আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) বিনিয়োগের সুযোগ আর থাকছে না। সাধারণ ক্ষমার (ট্যাক্স অ্যামনেস্টি) সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে এ দুই খাতে বিনিয়োগ করলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা সরকারি অন্য কোনো সংস্থা অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে। চলতি অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি খাতে উৎসে কর বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আবাসন খাত ও পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের ‘বিশেষ’ সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেন। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ২৮৬ জন, জমিতে এক হাজার ৬৪৫ জন, ফ্ল্যাটে দুই হাজার ৮৭৩ জন এবং নগদ অর্থ প্রদর্শন করেছেন সাত হাজার ৫৫ জন।
চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রস্তাবিত বাজেটে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। কিন্তু আবাসন খাত ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তির মুখে বাজেট পাশের আগে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চূড়ান্ত বাজেটে অ্যামনেস্টি (সাধারণ ক্ষমা) সুবিধা বহাল রেখে ১০ শতাংশের পরিবর্তে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, এবার জরিমানা দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগে সাড়া পড়েনি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট দুই হাজার ২৯৩ জন কালো টাকা ও রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট প্রদর্শন করেছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এ থেকে সরকার দুই কোটি টাকা আয়কর পেয়েছে। সব মিলিয়ে এনবিআর এপ্রিল পর্যন্ত ১৫৩ কোটি টাকা আয়কর পেয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, নৈতিকতার দিক থেকে ট্যাক্স অ্যামনেস্টির পক্ষ অবলম্বন করতে পারি না। যদি অন্য কোনো খাতে অ্যামনেস্টি সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে পুঁজিবাজারেও সেই সুবিধা দেওয়া উচিৎ। এমনিতে চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ওপর জরিমানাসহ কর আরোপের ফলে বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। এ অবস্থায় অ্যামনেস্টি সুবিধা বাতিল করলে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেকেই আর অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। বর্তমানে ৪ পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালো টাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যেকোনো খাতেই কালো টাকা বিনিয়োগ করা যায়।
শুধু আবাসন খাতের জন্য ১৯ বিবিবিবিবি নামে আয়কর অধ্যাদেশে আলাদা একটি ধারা আছে। এ ধারা অনুযায়ী, এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা যায়। ১৯ডিডি ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করা যায়। ১৯এএএএএএ ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) সুবিধা দেওয়ায় ২০ হাজার কোটি টাকা এ খাতে এসেছে। চলতি অর্থবছরে সেটি উঠিয়ে নেওয়ায় মাত্র এক হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে আবাসন খাতে ইনডেমনিটি সুবিধা দেওয়া খুবই জরুরি। এতে দেশের অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ যুক্ত হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে।
কালো টাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। ’৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে এ থেকে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ’৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ’৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় চার কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
’৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১৯৯৭-২০০০ পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১-০৭ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা।
রপ্তানির উৎসে কর দ্বিগুণ হচ্ছে : এদিকে রপ্তানি খাতের উৎসে কর দ্বিগুণ হচ্ছে। বর্তমানে রপ্তানিকারকদের দশমিক ৫০ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হয়, এ সুবিধার মেয়াদ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। আগামী বাজেটে রপ্তানির উৎসে কর বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে।
সূত্রগুলো জানায়, ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে রপ্তানি পণ্যের দামও বেড়েছে। এ অবস্থায় উৎসে কর বাড়ানো হলে তা রপ্তানি আয়ের ওপর প্রভাব পড়বে না। তা ছাড়া প্রায় সব রপ্তানিকারকই উৎসে কাটা করের হিসাব অনুসারে আয় দেখান। এর ফলে বাড়তি আয় হলেও তারা আরকর দেন না। তাই উৎসে কর ১ শতাংশ নির্ধারণ যৌক্তিক।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ইউরোপের অনেক দেশ মন্দার আশঙ্কা করছে। এর প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয়েও। চলতি মাসে ৮০-৯০ কোটি ডলার কম রপ্তানি হবে। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে উৎসে কর বাড়ানো ঠিক হবে না।