১৯ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

উপন্যাস : এখন অনেক রাত, পর্ব-দশ

Advertisement

(দশ)
সন্ধ্যা কেবল ছুঁই ছুঁই। শান্তিবাগের দোতলা বাড়ির বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছি। চেয়ারটা দাদার আমলের। কাঠের ফ্রেম। মাঝখানে টানা কাপড় দিয়ে হেলান দেয়ার ব্যবস্থা। কাপড়টা কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মা অন্য কাপড় দিয়ে তালি দিয়েছে। মন্দ লাগেনা দেখতে। পুরনো বিছানার চাদর থেকে ফুলের নকশা কেটে সুন্দর করে বসানো। এই জোড়াতালিতে বরং আরো ভাল লাগে দেখতে। পুরনো মলিন কাপড়টার মর্যাদা যেন বেড়েছে কিছুটা।

হবিগঞ্জ থেকে ফেরার পর পলির সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। অবনীর ঢাকায় আসার কথা, না হলে টিকেট এগিয়ে নিয়ে চলে যেতাম ক্যান্ডি। ঢাকায় কেমন যেন দম বন্ধ লাগে। সবার মধ্যে থেকেও আলাদা হয়ে থাকি। চুপচাপ খাই দাই ঘুমাই। সন্ধ্যায় বেরিয়ে হাঁটতে যাই গলির মাথায়। আধা ঘন্টায় দু’কাপ চা আর দুটো সিগারেট সাবাড় করে বাসায় ফিরি। মা চা বানিয়ে বসে থাকে। প্রতিদিনই বলি চা খেয়ে আসার কথা, এই সময়ে চা না বানাতে। রুটিন করে ঠিকই এই ভুলটা প্রতিদিন করে মা। চা খাবনা বলতেই বলে ওঠে ‘ ওহ, চা খাবিনা তো আগে বলে যাইতি’। কোন কথা না বলে, বিমর্ষ একটা হাসি দিয়ে বারান্দায় এসে বসি।

আমার হঠাৎ এই চুপসে যাওয়া নিয়ে বেশ চিন্তিত মা। এর মধ্যে মন ভাল রাখার উপায়ও খোঁজা হচ্ছে। বাবাকে খুব করে বোঝানো হয়েছে, অনেক তো হল, ছেলেটার এবার একটা বিয়ে শাদি দিলে তো থিতু হয়। বাবাও ভাবছেন তেমনটা। বাসার ফিসফাস আওয়াজ টের পাই। বড় খালার মেজো ননদের এক ভাতিজিকে নিয়ে হালকা আলাপও হয়েছে। ক্যান্ডি যাওয়ার আগে কোন একটা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে বাবা একবার খাওয়াতে চায়।

এত বছরের জীবনে আয়োজন করে বাবা কোনদিন চায়নিজ খাইয়েছেন পরিবারের সবাইকে, তেমন হিস্ট্রি নেই। কারনটা ওই খালার ননদের ভাতিজি। অনানুষ্ঠানিক দেখা। মেয়ের পরিবার বেশ আগ্রহী। মা দু’একবার কথাটা পাড়তে চাইলেও আমি পাত্তা দেইনি। পলির বিষয়টা মাথায় এমনভাবে গেঁথে আছে, এই মুহুর্তে কিছু চিন্তা করারও ক্ষমতা নেই। মাকে বলতেও পারছি না। যত দ্রুত সম্ভব ক্যান্ডি চলে গেলে এই উপদ্রব থেকে মুক্তি, না হলে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান চলবেই। এই মেয়ে না হলে অন্য মেয়ে, দরকার হলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হবে- প্রবাসী উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী পাত্রের জন্য পাত্রী আবশ্যক।

কাল খাবার টেবিলে বসে বাবার এমন কথায়, মা তেলে বেগুনে জ্বলে একসার। মার এক কথা, তার বড় বংশ। সেই বংশে কী মেয়ের অভাব আছে! বাবার ছোট বংশ, লোকজন নেই, সে নিয়ে খোঁটাও চলে কথায় কথায়। এলোবেলে ভাবনারা ঘুরে বেড়ায়, মগজে কিলবিল করে পোকার মত। ইজি চেয়ারে গা ছেড়ে দেই। সময় চলে যায়। শীতের শেষ সময়টার দখিনা বাতাস ছুটে আসে ইট-কাঠের ফাঁক ফোকর দিয়ে। ভাল লাগেনা, কিছুই ভাল লাগেনা। সামনে আলো ছায়ার খেলা। চোখ বুঁজে থাকি। মন ছুটে যায় ক্যান্ডির শীতল নীল জলের সমুদ্রে। এখানে আর একমুহুর্ত নয়। সর্ন্তপণে এসে কাঁধে হাত রাখেন মা।

কী এত ভাবিস বল তো। সেই কখন থেকে তোর ফোন আসছে।

ওহ তাই নাকি। আচ্ছা দাও তো দেখি।

ঢাকায় নেমেই অবনীর ফোন। সতের টা মিসড কল। আধাঘন্টা ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ব্যাক করলাম। একটা রিং হতেই ধরে ফেলল।

হ্যালো সাগর।

হুম। কবে আসলে।

কবে আসলে মানে!

না, মানে আসার আগে তো আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

শোন, ঢং করবা না। মোর দ্যান টুয়েন্টি ফোন আওয়ারস জার্নি। শরীর আর কুলাচ্ছে না।

ঠিক আছে। বাসায় গিয়ে রেষ্ট নাও। বললে না হয় আসতাম।

এসবই তো বলবা। তোমার আর আসা লাগবে না। শোন, ইমপরট্যান্ট কথা আছে। তুমি কই এখন।

আমি ঢাকায়ই। শান্তিবাগের বাসায়।

ওকে, শোন। তুমি রেডি হয়ে চলে আস। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।

আচ্ছা কোথায়, বলতো।

গুলশান এক নাম্বার সার্কেল। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। দশটার মধ্যে চলে আসবা।

তুমি না টায়ার্ড। এত রাতে কোথায় যাবে। রেষ্ট নাও না।

বেশি কথা বলবা না। আমি বলছি ব্যাস। রাত দশটা। গুলশান এক নম্বর সার্কেল।
ফোনটা কেটে গেল। মা দাঁড়িয়ে পাশে।

কী রে। এত রাতে কই যেতে বলল।

বাইরে মা। কাজ আছে।

মেয়েটা না আজই আসল। এত কী জরুরি!

জানিনা।

খেয়ে যাস।

না মা, বাইরেই খেয়ে নেব।

ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাত আটটা। শান্তিবাগের এই পুরনো গলিটার টুঁটি চেপে ধরে আছে রিকশা। এলোমেলো জটলা। সংকীর্ণ সড়কের বেশিরভাগ বাতিই নষ্ট। আলো আঁধারির অদ্ভুত খেলা। পথের দু’পাশে হরেক পশরা নিয়ে হকারের চকচকে চোখ। হাতে সময় আছে বেশ খানিকটা। দু’ঘন্টা। শান্তিবাগ থেকে গুলশান এক, সিএনজিতে যেতে জ্যাম না থাকলে পৌনে এক ঘন্টা। হাতে তাও থেকে যায় সোয়া এক ঘন্টা। হেঁটেই এগুনো যাক বরং কিছুটা পথ। গলি ছেড়ে মালিবাগ মোড় হয়ে মৌচাকের দিকে হাঁটছি। ভিড় কিছুটা কম এদিকে। হেডলাইট জ্বালিয়ে দূরন্ত ছুটছে যানবাহন। চোখ সরু হয়ে আসছে সে আলোয়। খানিক ঝাপসা দেখে থিতু হতে সময় লাগছে।

সাগর ভাই, এ্যাই সাগর ভাই।
চেনা গলা। মৌচাক মার্কেটের মূল ফটকটার সামনে থেকে ডাকটা এল। থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে খুঁজলাম একঝলক। পেলাম না কাউকে। মাথায় টোকা পড়ল হঠাৎ। পেছনে তাকাতেই মুখ ভেঙিয়ে দাঁড়ানো সিমি।

চমকে গেলেন বুঝি।

আরে না। চমকাবো কেন!

এই যে, এখনো চোখ বড় করে আছেন এখনো। ছবি তুলে দেখাবো একটা?

তুমি এত রাতে কোথা থেকে?

কোচিং ছিল। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেই পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? আপনার সাথে আমার অনেক হিসাব নিকাশ আছে।

ওহ মাই গড। আমার সঙ্গে হিসাব!

হুম, চলেন বসি কোথাও।

চল।

পাশেই ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্ট। আলো আঁধারি। সবুজ বাতি দিয়ে পুরো ঘরটাকে সবুজ আভা এনে দেয়ার চেষ্টা। সামনে বসা সিমিকেও সবুজ লাগছে। সবুজের ভেতর জ্বলজ্বলে চোখ। খোপা করা বড় চুল। মুখোমুখি তাকিয়ে দেখছি দু’জন দু’জনকে। সেই ক্যান্ডি যাওয়ার পর আর কথা হয়নি সিমির সঙ্গে।

বলেন, আপনার কি বিচার হওয়া উচিত।

হাহাহা। বিচার! কেন!

ওমা, না বলে পালিয়ে যাবার বিচার।

আমি আসলে অনেক ঝামেলায় ছিলাম।

মানলাম ঝামেলা ছিল। ওখানে গিয়েও তো একটা হ্যালো করতে পারতেন।

হ্যাঁ। তা ঠিক।

নাম্বার ছিল না তাই তো বলবেন!

না , ছিল।

হুম, অবশ্য আমি ফোন আশা করার মতও কেউ না। খামাখাই কেন আশা করব।

না, কেন করবা না। তোমার সাথে তো একটা ভাল সম্পর্ক।

আপনি যাওয়ার পর অনেক কষ্ট পেয়েছি। আপনি যেদিন কুলাউড়া থেকে এলেন। তার দু’দিন পরেই ঢাকা চলে আসি। চা বাগানটা খালি খালি লাগছিল।

কেন এমন করে ভাবছ বল।

ভাবলে দোষের কী! আমি আমারটা ভাবব। আপনাকেও ভাবতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।

না তাও না, কেন ভাবব না।

আপনি কী আমাকে ভালবাসেন?

চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্নটা করল সিমি। এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়াও কঠিন। হাঁ বললেও সমস্যা, না বললেও সমস্যা। মাথা নিচু করে চার আঙুলে গ্লাস ঘোরাচ্ছি।

কই, বলেন। আপনার কাছে কিছু জানতে চাইছি।

কেন এমন সোজা সাপ্টা প্রশ্ন কর বল।

আমি সোজা কথা বলতে পছন্দ করি তাই। আপনি হাঁ অথবা না বলুন। আপনাকে তো কোন স্পেসিফিক উত্তর দিতে বাধ্য করছি না।

না তা না।

কী আমতা আমতা করছেন। আচ্ছা থাক, স্টেইট একটা কথা বলব, শুনবেন?

হ্যাঁ বল।

আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। প্রোপোজটা হয়ত এভাবে করতে পারতাম- আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন? যেহেতু আমি ডিসাইডেড আপনাকে বিয়ে করবো, সো আমিই আপনাকে বিয়ে করতে চাই। বলুন এখন কী করবেন?

এমন সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে কোন মেয়ে কোন ছেলেকে সরাসরি এমন বিয়ের কথা বলতে পারে! অবাক হলাম সিমির সাহস ও কনফিডেন্ট লেভেল দেখে। আগে জানতাম, মেয়েরা প্রোপোজ করলেও মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে আকারে ইঙ্গিতে ভাললাগার কথা বলে। সিমির ব্যাপার পুরো উল্টো। যেন লজ্জা পেয়েছি আমিই।

হ্যাঁ অথবা না বলেন। তারপর উঠব। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা বাবা শোন, বিয়ে শাদির ব্যাপারে কী এমন হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আমাকে একটু সময় দাও। ভেবে দেখি একটু।

ওহ, আমাকে বিয়ে করতে আপনার ধ্যানে বসতে হবে, তাই না! ওকে ঠিক আছে। আমি চললাম।
বলেই এক লাফে উঠে দাঁড়াল। রেষ্টুরেন্টের অন্য সবার চোখ আমাদের দিকে। সিমির হাত খপ করে ধরে ফেলেছি। শক্ত করে রেখেছে কোমল হাত।

আরে বাবা বস। মানুষ কী বলবে।

চেঁচিয়ে উঠল সিমি।

মানুষ কী বলবে মানে। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কী না বলেন।

গলা বেশ চড়িয়ে অনেকটা চিৎকার করেই বলল সিমি। মুহুর্তের মধ্যেই কোনার দিকের টেবিল থেকে জনা চারেক ষন্ডামার্কা ছেলে এগিয়ে এল সামনে। সিমির হাত তখনও ধরা। বলা নেই কওয়া নেই একজন এসে নাক বরাবর ঘুষি চালিয়ে দিল। ব্যাথায় কুকড়ে উঠছি। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে নাক দিয়ে।

শালা, প্রেম করতে খুব মজা না। বিয়া করবি না কেন! ওই ওরে বান্ধ। কাজী ডাক। রেষ্টুরেন্টেই আইজ হইব ওদের বিয়া।
মহা ঝামেলায় পড়লাম। এবার উল্টে গেল সিমি।

না না না ভাইয়া। ওনার কোন দোষ নাই। ওনাকে ছেড়ে দেন।

আপনি ছাড়তে কইলেই হইবো! মাইয়া মাইনসের এই এক দোষ। বিয়া না কইরা শালা ভাগতাছে- মাইর দিলাম একটা, এখন উনিই কয় ছাইড়া দিতে। আমরা এলাকার বড় ভাই। আমাদের এলাকায় আইসা কোন বইনরে কেউ ছ্যাকা দিয়া যাইব এইডা হইতে পারে না।

আরেক দফা চলল কিল ঘুষি। সিমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। রেষ্টুরেন্টে জটলা লেগে গেছে। চারপাশে উৎসুক মানুষ। কেউ বলছে পুলিশ ডাকেন। কেউ বলছে- গার্ডিয়ান ডাকেন। কেউ বলছে- এটা যুগের দোষ। পোলা মজা লুটে এখন ভাগছে। মাইয়ার সাহস আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। জটলার ভেতর থেকে এগিয়ে এলেন মুরুব্বি কিসিমের একজন। উনি বোধহয় বিপদটা আঁচ করতে পেরেছেন। এসেই ছোকরাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে সিমির সামনে দাঁড়ালেন।

মা সত্য কইরা বল, এই পোলার ব্যাপারে আপনার কোন অভিযোগ আছে।

জ্বি না। আমরা এমনিই ঝগড়া করছিলাম।

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা আসতে পারেন। এই আপনারা যার যার কাজে যান। পোলাপান মানুষ। একটু আধটু ঝগড়াঝাটি আর কী।

আর একটা কথাও নয়, সিমিকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলাম রেষ্টুরেন্ট থেকে। দ্রুত পায়ে হেঁটে মালিবাগ গিয়ে রিকশায় উঠেছি। ন’টা বাজে প্রায়। আমার ছুটতে হবে। দশটায় গুলশান সার্কেলে অপেক্ষা করবে অবনী। এই রাতে সিমিকে একা ছাড়াও উচিত নয়। শক্ত করে ধরে রেখেছি সিমির হাত। মাথা নিচু করে রেখেছে। মুখে কোন কথা নেই। ভড়কে গেছে, হয়ত খানিকটা অপরাধবোধও কাজ করছে। বাসার গেটের কাছে নামার আগে, মুখের দিকে একবার শুধু তাকিয়ে বলল- স্যরি।

নাকের রক্ত তখনো ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা। হাতের উল্টো পিঠ ঘষতেই লাল হয়ে গেল। একটা ফার্মেসিতে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং করে নেয়া দরকার। সময় নেই। দ্রুত ছুটতে হবে। ঠিক দশটায় বা দশটার আগে অবনী থাকবে গুলশানে। সিএনজি অটোরিকশায় চেপে বসলাম। ছুটে চলেছি ব্যস্ত শহরের কানা গলি পেরিয়ে। হাজারো মানুষ, যানবাহন। সবাই ছুটছে, ছুটছে। কারো যেন এতটুকু অবসর নেই। কারো দিকে এতটুকু তাকাবার ফুরসৎ নেই। সিএনজির লোহার খাঁচা ধরে আকাশের দিকে তাকালাম। রুপার থালার মত বিশাল চাঁদ। আজ তাহলে পূর্ণিমা! কত নাম পূর্নিমার।

আজ তাহলে কোন পূর্ণিমা। হলুদ সড়কবাতি ছাপিয়ে সেই রুপালী আলোর বন্যা ছেয়ে গেছে নগর। মুহুর্তেই সব কিছু যেন কেমন হয়ে গেল। আশপাশের সব কিছু রুপালী দেখি। মানুষগুলোর মুখে রুপার প্রলেপ। গাড়ি ঘোড়া সব রুপালী। সড়কদ্বীপের গাছগুলো পর্যন্ত রুপালী। রুপালী এক পৃথিবী। ঝকমকে আলোময় এক পৃথিবী। যে মিষ্টি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে মানুষ। মানুষের দুঃখগুলো। তলানিতে পড়ে থাকছে নিখাদ ভাললাগা। যে ভাললাগা বুকে নিয়ে মানুষ আরো একশ জনম বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারে। খুব ভাল লাগছে নগর জোৎ¯œা। নাকের ব্যাথা অনেকখানি কমে এসেছে। মোবাইল ফোনে অবনীর কল।

হ্যালো সাগর তুমি কোথায়!

এইতো, কাছাকাছি। উইদিন টেন মিনিটস।

ওকে অ্যা’ম, ওয়েটিং।

লাইনটা কেটে গেল। ফোনটা হাতে নিলাম। ওয়ান আনরিড মেসেজ। খুললাম। সিমি। রিয়েলি আই এম সো সরি- সাগর। এন্ড মোর দ্যান দ্যাট রিয়েল ফ্যাক্ট ইজ আই লাভ ইউ সো মাচ!!

কী বলা উচিৎ সিমিকে। পলিকে যে কোন ভাবে হোক ফেরাতে হবে। কিন্তু কীভাবে! যোগাযোগের চেষ্টা করলেই সুইসাইডের হুমকি। এই বয়সী মেয়েদের কোন বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যি যদি কিছু করে বসে। তাও ভাল নিজের মত করে বেঁচে থাকুক, আমি আমার মত।

মোড়েই দাঁড়ানো ছিল অবনীর গাড়ি। ড্রাইভার নেইটপস আর জিন্স। পায়ে কেডস। দরজা খোলার একঝলক আলোতে দেখে নেয়া অবনী বরাবরের মতই নজরকাড়া। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। পাশের সিটেই বসলাম। গাড়ি ছুটে চলেছে বনানী হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে। পিয়ানোর হালকা ইনস্ট্রুমেন্টাল বাজছে ড্যাশবোর্ডে। শাঁ শাঁ করে উল্টো দিক থেকে ছুটে আসছে গাড়ি। খিলক্ষেত পেরিয়ে যাচ্ছি। কোন কথা নেই। নাকের রক্তের দিকেও হয়ত তাকায়নি অবনী। তাকালে এতক্ষণে হাসপাতাল, ডাক্তার করে হুলস্থুল কা- বাজাত। যাক না দেখায় ভোগান্তি থেকে বাঁচা গেছে অন্তত। কোথায় যাচ্ছি এটা অন্তত জানা দরকার। কতক্ষণ থাকব এটাও জানা জরুরি। বাসায় না জানালে টেনশনে মা আর ঘুমাবে না সারা রাত।

কোথায় যাচ্ছি আমরা?

জাহান্নামে। কোন অসুবিধা আছে?

নেই। তাও তো জানলাম জাহান্নামে যাচ্ছি। বাসায় অন্তত বলতে পারব, একটু পরেই মা ফোন করবে- বাবা কই তুই এখন। বলব- এইতো মা জাহান্নামের পথে।

হাহাহাহাহা। ঠিক আছে বইলো। যে অবনীর হাত ধরে জাহান্নামের পথে যাচ্ছি।

হাসির দমকে স্টিয়ারিং এর উপর ঝুঁকে পড়তে লাগল অবনী। উল্টো পথের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রহস্যময়ী মনে হচ্ছিল অবনীকে। রহস্যে ঘেরা একটা সুন্দর মানুষ। একটা সুন্দর নারী। এই রহস্যময় হাসির কী মর্ম- সে অবনীই জানে। হাসির চোটে এয়ারপোর্ট সিগন্যালে একটা স্পিডব্রেকারে বেশ একটা ঝাঁকি খেলাম। সিটবেল্ট নেই কারো। খানিকটা উড়ে গিয়েম অবনীর কাঁধে পড়লাম। ঝাঁকিটা দক্ষ হাতে সামলে নিল।

ভয় পেও না। তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য তোমাকে নিয়ে যাচ্ছিনা। হাহাহাহ। শোন সেদিন খবরে দেখলাম আর্জেন্টিনায় তিন মেয়ে এক ছেলেকে অপহরণ করে রেপ করেছে। হাহাহাহা। ভেবোনা তুমিও অপহরণ হয়ে যাচ্ছ। হাহাহাহা।

উফফ, বাবা। থামবে একটু। তোমাকে দিয়ে লাভ ক্ষতির হিসাব করছি না। কোথায় যাচ্ছি সেটা বললে অসুবিধা কী।

ওকে, তোমার আম্মু ফোন দিলে বল, জরুরি কাজে গাজীপুর যাচ্ছি। রাতে ফিরব না। ব্যাস।

ওকে ঠিক আছে।

গাজীপুর চৌরাস্তা পেরিয়ে গাড়ি সোজা বাঁয়ে একটা শালবনের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল। এবড়ো খেবড়ো পথ। হেরিংব-ের রাস্তায় ইট উঠে গিয়ে বেহাল দশা। ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলছে গাড়ি। পথে টুকটাক ছাড়া তেমন কোন কথা হয়নি অবনীর সঙ্গে। রাস্তাটা সম্ভবত বেশ পরিচিত অবনীর। এদিকটায় বাড়িঘর নেই তেমন। দু’ধারে শালবন। অন্ধকার। গা ছমছমে পরিবেশ। হেডলাইটের আলোয় একঝলক তাকিয়ে ছুটে পালালো কয়েকটি শেয়াল।

আলোতে ড্রাকুলার মত জ্বলজ্বল করে উঠল কয়েকজোড়া চোখ। পৌনে এক ঘন্টা বুনো পথে চালানোর পর গাড়ি এসে ভিড়ল বিশাল এক ফটকের সামনে। হেডলাইটের আলো পড়তেই ভেতর থেকে খুলে গেল দরজা। দু’জন সিকিউরিটি গার্ড হাত উঁচু করে সালাম দিল। অবনী তাকালো না সেদিকে। বাউন্ডারির ভেতরটায়ও কোথাও আলো নেই। বাগান, পুকুর, দোলনা, ছোট কয়েকটি ঘর জোছনার আলোয় মাখামাখি। ভেতরে ঢুকেই হেডলাইট নিভিয়ে দিল অবনী। গাড়ি এসে থামল ডুপ্লেক্স একটা ভিলার সামনে। ছুটে এল কয়েকজন। ভিলায় ঢুকলাম আমরা। শুনশান নীরবতা। আলো কমিয়ে প্রায় অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। অবনী আমাকে নিচতলার একটা ঘর দেখিয়ে দিল।

ভয়ের কোন কারন নেই। তুমি এই ঘরটাতে থাকবে। ফ্রেশ হয়ে এখুনি বারান্দায় আসো। আমি দোতলা থেকে নামছি উইদিন ফাইভ মিনিটস।

নিচতলার এই ঘরটা বিশাল। অর্ধচন্দ্রাকার। বাইরের দিকে দেয়াল নেই বললেই চলে। বিশাল পর্দা ঘেরা কাঁচের জানালা। পর্দা সরাতেই চাঁদের আলো ছুটে এল ঘরময়। শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করতেই খাটটাকে নেয়া হয়েছে কোনার দিকে। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এলাম। গোলাপী একটা গাউনে অসম্ভব রুপবতী লাগছে অবনীকে। গায়ে কড়া পারফিউমের গন্ধ। বাতাসে ভেসে আসা সে গন্ধ মাতাল করছে ভেতরে ভেতরে।

চল। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব বলে এখানে নিয়ে আসছি।

সারপ্রাইজ!!

হুম, দেশে আসলে আমি এখানটায় বেশি সময় কাটাই। বাবা আমার পছন্দে এই খামারবাড়ি টা বানিয়েছেন। এখানকার সব কিছুই আমার মনের মত করে সাজানো।

আন্দাজ করতে পেরেছি, বাট সারপ্রাইজটা কী?

আরে বাবা সারপ্রাইজ বলে দিলে তা আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি! চল। তোমার কী বেশি ক্ষুধা লাগছে?

না, ক্ষুধা একদম নাই।

কেন, ক্ষুধা কী দেখে হাওয়া হয়ে গেল। আমাকে দেখলে ক্ষুধা তো আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। রিয়েলি, ইউ আর নট হাংরি?
সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল অবনী। চাঁদের আলোয় দেখা সে চোখের ভাষা পড়তে পারেনা এমন কোন প্রেমিক পুরুষ নেই। নারীরা নাকি আরও বেশি পড়তে পারে চোখের ভাষা। পাঁচ মিনিট হেটে বিশাল এক দিঘীর পাড়ে পৌঁছলাম। পুকুরপাড়ে বিশাল ছনের ঘর। চারপাশ খোলা। কোন আলো নেই। মিস্টি বাতাস আসছে। মেঝেতে ছোট ছোট টুল। পাশে বিশাল এক বিছানা। কোলবালিশ, ঠেস দিয়ে বসার অনুসঙ্গ। বিছানায় বসতেই আবছা অন্ধকার থেকে একজন ছুটে এল।

ওদেরকে আসতে বল।

জ্বি ম্যাডাম।

লোকটা ছুটে বেরিয়ে গেল। চাঁদের আলোয় মুখোমুখি অবনী আর আমি। গাল ছুঁয়ে দিয়ে মুখ খুব কাছে এনে বলল- ভয় পেয়েছো।

না। কেন ভয় পাব।

আসলে রাত আমার অনেক প্রিয়। তাও যদি হয় জোছনা রাত। দেশে আসলেই এখানে ছুটে আসি। প্রত্যেকবার বাবা সাথে থাকেন। এবার তুমি। জোছনা আর বৃষ্টি দুটোই আমার প্রিয়। পুকুরের ওইপাড়ে ঠিক এরকম আরেকটি ঘর আছে। বলতো সেটি কেন?

একেকদিন একেক ঘরে অবকাশ কাটানো।

গাধা, মোটেও তা নয়। এই ঘরটা ছনের। এখানে নীরবতার জন্য বসি। আর ওই ঘরটা টিনের চাল। ওখানে বসি বৃষ্টিতে। রিমঝিম শব্দে কান পেতে থাকি। জানো এই বাড়িটা নিয়ে আমার অদ্ভুত কিছু ফিলিংস কাজ করে। আমার মনে হয়, আমার মৃত্যু হবে এই বাড়িতে। বাবাকে বলেও রেখেছি। মরে গেলে কবরের উপরে দোচালা একটা ঘর করে দিতে পুকুরপাড়ে। দোচালার একপাশে থাকবে টিন, অন্যপাশে ছন। মরে গেলে তো আর উঠে উঠে জায়গা বদল করতে পারবনা। তাই এই ব্যবস্থা।

মরার কথা আসছে কেন, আশ্চর্য তো।

না এমনি বললাম। আমার মনে হয়, খুব বেশি মনে হয়। জানো আমি কয়েকবার স্বপ্নও দেখেছি। আমি পলকা তুলার মত ভাসছি এই দিঘীর পানিতে। আমার পাশে খেলে বেড়াচ্ছে রাজহাঁস। কিন্তু আমি উঠতে পারছিনা। নড়তে পারছিনা।
হাতঘড়ি দেখে নিল অবনী। চাঁদের আবছা আলোতেও রেডিয়ামের ডায়াল জ্বলজ্বল করছে।

আচ্ছা শোন। তোমাকে যে সারপ্রাইজের কথা বলেছি।

হ্যাঁ। কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা বড় কষ্টের। সেই কখন থেকে বসে আছি তোমার সারপ্রাইজ শুনতে।

হুম, এই যে এখন বাজে রাত এগারটা পঞ্চান্ন মিনিট। এখন থেকে ঠিক পাঁচমিনিট পরে আমার বয়স হবে পঁচিশ। আর এই এখনো পর্যন্ত আমি চব্বিশ।

ওয়াও, হ্যাপি বার্থডে ইন অ্যাডভান্স। বাট অবনী, ইটস নট ফেয়ার।

ফেয়ার নয় কেন?

তোমার বার্থডে জানতাম না আমি।

জানলে তো আর সারপ্রাইজ থাকত না।

তা ঠিক, বাট তোমাকে কিছু গিফট দিব না, তা কী করে হয়।

অবশ্যই গিফট দেবে, চাইলে দেবে তো?

চেয়ে দেখ। কেন নয়।

ধর যদি, এই পুরো তোমাকেই গিফট হিসেবে চাই। জান কোরবান করবে তো! হাহাহাহা। কী ছেলেরে বাবা। ভড়কে যাও কেন এত সহজে। আচ্ছা থাক লাগবেনা। সবাইকে দূরে থাকতে বলব। সবাই আসবে বারটা পাঁচ মিনিটে। তুমি বারোটা এক থেকে দুই, এই দুই মিনিট ধরে আমাকে কিস করবে। এটাই তোমার আমার পঁচিশ বসন্তের সবচেয়ে বড় গিফট। কী দেবে তো?

হুম। দেব। ডান।

ফিরে এসেছে সেই লোকটা। সঙ্গে পুরো একটা গানের দল। আরেক দল পাশেই কাঠ জ্বালানোর আয়োজন করবে। বারবিকিউ হবে। যখন যে কাবাব খেতে ইচ্ছে করবে বানিয়ে দেবে। একদল পানীয় এর ব্যবস্থা করবে। যদি ইচ্ছে করে এক দু’গ্লাস ছুঁয়ে দেখতে। সারা রাত গান হবে। গান যে একেবারে স্থানীয় আর মাটির গান তা দল দেখলেই বোঝা যায়। গামছা বাঁধা হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, একতারা আর দোতরা, বাঁশি, যন্ত্রের অনুসঙ্গ বলতে এই। এক পাউ-ের ছোট্ট একটা কেক আনা হয়েছে খামারবাড়ির স্টাফদের পক্ষ থেকে। সেটিতে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে।

অবনী সবাইকে ফিরে গিয়ে ঠিক বারটা পাঁচে আসতে বলল। মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল চারপাশ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবনী। টিক টিক টিক করে ঘুরছে সেকেন্ডের কাটা। শেষ মুহুর্তে নিজেই কাউণ্টডাউন শুরু করেছে অবনী। অবনীকে সুখী সুখী দেখাচ্ছে। মেয়েদের সুখী সুখী দেখালে চোখ চকচক করতে থাকে। মুখ উজ্জ্বল হয়। অবনীকে ঠিক সে রকম দেখা যাচ্ছে। ফাইভ, ফোর, থ্রি- টু, ওয়ান- জিরো। হ্যাপি বার্থডে বলার জন্য মুখ খুলেছি মাত্র, বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে জাপটে ধরে সেই ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে মুখ আটকে দিল অবনী। দূরে সমস্বরে গেয়ে উঠল গানের দল। খোল করতাল আর বাঁশি বাজছে। চিকন গলায় সুর করে একজন গাইছে…..
‘‘নেশা লাগিল রে, নেশা লাগিল রে
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে
হাসন রাজা পেয়ারীর প্রেমে মজিল রে।’’

চলবে…

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement