২৪ এপ্রিল, ২০২৪, বুধবার

ধারাবাহিক উপন্যাস : এখন অনেক রাত

Advertisement

পূর্ব প্রকাশের পর-

(দুই)
আগের দিন বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশের পর ঝাঁ চকচকে রোদ কুলাউড়ায়। পৌষের রোদ এতটা মিষ্টি হতে পারে আগে জানা ছিল না। সাতসকালেই ঘুম ভাঙল। জানালার ফাঁক গলে একফালি রোদ ছুঁয়ে দিল মুখ। চোখ খুলেই চারপাশে সবুজের ঘেরাটোপ। সারি সারি চা বাগান। রেইনট্রি। মন ভাল করা একটা সকাল। দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বারান্দায় গেলাম। রাতের সেই দুই যুবকের একজন ট্রেতে নাশতা সাজিয়ে হাজির।ঘুম ভাঙল স্যার।

জ্বি। আপনার নাম কী।

বাবু আমার নাম উপেন। উপেন্দ্রকিশোর।

খুব ভাল।

বড় সাব আপনারে সালাম দিছেন। ওইযে টিলার ওপর ঘরটা। ওখানে বসেন উনি।

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি নাস্তা রেখে যান। আমি আসছি।

ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সকাল সোয়া সাতটা। এই সাতসকালেই সেলিম আঙ্কেল অফিসে বসেছেন! হয়তো চা বাগানের নিয়মই এমন। চটজলদি নাস্তা সেরে ছুটে গেলাম অফিসে। ছোট্ট একটা টিলার ওপর বাংলো বাড়ি। ঠিক মাঝখানটায় একটা বৈঠকখানা। ডান দিকে ছোট ছোট কয়েকটি ঘর। অন্য অফিসারদের জন্য হয়তো। বাম দিকে ঢাউস আকারের দুটো ঘর। একটির সামনে নেমপ্লেট লেখা – আলাউদ্দিন চৌধুরী, মাননীয় সংসদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলাউদ্দিন টি এস্টেট লিমিটেড। আরেকটিতে লেখা – সেলিম চৌধুরী, ব্যবস্থাপক, আলাউদ্দিন টি এস্টেট।

স্লামালেকুম।
হাসিমুখে বসতে বললেন সেলিম আঙ্কেল।

তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে কাল মধ্যরাতে। তাড়াহুড়োয় থানা থেকে তো তোমার ফোন ওঠানো হয়নি। বলে দিয়েছি ভাল আছ। দেখি ওদিকে কেউ গেলে ফোনটা আনিয়ে দেব। আর হ্যাঁ শোন, তোমাকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেলস অফিসার পদে। এই নাও তোমার এপয়ন্টমেন্ট লেটার। বাকি দায়িত্ব অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার করিম সাহেব তোমাকে বুঝিয়ে দেবেন।
কৃতজ্ঞতাভরে চিঠিটা হাতে নিলাম। জীবনের প্রথম চাকুরি। তাও কোন ইন্টারভিউ ছাড়া।

বাবার পুরনো বন্ধু বলে হয়ত এই সুযোগটি তিনি করে দিলেন। এই মুহুর্তে চাকুরিটি খুব জরুরি ছিল আমার পরিবার বাঁচাতে। সংসারে আয় বলতে কিছু নেই। চিঠিটা খুললাম। গোটা গোটা টাইপে এক ফর্দ লেখা। নিচের দিকে দায়িত্ব আর সুযোগ সুবিধা। বেতন পনের হাজার টাকা। থাকা খাওয়া কোম্পানির। এই নিদানের কালে এই চাকুরিই যেন আমার কাছে সোনার হরিণ। উঠে গিয়ে সালাম করলাম সেলিম আঙ্কেলকে।

আরে বাবা থাক থাক।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই আঙ্কেল।

মন দিয়ে কাজ করতে থাক। চা বাগানের কাজে পরিশ্রম আছে, কিন্তু ব্রাইট ক্যারিয়ারও আছে। আমাদের গ্রুপের আরো চারটি চা বাগান আছে সিলেট-মৌলভীবাজার এ। এছাড়া শ্রীলংকায় আমরা একটা বড় প্রজেক্ট করছি সুন। মন দিয়ে কাজ কর। ভাল করলে ওখানেও ভাল বেতনে সুযোগ হয়ে যেতে পারে। আর শোন, আজ থেকে অফিসে তোমার আমার সম্পর্ক টোটালি অফিসিয়াল। নো আঙ্কেল। ওকে? বন্ধুর ছেলে বলে এক্সট্রা কোন বেনিফিট দিতে চাইনা আমি।

জ্বি আঙ্কেল।

আবার আঙ্কেল! স্যার বল স্যার। হাহাহাহাহাহা।

দুজনেই হেসে উঠলাম একসাথে। হাসির দমক থামতেই বেল টিপলেন। একজন উর্দি পরা বেয়ারা ছুটে আসল পড়িমরি করে।

দু কাপ চা দাও। আর করিম সাহেবকে একটু আসতে বল।

জ্বি স্যার।

প্রথম দিনেই বুঝে নিলাম দায়িত্ব। জেনারেল ম্যানেজারের ঠিক উল্টো দিকের ছোট্ট একটা কামরায় আমার বসার ঘর। একটা ছোট্ট টেবিল- পুরনো আমলের নকশাদার চেয়ার। চা প্রসেস হওয়ার পর প্যাকেজিং থেকে আমার দায়িত্ব শুরু। বড় মাপের নিলাম ছাড়াও আলাউদ্দিন টি এস্টেট সম্প্রতি প্যাকেটজাত চা বাজারে এনেছে। নিলামের দেখভাল থেকে শুরু করে প্যাকেট চা বাজারজাত পুরোটাই দেখার দায়িত্ব আমার। এসিসট্যান্ট ম্যানেজার আবদুল করিম মধ্যবয়সী। বেশ দিলখোলা মানুষ। প্রথম দিনেই হাসি ঠাট্টার ছলে অনেকখানি কাজ বুঝিয়ে দিলেন। প্রথম দিনে কিছু হিসাব নিকেশ আর ফাইলপত্র দেখেই কাটল। দুপুরের পরে তিনজন পাইকারের সাথে চলল দেন দরবার।

বিকেল নাগাদ অখ- অবসর। বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। কাল রাতে এসেছি। সকাল থেকেই বন্দী একটা ঘইের। দুপুরে খাবার জন্য আধা ঘন্টার বিরতি। ভাল করে দেখা হয়নি এলাকাটা। মাঝখানের টিলা থেকে নেমে আশপাশে আরো ছোট ছোট টিলা। রেইনট্রির ফাঁক দিয়ে কুয়াশা ঢাকা রোদ ঠিকরে পড়ছে কচি চা পাতার ডগায়। অদ্ভুত সুন্দর বিকেল। নিরুদ্দেশ হবার জন্য এমন একটি বিকেলই যথেষ্ট। অথচ আমরা কত সোনালী বিকেলকে গলা টিপে হত্যা করি অখ- অবসরেও। ফিরে ফিরে আসা এমন সোনালী বিকেল উপভোগ করতে পারার নামই তো জীবন। কিন্তু সেভাবে উপভোগ করার মন, দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাললাগার চোখ আছে ক’জনের।

হাঁটছি উদ্দেশ্যহীন। টিলার ওপারে ছোট ছোট কুড়ে ঘর। সারিবদ্ধ দাঁড়ানো জীর্ণ কুঁড়েঘরের সামনে আধা ন্যাংটো শিশুদের জটলা। হঠাৎ সানাই আর ঢাক ঢোলের শব্দে ঘুরে তাকালাম। পিছনের আরেকটি টিলার গা ঘেষা হাঁটা পথে জনা ত্রিশেক মানুষের মিছিল। মাঝখানে লাল শাড়ীতে আবৃত এক কিশোরী। তার পাশে শাদা ধূতি পাঞ্জাবি পরা এক কিশোর। মাথায় টোপর। বরযাত্রী বুঝতে আর বাকি রইলনা। হয়ত এক বাগানের শ্রমিকের সঙ্গে অন্য আরেক বাগানের শ্রমিকের আত্মীয়তা হল। লাল শাড়ি পরা নারীরা কোরাস গাইছে। দ্রুত হেঁটে টিলার পেছনদিকটায় চলে গেল বরযাত্রীরা। সূর্য পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। রক্তিম চাদর জড়িয়ে পৃথিবীকে শক্ত করে আগলে ধরতে ছুটে আসছে কুয়াশার দল।

জীবনকে হঠাৎ অনেক সুন্দর মনে হল। জীবন হয়ত এমন সুন্দর বলেই মানুষ বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ছুটে বেড়ায়। বাঁচতে চায় নিজের মত করে। কিন্তু কতজন পারে নিজের মত করে নিজের জীবনকে উপভোগ করতে। কতজনই বা পারে মনের মত মানুষের সঙ্গে জুটি বেঁধে একটা জীবন হাসি-আনন্দ-দুঃখ ভাগাভাগি করে পার করে দিতে। পরিবার, সমাজ, ধর্ম কত অদৃশ্য শেকলে বাঁধা জীবনে তাই মানুষ হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলতে থাকে। ইচ্ছেগুলোকে কবর দিয়ে হাসিমুখে মেনে নেয় রসকসহীন এক অনাড়াম্বর জীবন।

যে জীবনে শুধুই খেয়ে পরে বাঁচার লড়াই, টিকে থাকার লড়াই। এ জীবনে কোন প্রেম নেই, বোধ নেই, হাহাকার নেই- দুঃখবিলাস নেই। ছকে বাঁধা এক জীবনের ক্লান্তি নিয়ে মানুষ ঘুমিয়ে যায় একসময়। নিজের জন্য, আশপাশের মানুষের জন্য তার দেয়ার থাকেনা কিছুই। নেয়ারও থাকেনা তেমন। শোকস্তব্ধ স্বজনরা ঘুরে দাঁড়ায় দ্রুতই। তাদেরও যে বাঁচতে হবে। টিকে থাকতে হবে গিরগিটির মত। আমিও কী তবে হাঁটছি সে পথেই!!

হাঁটতে হাঁটতে কখন চা বাগানের চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। কাঁটাতারের বেড়ার ছোট ফটক পেরিয়ে জেলাবোর্ডের সড়ক। দূরে সন্ধ্যাবাতি জ্বলছে মিটিমিটি। চারপাশ বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে দু’একটি রিকশা বা বাইসাইকেল টুংটাং বেল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। রিকশার পেছনে জ্বালানো হ্যারিকেন নিবু নিবু। ঘোলাটে কাঁচ ঘিরে রেখেছে দাউ দাউ আগুনের মুখ। রোগা পটকা সলতেয় মিটিমিটি জ্বলছে যেন হাঁপানিতে শ্বাসটানের রুগী, এই বুঝি দম ফুরলো। এদিকটায় যানবাহনের চাপ নেই তেমন। মাঝে মধ্যে দু’একটা অটোরিকশা, দূরের ব্রিক ফিল্ডের ট্রাক দৈত্যের মতো ছুটে আসছে একচোখা হেডলাইড জ্বালিয়ে। পুরো চা বাগান কাঁপিয়ে দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের অন্ধকারে।

রাত বেশি হয়নি। এশার আজান পড়ছে দূরের মসজিদ থেকে। হাটুরেরা এক হাতে টর্চ আর অন্যহাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরছে দলে দলে। আধামাইল দূরে বেশ খানিকটা আলোর রেখা। সারি সারি বিজলী বাতি। ওদিকটায় সম্ভবত বাজার। হাঁটছি আনমনে। দুধারের ঝোপ জঙ্গল থেকে ঝিঁঝি পোকার সম্মিলিত ডাক ভেসে আসছে থেমে থেমে। থোকা থোকা জোনাক পোকা। এমন নির্জন নির্মল শান্ত প্রকৃতির রুপ দেখা হয়নি কখনো। ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছি শহরেই। ঢাকার অলি-গলি, শহুরে জীবন, ইট-কাঠ পাথরের ছন্দবন্ধ জীবন ছেড়ে এ কোন জীবনে এসে পড়লাম আমি।

আকাশে চাঁদ নেই। আবছা অন্ধকারে ঘরমুখো মানুষগুলোর মুখচ্ছবি যেন একেকটি বাংলাদেশ। শত কষ্ট, বঞ্চনা, হাড়ভাঙা খাটুনির পর বেলাশেষে বাজারের ব্যাগ হাতে ফেরা মানুষগুলোর এত সুখী সুখী চেহারা পৃথিবীর আর কোথাও কী মিলবে? আমার তা মনে হয় না।

হাঁটতে হাঁটতে বাজারের কাছে চলে এসেছি। ছোট্ট একটা বাজার। গোটা বিশেক হরেক রকম দোকান। দু’তিনটি চায়ের দোকানে টেলিভিশন চলছে। উৎসুক মানুষ চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে ভারতীয় সিরিয়াল, বাংলা সিনেমা অথবা টকশো দেখছে। এটাই তো এসব মানুষের একমাত্র বিনোদন। চায়ের দোকানের পর একটা গলিতে সবজিবাজার। তার থেকে একটু এগুলে বড় ট্রেতে মাছ নিয়ে বসে আছে ক’জন জেলে। সবজি দোকানের গলি পেরিয়ে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। দোকানের বাইরে গুড়ের জিলেপি, পুরি আর পেয়াজু ভাজা হচ্ছে। কারিগর একাগ্রমনে জিলেপির প্যাঁচ বুনে চলেছে। চা খেয়ে গেলে কেমন হয়? চায়ের দেশের চায়ের দোকান।

চায়ের দোকানে ঢুকবো, হঠাৎ দোকানের বারান্দায় কোনার দিকে একজন বয়স্ক মানুষ নজর কাড়ল। গোটা চারেক ডিম নিয়ে বসে আছেন। বয়স ষাটোর্ধ। চোখ কোটরে। পরনে ছেড়া ময়লা একটা পাঞ্জাবি আর লুঙি। লোকটাকে দেখে কেমন যেন মায়া লাগল। বাবার কথা মনে পড়ল হঠাৎ। বাবাও কী ষাটের পরে গ্রামের কোন নির্জন বাজারে আবছা আলোতে ক’টা ডিম নিয়ে বিক্রির আশায় বসে থাকবেন! এগিয়ে গেলাম সামনে।

চা বাগানেই আমার খাবার আয়োজন। রান্না বান্নার ঝামেলা নেই। বাগানের কর্মচারীরাই সব ব্যবস্থা করে দেন। আচ্ছা একটা ছোট কেতলি আর আনুসাঙিক কিছু জিনিস নিয়ে ফিরলে কেমন হয়। থাকার জায়গা থেকে একটু দূরেই রান্না ঘর। রাত জাগলে চা বানিয়ে খাওয়া যাবে। কেতলিতে ডিমও সিদ্ধ করে ফেলা যাবে অনায়াসে। বৃদ্ধের কাছে গেলাম। তিনি কোটর থেকে চোখ বের করে আমার দিকে চাইলেন। সে দৃষ্টিতে শুধুই শূণ্যতা ছাড়া আর কিছু দেখিনি।

ডিম কত চাচা?

এক হালি নিবাইন?

জ্বি। পুরোটাই নিব।

বিশ টাকা দিয়েন বাজান।

ডিম কী এই চারটাই আছে আপনার কাছে?

জ্বি বাজান। ছয়ডা মুরগি আছিল। ব্যারামে একটা মরলো। কানছি তারে ধইরা। বড় আদরের মুরগি ছিল। এখন পাঁচডা মুরগি। তার মইদ্যে ডিম দেয় চাইরডা। দুপুরে ডিম দেয় বিকেলে বেচতে আনি।

ওহ, ঠিক আছে। ডিম দিয়ে দেন।
কোচর থেকে আধা ময়লা একটা ছোট পলিথিনে ভরে দিলেন ডিম। টাকা বুঝিয়ে দিতেই উঠে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধের কাঁধে হাত রাখলাম।

কী নাম আপনার চাচা।

নওশের আলী।

ছেলেমেয়ে নাই?

আছে। যার যার তার তার। দুই ছেলে। এক মাইয়ার বিয়া দিছি গোলাপগঞ্জ। জামাই সিলেট শহরে রিকশা টানে।

ওহ আচ্ছা। ছেলেরা কী আপনার সাথে থাকেনা?

ছোট ছেলে থাকে বাজান। ছোট ছেলে পঙ্গু। কাম কাজ করতে পারেনা। জন্মের থেকে হের মাথার ঠিক নাই। গেলবছর টাইফয়েড হয়া শরীরের একপাশ অবশ। বড় ছেলে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে কামকাজ করে। ওখানেই থাকে। মাঝে মইদ্যে বাড়ি আসে।

ওহ, কতদূরে বাড়ি আপনার।

এই তো হাইটা গেলে এক ঘন্টা। গেরামের পথ। ডিস্টিক্ট বোর্ডের রাস্তা ছাড়ায়া বনের মধ্যে দিয়া তিন মাইল।

ওহ মাই গড, এত রাতে কিভাবে যাবেন।

বাজান অভ্যেস আছে।

বৃদ্ধ হাঁটা শুরু করলেন। আমি পাশের বেঞ্চে বসালাম। ঠোঙায় গুড়ের জিলেপি ভরে দিলাম। নেব না নেব না করেও নিলেন আমার চাপাচাপিতে।

বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে খাইয়েন চাচা।

চোখের কোনা বেয়ে দু’ফোটা জল ছিটকে বেরুনোর মুহুর্তে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা হাঁটা দিলেন উল্টো পথে। আমিও গলা চড়ালাম।

কাল থেকে আপনি অন্য কারো কাছে ডিম বেচবেন না। আমি নিবো। আপনি এসে চায়ের দোকানে বসবেন। আমি আপনাকে খুঁজে নিব।

একবারও পেছনে তাকালেন না বৃদ্ধ। হয়তো জীবনের প্রতি অভিমান। পরিহাসের প্রতি ক্ষোভ। গট গট করে হেঁটে বাজার ছাড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। মনটা খারাপ লাগছে ভীষণ। ডিম হাতে চা বাগানের টিলায় রওনা দিলাম। শেষ চায়ের দোকানটার একটা ঝাঁপ নামানো। লোকজনও কমে গেছে বেশ। শীত জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। দোকানের ভেতর বড় একটা ডেকসেট। গান বাজছে হাই ভলিউমে।

দুনিয়াকা মজা লে লো– দুনিয়াকা ….।

আসলেই এ দুনিয়ার মজা হয়তো এ মানুষগুলোই নিতে পারে। সারাদিন পরিশ্রম, ব্যস্ততার পর সন্ধ্যায় অখন্ড অবসর। বাজারে খোশগল্প, হাসি ঠাট্টা, রাজনীতি, ভোট, মাঝরাতে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাত খেয়ে শান্তির ঘুম। এর চেয়ে আর যে বেশি চাওয়া নেই এই মানুষগুলোর। চাওয়া পাওয়ার মধ্যে ব্যবধানটা কম বলেই এ মানুষগুলো সুখী।

কিন্তু আমরা! যারা শিক্ষিত, শহুরে মানুষ! আমাদের চাওয়ার কোন অন্ত নেই। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার বিস্তর ব্যবধান। আর সে ব্যবধানই নিয়ে আসে অশান্তির বারতা। সুখের অভিনয় করে যেতে যেতে একসময় শহুরে মানুষগুলো ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ে। সুখের ভান করতে গিয়ে রোগা হয়ে পড়ে। ভেতরকার অসুখী ভুতগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়, আর তা থেকে পালিয়ে বাঁচতে আমরা ছুটে বেড়াই মরীচিকার পেছনে। সেই পথের কোন শেষ নেই। সমাপ্তি নেই।

একদিন স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আমরা শেষ করি স্বপ্নের দিনলিপি। শেষটায় এসে তলানিতে কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা আর আমাদের। শূন্য, রিক্ত বিদায়ে শেষ হয় একজীবন। যে জীবনে কিছু দেয়ার না হোক, অন্তত কিছু নেয়ার কথা থাকলেও, শেষতক যোগফল শূন্য নিয়েই কেটে যায় । এমন জীবনের সত্যিই কী খুব বেশি প্রয়োজন!

এলোমেলো ভাবনারা এসে ঘিরে ধরে চারপাশ। বৃদ্ধের কাছ থেকে কেনা ডিম হাতে নিয়ে হাঁটছি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে এই চারটে ডিম হয়তো বেচতেন না তিনি। মুরগি ডিমে তা দিত। আরও চারটি নতুন মুরগি যোগ হত বৃদ্ধের খোয়াড়ে। কিন্তু সে সামর্থ তো তার নেই! আচ্ছা কেমন হয়, আমি যদি বৃদ্ধের কাছ থেকে ডিম কিনে আবার তাকেই দিয়ে দেই! তাহলে কী তিনি অন্য আরেকজনের কাছে তা বিক্রি করে দিবেন! হতেও পারে। অভাবের ঘরে কুড়ি টাকাই বা কম কী! আজগুবি সব ভাবনা। হাঁটতে হাঁটতে টিলার কাছে চলে এসেছি। দৌড়ে সামনে আসল উর্দ্দি পরা সেই উপেন।

বাবু, কোথায় গিয়েছিলেন। আপনাকে লিয়ে হামরা তো বহুত টেনশনে।

আরে না উপেন। হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে চলে গেছিলাম।

ওহ, বাবু বলে যাবেন না। আন্ধার রাত। কত কিছু তো ঘটতে পারে।

ভেবোনা উপেন। তোমাদের এখানকার মানুষজন খুব ভাল।

খেয়ে নিন বাবু। সব সাজানো আছে।

ওকে ঠিক আছে তুমি যাও। আমি খেয়ে নিব।

বাবু, এই নিন আপনার ফোন। ম্যানেজার সাহেব আনিয়ে নিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, বাবু আসলে যেন সাথে সাথে দিয়ে দেই।

উপেন চলে গেল। ঘরে বাতি জ্বালাইনি। অন্ধকারটাই ভাল লাগছে এখন। কিছু কিছু সময় নিজেকে অন্ধকারের হাতে ছেড়ে দিলে ভেতরের আলোটা জ্বলে ওঠে দপ করে। খেতে ইচ্ছে করছেনা। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে জানালার কপাট খুলে দিলাম। কুয়াশা আর হিম বাতাস শীতল করে দিচ্ছে ঘর। খারাপ লাগছে না। টিলার ওপরের এই ঘরটার পেছন দিকের রেইনট্রিগুলোর আবছায়া কেমন একটা ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করছে। ডা. পারমিতার পরিবারটির কথা মনে পড়ছে খুব। পলি মেয়েটার কিশোরী চোখ, চাহনি কেমন যেন ডেকে নিয়ে যাচ্ছে অন্য কোন জগতে। পকেট থেকে ফোন বের করলাম। ওলালেটের গোপন ভাঁজে রেখে দেয়া চিরকুট থেকে নাম্বার টুকে নিলাম ডায়ালে। সেভ করলাম, ডা. পারমিতা। একটা বিপ হতেই ওপাশে ডা. পারমিতার গলা।

হ্যালো স্লামালিকুম।

স্লামালেকুম আন্টি। আমি সাগর।

ওহ, হ্যাঁ সাগর। কী খবর বাবা। দেখেছে, সেদিন কিন্তু তোমার নাম্বার বা ঠিকানা কিছুই নেয়া হয়নি। তুমি যদি বুদ্ধি করে ফোনটা না দিতে।

জ্বি আন্টি। খুব মনে পড়ছিল আপনাদের কথা।

হুম, আমরাও বলি তোমার কথা। বিশেষ করে পল্লব তো সারাক্ষণ– সেই ভাইয়া, সেই ভাইয়া। আসলে কাউকে একজনমেও চেনা যায়না, আবার কাউকে মুহুর্তেই আপন করে নেয়া যায়। তুমি ঠিক তেমন একজন।

হাহাহাহা, কিন্তু আমার মধ্যে তেমন কিছু কী আছে আন্টি।

হুম আছে, আর আছে বলেই হয়তো একদিনের পরিচয়ে এমন আপন করে নিয়েছো। ওহ হ্যাঁ, পল্লবের সাথে কথা বল।

হ্যালো ভাইয়া, স্লামালেকুম। আমি পল্লব।

ওয়ালেকুম সালাম, কেমন আছো ভাইয়া।
আর উত্তর পেলাম না। কিছুটা টানা হেঁচড়ার শব্দ শুনলাম। পল্লব বলছে- এই দাঁড়া, দাঁড়া আপু। তারপর কিছুক্ষণ সাড়া শব্দ নেই। কান পেতে আছি। খানিক নীরবতার পর সেই কাঙ্খিত গলা।

হ্যালো।

হ্যালো। পলি।

হুম।

কেমন আছো?

ভাল না।

কেন!!

আপনি ভুলে গেছেন তাই।

হাহাহাহা, কী করে ভুলি বল। এইতো ফোন দিলাম।

হুম দিলেন, কিন্তু ফোনটা কী আগেই দেয়া উচিত ছিলনা?

হয়তো, এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সারাদিন পর এইযে নিজের ঘরে আসলাম। অন্ধকার চারপাশ। বাতি জ্বালাইনি। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে রেইনট্রির আবছায়া দেখছিলাম। হঠাৎ তোমার কথা মনে হল খুব।

আমার কথা!! শুধু আমার কথা কেন!!

না মানে ইয়ে, তোমাদের কথা।

হাহাহাহাহাহাহাহাহাহ।

এমন প্রাণখোলা হাসি শুনিনি কখনো। ট্রেনের কয়েকঘন্টার জার্নিতে পলির মুখে কথা শুনেছি একদুটো। সেই পলি কত প্রাণ খুলে হাসতে পারে, কথা বলতে পারে- ফোন না করলে জানা হত না। আসলে মানুষকে বাইরের দেখা থেকে ভেতরের মানুষটাকে আলাদা করে খুঁজে নেবার নামই তো প্রেম। সবাই হয়ত একটি মানুষের ভেতরে বাইরে একই দেখে, কিন্তু যারা খুব কাছের তারাই কেবল খুঁজে নিতে পারে ভেতরের অন্য মানুষটাকে।

চুপ হয়ে গেলেন যে? কী ভাবছেন।

নাহ, তেমন কিছুনা।

খেয়েছো রাতে?

না, খাব। আপনি?

খেতে ইচ্ছে করছেনা।

মানে কী! ওঠেন। খেয়ে নেন।

ভাল লাগছে না।

আমি বলছি ওঠেন। খেয়ে নেন। নিজের প্রতি এমন অবহেলা কিন্তু আমি সহ্য করতে পারিনা। উঠবেন তো এখন? রাখলাম।

রাখলাম মানে? কথা বলতে ভাল লাগছে না?

আপনি না খেলে কথা বলব না।

কেন?

এমনি। আমার ইচ্ছা।

এমন ইচ্ছা কেন।

জানিনা। আপনি খাবেন কী না বলেন। এত কথা ভাল লাগছে না।

আমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না?

ধ্যাত!! রাখলাম। খাবেন কী না বলেন আগে।

ওকে, খাব।

থ্যাংকস। গুড বয়।

উঠুন। খেয়ে নিন। আর শুনুন, আমার কিন্তু ফোন নেই। মার ফোনেই কথা হবে।

ঠিক আছে, ভাল থেক।

ওকে, আপনি খাবেন কিন্তু, ভাল থাকবেন। এই যে, শুনুন, মা কথা বলবে।

হ্যাঁ বাবা, বল। শোন, জব কেমন লাগছে তোমার।

ভাল আন্টি। প্রথম দিন তো । কাজ বুঝে নিতে সময় লাগবে।

শোন, তুমি এর মধ্যে সময় করে হবিগঞ্জ ঘুরে যাও।

আসব আন্টি একদিন।

এভাবে বলবা না, কবে আসবা বল।

আসব আন্টি, মাত্র তো কাজে ঢুকলাম। কটা দিন যাক। ছুটি মিললেই চলে আসব।

ওকে বাবা, ফোন দিও। ভাল থেকো।

ওকে আন্টি, স্লামালেকুম।

পলির সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তা বলা হলনা। লাইনটা কেটে গেল। পলির সঙ্গে প্রথমবারের কথা। কেমন যেন ঘোর লাগানো, মায়া মায়া। খাবনা শুনে কী যেন শাসনের গলা। খেতে হবে। কৈশোরের প্রেম বুঝি এমনই হয়। পলির প্রতি কী আমিও দূর্বল হয়ে পড়ছি। পলি তো অন্য কিছু ভেবেও এমন আপন সুরে কথা বলতে পারে! শুধু শুধু কেন ভাবছি যে সে আমার প্রেমে পড়েছে। থাক, যা ঘটার ঘটুক। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ, নিজের সঙ্গে নিজের জবাবদিহীতা, প্রশ্নোত্তর আদান প্রদান চলতেই থাকুক। মার সঙ্গে কথা বলা দরকার। ডায়াল বের করে মার নাম্বারেই ফোন দিলাম। দুপুরে মা একবার ফোন দিয়েছিল। সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে মিটিংএ থাকায় ধরা হয়নি। পরে আর ব্যাক করাও হয়নি।

হ্যালো মা।

কেমন আছিস। ফোন দিছিলাম। ধরিসনি ক্যান।

মা, মিটিংএ ছিলাম। তুমি কেমন আছো?

ফিঁচ করে কেঁদে দিলেন মা। মার এই ফিঁচকাদুনে স্বভাব ছোটবেলার। সামান্য কিছুতেই ফিঁচ করে কেঁদে দেবেন। ছোট্ট একটা খারাপ খবর শুনেই বুকে হাত দিয়ে বিছানায় পড়ে ফিট হয়ে যাবেন। ধরা যাক গ্রামের বাড়িতে ছোটমামার ছাগল খেতের বিষ খেয়ে মরে গেছে, মা শুনলেন, ব্যাস। বুক ধড়ফড়ানি শুরু। তারপর বুকে হাত চেপে ফিট। মাথায় পানি ঢালো, ডাক্তার আনো, ঘন্টা দুয়েক পর সব ঠিক। একারনে মা’র এই কান্না আমরা দেখে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ খারাপ লাগছে কেন তবে! হয়তো দূরে তাই।

মন খারাপ করোনা মা। আমি ঠিক আছি। এখানে কাজের একটু চাপ থাকলেও জায়গাটা সুন্দর। মানুষগুলোও ভাল।

খেয়েছিস?

না মা, খাইনি। খাব।

খেয়ে নে। বেশি রাত জাগিস না। আর রাতে দরজা জানালা চেক করে শুবি।

বাবা কেমন আছে মা?

ভাল- নে কথা বল।

নতুন চাকুরির খোঁজ খবর নিলেন বাবা। বেশ খুশি মনে হল তাকে। সেলিম আঙ্কেলের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানালেন কয়েকবার। কথা শেষ করে বাতি জ্বালিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম। সাতকড়া দিয়ে মুরগির মাংস। অসাধারণ টেষ্ট। সঙ্গে সবজি, ডাল, আলু ভর্তা। জানালা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছি। ঘুম আসছেনা। বাতিও নেভালাম। চিৎ হয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। এখন যদি পলির হাতে ফোনটা থাকতো। ভাল লাগছে না কিছুই।

পলিকে এত মনে পড়ছে কেন। বার বার যেন মনের জানালায় এসে টোকা দিচ্ছে পলি- সাগর শুনছো? এ্যাই সাগর, শুনছো। আমি শুনছি, কিন্তু উঠে জানালা খোলার সাধ্য আমার নেই। বিছানায় যেন হাত পা অবশ হয়ে পড়ে আছি। চিৎকার করে বলছি- পলি আমি উঠতে পারছিনা। তুমি প্লিজ এই জানালাটা দিয়ে ভিতরে আসো। প্রাণপন গলা ছেড়ে বলছি। কিন্তু পলি শুনতে পাচ্ছেনা। জানালার ওপাশ থেকে শুধু ডেকেই যাচ্ছে- এ্যাই সাগর। এ্যাই সাগর শুনছো। চিৎকার করে পলিকে ডাকতে ডাকতে কখন ঘুমের অতলে হারিয়ে গেছি জানিনা।

চলবে…

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement