলফি তুলতেছে। ব্যাপক মজা পাইতেছিলাম। এক টিনএজ মেয়েকে দেখলাম একা একা টেবিলে বইসা আছে, বয়ফ্রে- গেছে খাবার আনতে। এই ফাঁকে সে সেলফি তুলতেছে। কখনও ডাক ফেস, কখনও মুরগি ফেস। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল এটা। অন্য টেবিলে দুইজন লোক বইসা ছিল। এদের একজন মধ্যবয়সী, আরেকজন কিশোর। ফ্রাইড চিকেনের ঠ্যাং কামড় দিয়ে সেলফি তুলতেছে দুইজনই। তবে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে। মনে হইতেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কঠিন হুকুম দেয়া হইছে যে, মুরগির ঠ্যাং খাওয়ার সময় সেলফি না তুললে ছয়মাসের সশ্রম কারাদ-। ’’
লেখাটাকে মাঝখানে রেখে দু’পাশে দুটো কার্টুন এঁকে দেয়া হয়েছে। একপাশে একজন তরুণী, যার ঠোঁট বকের মত লম্বা। সেই লম্বা ঠোঁটের মাথায় একটুকরো ফ্রাইড চিকেন ঝুলছে। ফ্রাইড চিকেনটি দেখতে কিছুটা পুঁটিমাছের মত। অন্যপাশে পেটমোটা এক লোকের ভুড়িতে গিয়ে ঠেকছে ইয়া বড় এক মুরগির ঠ্যাং। ঠ্যাং এর দিকটা ফ্রাই করা হলেও বাকি মুরগি পাখনা সহ লোকটার ভুড়িতে গা ঘষে দিচ্ছে। দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠল ছবিটা, আবার হাসিও পেল।
পলিকে যে বারবার ফোন দিব সে উপায়ও নেই। পলির নিজস্ব কোন ফোন নেই। ডা. পারমিতা বিরক্ত হতে পারে বার বার ফোন দিলে। ভাল লাগছে না কিছুই। রাত প্রায় আটটা বাজতে চলল। পেটে চোঁ চোঁ ক্ষুধা। সেই দুপুরের পর আর কিছুই খাওয়া হয়নি। উপেনও নেই , যে খাবার দিয়ে যাবে। বাইরে গিয়েও এখানে খাবার পাওয়া দুস্কর। হঠাৎ মনে হল বাজারের ডিমওয়ালা লোকটার কথা। নিশ্চই ডিম নিয়ে এসে খুঁজে গেছে। চায়ের দোকানের ঝাঁপের নিচে গুটিশুটি মেরে বসে অপেক্ষায় থেকেছে আমার। লোকটাকে ওভাবে আশ্বাস দেয়া ঠিক হয়নি। ডিম হয়তো অন্যজনের কাছে বেচতে পারবে, কিন্তু আমি যে তাকে কথা দিলাম। যদি লোকটা সেই আশ্বাস থেকে মমতা নিয়ে বসে থাকে। না পেয়ে নিশ্চই আশাহত হয়েছে। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল যে করেই হোক যাব একবার বাজারে। বলে আসব ব্যস্ততার কথা। মানুষের জীবনে ছোট ছোট কিছু মুহুর্ত, কিছু ঘটনা কিভাবে দাগ কেটে যায়, তার রসায়ন বের করার সাধ্য হয়ত কারোর নেই।
সাড়ে আটটার দিকে ফোন বেজে উঠল। আননোন নাম্বার। ধরতেই ওপাশে সিমির ঠান্ডা গলা। গলা চিনতে খুব একটা সমস্যা হলনা। মিস্টি রিনরিনে একটা গলা। হারমোনিয়ামের স্কেলের জি শার্প বা তারও ওপরের টিউন, কিন্তু খুব স্পষ্ট, ক্লিয়ার ভয়েস।
হ্যালো।
হুম, সিমি বলছি।
বুঝতে পেরেছি। এটা তোমার নাম্বার?
হুম, এটা আমার নাম্বার। কেন বলুন তো? ফোন দেবেন বুঝি!
গলায় অভিমানের ঝাঁঝ।
না, মানে দিলে কোন প্রবলেম আছে?
প্রবলেম থাকবে কেন? আপনি তো আমাকে পাত্তাই দিলেন না।
পাত্তা দিব না কেন। আসলে হয়েছেটা কি জানো…।
থাক, আর বলতে হবে না। আপনি এসে খেয়ে যান।
ওকে, আসছি।
বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আকাশে রুপালী জোছনা। কুয়াশাগুলো যেন কেউ রুপা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। রেইনট্রিগুলো থেকে টুপ করে শিশিরকণা মাথায় পড়ছে। মাথায় একটা শীতল অনূভূতি নার্ভ ছুয়ে নিয়ে যাচ্ছে সারা শরীরের ইন্দ্রিয়তে। শীতের ভাবটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা বেল বাজতেই ক্যাঁক করে দরজা খুলল। গোলাপি সোয়েটারে অপূর্ব লাগছে সিমিকে। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। বাসাটা বেশ নির্জন। সিমির মা হয়ত ভিতরের কোন রুমে টিভি দেখছে। রাতুল একবার এসে উঁকি দিয়ে আবার ভেতরে ভোঁ দৌড়। সিমি এবার খাবার টেবিলে ডাকল না। বসাল ড্রাইংরুমটায়। কিছুক্ষণ পর পিরিচে চায়ের কাপ নিয়ে হাজির।
নিন। তখন তো খেয়ে যেতে পারেননি। বলেও যেতে পারেননি। আপনার জন্য এত কষ্ট করে চা বানালাম। আগে চা টা খেয়ে নিন। পরে একসাথে খাব।
আচ্ছা দাও।
কাপ হাতে নিয়ে ফুঁ দিতে গেলাম। ধোঁয়ার লেশমাত্র নেই। সিমি মুখ টিপে হাসছে। একচুমুক মুখে নিলাম। বরফ শীতল চা। দুপুরে বানিয়ে রেখেছে নির্ঘাত সেটাই দিয়েছে এখন। কেমন পঁচা পঁচা বিশ্রী একটা গন্ধ।
চা কেমন হয়েছে বলুন।
হুম, খুব ভাল।
মুখ বাঁকা করে উত্তর দিলাম।
উহু, আপনি ঠিক বলছেন না। মুখ বাঁকা করে রেখেছেন কেন। গিলে ফেলুন মুখের টা। সত্যি করে বলুন, আমি কেমন চা বানাই।
খুব ভাল বানাও। খুব ভাল। প্রতিদিন এমন চা খাওয়া দরকার। জানো, আইস টি খাবার খুব ইচ্ছে ছিল। তুমি কী করে বুঝলে!
সত্যি বলছেন, দেখছেন, ঠিক আপনার মনের কথা বুঝে গেছি। কাল থেকে রাতে এমন চা ই খাবেন।
আরে না না না।
না না কী! এই না বললেন আইস টি আপনার পছন্দ।
না মানে ইয়ে, একদিন পছন্দ। প্রতিদিন না।
কথা বলে কাজ হবে না। চা শেষ করেন। তারপর খাব।
দুপুরে বানিয়ে রাখা চা। চিনি-দুধ কী রিঅ্যাকশন হয়ে আছে কে জানে। বিদঘুটে স্বাদ। এমন জঘন্য চা জীবনেও খাইনি। পেটের কী অবস্থা হয় কে জানে। বাধ্য হয়ে গিলছি আর মনে মনে অবনীকে গালি দিচ্ছি। ওর জন্যই তো দুপুরে চা না খেয়ে ছুটতে হল। তখন ছুটতে না হলে এমন জঘন্য চা মুখে নিয়ে বসে থাকার মত শাস্তি পেতে হত!
এই যে, চা মুখে নিয়ে বসে আছেন ক্যান। খান।
যতই ঢোক গেলার চেষ্টা করছি, ততই মনে হচ্ছে পিচকিরির মত ছিটকে বেরুবে চা। বুঝতে পেরেছে সিমি। হ্যাঁচকা টানে কাপ নিয়ে টেবিলে রেখে হাত ধরে টেনে উঠাল। মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
আমাকে পাত্তা না দেয়ার ফল বুঝছেন তো। যান, বাথরুম গিয়ে কুলি করে টেবিলে আসেন। দ্বিতীয়বার যদি না বলে গেছেন তো আপনার ঠ্যাং ভাঙব।
(চলবে)