১৯ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

এলসি মার্জিন বাড়ছে বিলাসী পণ্যের

Advertisement

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে আরও কঠোরতা আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজার, বিলাসী ও কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সার্বিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে।

কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য কী পরিমাণে আমদানি হয়েছে, সেগুলোর চাহিদা কেমন এসব বিষয়ও দেখা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আরও কিছু বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাড়তি এলসি মার্জিন আরোপ হতে পারে। একইসঙ্গে ওইসব পণ্যের এলসি খুলতে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় করা বন্ধ করে দিতে পারে।

বর্তমানে রিজার্ভ আছে ৪২৪০ কোটি ডলার, যা দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই তাকে আগে নিরাপদ ধরা হতো।

বর্তমানে আইএমএফ মনে করে বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হবে। তবে খাদ্য আমদানি করলে রিজার্ভ আরও বেশি থাকতে হবে। বাংলাদেশকে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে দেড় হাজার কোটি ডলারের খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণে আরও বেশি রিজার্ভ থাকতে হবে। কিন্তু রেমিট্যান্স কমা ও আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। উলটো কমে যাচ্ছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছর শেষে রিজার্ভ ৫২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে চেয়েছিল, যা দিয়ে ৭ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো।

কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেদিকে যেতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে রিজার্ভ ধরে রাখতে ডলারের আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে অন্যান্য খাতে রিজার্ভের ব্যয় কমানোর প্রচেষ্টা চলছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে বিভিন্ন সংকটে রিজার্ভ সাশ্রয় করতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল সেগুলো এখন পর্যালোচনা করছে। এর আলোকে ব্যবস্থাও নিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে ইতোমধ্যে ৭৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। আরও কিছু বিলাসী পণ্যের ওপর শতভাগ মার্জিন আরোপেরও চিন্তুাভাবনা হচ্ছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জানা গেছে, ডলার সাশ্রয় করতে ইতোমধ্যে আবশ্যকীয় ছাড়া সব পণ্যে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার, কৃষি উপকরণ, খাদ্যপণ্য ছাড়া অন্য খাতে ডলার দেওয়া বন্ধ ও বিদেশ ভ্রমণে ডলার ছাড়ে কড়া বিধিনিষেধ দেওয়া আছে। সরকার থেকেও বিদেশ ভ্রমণ ও বৈদেশিক অর্থ নির্ভর অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। এতেও ডলারের ওপর চাপ কমছে না। ফলে আরও বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রিজার্ভ সাশ্রয় করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

এখন যেহেতু রিজার্ভ খুব চাপে এ জন্য কিছু বিলাসী পণ্যে শতভাগ মার্জিন আরোপ ও এগুলোর বিপরীতে ঋণ বন্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু দেখা যাবে তারপরও এসব পণ্য আমদানি হবে। কারণ উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এসব পণ্যের গ্রাহক। ফলে বাড়তি দামেও ক্রেতা মিলবে বলে আমদানিকারক নগদ টাকায় এলসি খুলতে দ্বিধা করবে না।

দাম যতই হোক, আমদানি করলে লোকসান হবে না। এ কারণে এসব খাতে বহুমুখী নিয়ন্ত্রণ থাকাটা ভালো। এনবিআর যেটি আরোপ করেছে সেটি ভালো। তবে শুল্ক আরও বাড়ানো যেত। গড়ে ২০ শতাংশ শুল্কের কারণে এসব পণ্য আমদানি কমবে বলে মনে হয় না।

সূত্র জানায়, পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিলাসী কিছু পণ্যে আরও বেশি এলসি মার্জিন আরোপ করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০১ সালের নভেম্বরে রিজার্ভ সাশ্রয় করতে ৫৬টি পণ্যেও ওপর শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করেছিল। ওই সময়ে প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় হতো ৭৫ থেকে ৮০ কোটি ডলার। তিন মাসের আমদানির জন্য প্রয়োজন ছিল ২২৫ থেকে ২৪০ কোটি ডলার। কিন্তু রিজার্ভ ছিল ১০৯ কোটি ডলার।

তখন ৫৬টি পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করে। পণ্যগুলো হচ্ছে : বিস্কুট, চকলেট, লজেন্স, ইমিটেশন জুয়েলারি, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, কসমেটিক্স, ঘড়ি, (তবে দেশীয় শিল্পের জন্য ঘড়ির যন্ত্রাংশ করা যাবে), সব ধরনের ইলেকট্রিক্যাল ফ্যান, মোটর কার ১৮০০ সিসি এবং তার বেশি, পারফিউম, টিউব লাইট, খেলনা, পেটেন্ট এন্ড ফেরিনোয়াস, ফুড, শুকনো ফল, রেফ্রিজারেটর (৮ সিএফটির বেশি), বই (ইংরেজি ব্যতীত), নিউজ পেপার ম্যাগাজিন ও অন্যান্য প্রকাশনা, টেলিভিশন, রেডিও, টু ইন ওয়ান, আন্ডার গার্মেন্টস (পুরুষ ও মহিলা), জিপ (৪ হুইল ড্রাইপ) এবং ৩০০ এর ওপরে সিকেডি জিপ, প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য, মেলামাইন, মাইক্রো ওয়েব ওভেন, গ্যাস বার্নার (কুকিং), নিউজপ্রিন্ট, অন্যান্য পেপার, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ছাড়া টেক্সটাইল পণ্য, ফেব্রিক্স (কটন, সিনথেটিক্স, এক্সেসরিজ, সেলাই, সুতা, বোতাম, জিপার), অন্যান্য গ্লাসওয়ার, টেবিলওয়্যার, খাবার পানির গ্লাস, বলপেন, ডিপফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকুলার, এয়ারকন্ডিশনার, সিরামিক টেবিলওয়্যার, সিরামিক বাথটব, কাঠের আসবাবপত্র, আয়রন স্টিল, উল ও অন্যান্য, অব কাস্ট আয়রন নর্ব, এনামেল্ড ও অন্যান্য প্রেসার ল্যাম্প, হারিকেন, ভ্যাকুয়াম ফ্ল্যাক্স, টি-শার্ট, চশমা, ফুটওয়্যার, সিআই শিট, সিমেন্ট এবং মিল্ক ফুড।

এর আগে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে রিজার্ভ কমে গেলে শিল্পের কাঁচামালের ৩০ শতাংশ এবং বাণিজ্যিকভাবে আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করে। পরে তা শিথিল করা হয়। রিজার্ভ বাড়লে ২০০৩ সাল থেকে এলসি মার্জিন তুলে নিয়ে ব্যাংক গ্রাহকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রায় ১৯ বছর পর বৈশ্বিক কারণে রিজার্ভ সংকটে পড়ে আবার মার্জিন আরোপ করা হয়েছে।

ওই তালিকায় থেকে এবার আরও কিছু পণ্য বাদ যেতে পারে। যেমন নিউজপ্রিন্ট, প্লাস্টিকের পণ্যসহ আরও কিছু। কেননা এগুলো এখন শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে আরও কিছু বিলাসী পণ্য যোগ হতে পারে।

সূত্র জানায়, বিলাসী পণ্যে এর আগে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করেও খুব বেশি সুফল পাওয়া যায়নি। কিছু আমদানিকারক শতভাগ টাকা দিয়েই এলসি খুলেছে। কেননা, অভিজাত এলাকায় এসব পণ্যের অনেক ক্রেতা রয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে চুক্তির কারণে পণ্য আমদানির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের সুযোগ নেই। এ কারণে এসব পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাধা আরোপ করা যাচ্ছে না। তবে অশুল্ক বাধা সময় সময় সাময়িকভাবে আরোপ করার নজির রয়েছে। বাংলাদেশ এখন অশুল্ক বাধাই বেশি আরোপ করছে। এর মধ্যে এলসি মার্জিন, বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বন্দর ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি। তবে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা যেতে পারে। এনবিআরের অংশ হিসাবে ১৩৫টি পণ্যে ৩ থেকে ৩৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক আরোপ করেছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement