১৮ এপ্রিল, ২০২৪, বৃহস্পতিবার

ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন: এক হতভাগিনী রাজকুমারীর মর্মস্পর্শী গল্প

Advertisement

প্রাক্তন রাজবধূ ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন। ১৫৩৬ সালে ৭ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের কিম্বল্টন ক্যাসেলে নির্বাসিতা অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তার একমাত্র মেয়ে লেডি মেরিও অনুমতি পায়নি মায়ের সঙ্গে দেখা করার। তবে কে ছিলেন এই ক্যাথারিন? কী ছিল তার নির্বাসনের কারণ? আর কেনইবা ‘রাজবধূ’ কথাটার আগে যুক্ত হলো ‘প্রাক্তন’ শব্দটি?

প্রখ্যাত রাজদম্পতি ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কথা মনে আছে? সেই স্পেনীয় রাজদম্পতির কথাই বলা হচ্ছে, যারা স্পন্সর করেছিলেন স্বয়ং ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে। তাদেরই ঘরের সবচেয়ে ছোট মেয়েটির নাম ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন। ১৪৮৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্পেনের আলকালা দে হেনারেস শহরে জন্ম হয় তার।

ক্যাথারিনের জন্মের চার মাস আগে ওয়েলসের সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডের মসনদ হাসিল করে টিউডর রাজবংশের পত্তন করে। আর মাত্র তিন বছর বয়সেই রাজনৈতিক কারণে হেনরির বড় ছেলে আর্থারের বাগদত্তা হতে হয় ক্যাথারিনকে! বাগদানের প্রায় এক দশক পর রাজকুমারী পাড়ি জমায় ইংল্যান্ডের উদ্দেশে। তার সঙ্গে থাকে বহুসংখ্যক পরিচারক-পরিচারিকা। তাদের ভেতর কাতালিনা দে কার্দোনেসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে ক্যাথারিনের অন্তঃপুরে দাসীর দায়িত্ব পালন করেন এই আইবেরিয়ান মুর।ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন

পথের নানা প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করে ১৫০১ সালের অক্টোবরে প্লাইমাউথে পৌঁছান ভাবী রাজবধূ। রাজা হেনরি মহাসমারোহে স্বাগত জানান তাকে। ঠিক তার পরের মাসের ১৪ তারিখে লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন আর্থার ও ক্যাথারিন। তখন তাদের দুইজনের বয়স মাত্র ১৫ বছর। বিয়ের পর নবদম্পতি শ্রপশারের লুডলো ক্যাসেলে বসবাস শুরু করেন। আর্থার সেখানে ‘কাউন্সিল অফ ওয়েলস’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।

বিয়ের পাঁচমাসের মধ্যে স্বামীকে হারান স্পেননন্দিনী! আর্থারের মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানা যায় না। কেউ বলে, আর্থার হাইপার হাইড্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। আবার অনেকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন যক্ষ্মাকে। কারণ যাই হোক। আর্থারের অকালমৃত্যু টিউডর রাজবংশের পরবর্তী ঘটনাবলি ও গতিপ্রকৃতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। আর তার থেকেও বেশি প্রভাবিত করে ক্যাথারিন অফ অ্যারাগনের জীবনকে।ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন

বড় ছেলের মৃত্যুশোকে কাতর রানি এলিজাবেথ। এরপর আরেকটি পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫০৩ সালে টাওয়ার অফ লন্ডনে একটি শিশুকন্যার অকাল প্রসবের পর তিনিও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এদিকে সদ্যবিধবা ক্যাথারিনকে স্পেনে ফেরত পাঠালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো রাজা সপ্তম হেনরিকে। আর রাজকুমার অষ্টম হেনরি অর্থাৎ আর্থারের ছোট ভাই।

এরপর আর্থারের ছোট ভাই অষ্টম হেনরির সঙ্গে ক্যাথারিনের বিয়ে হয়। তবে সেই বিয়ে দেওয়াটাও সহজ ছিল না, বিভিন্ন ধর্মীয় জটিলতার কারণে। তাই তিনি নিজেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন ক্যাথারিনকে। তবে মহারানি ইসাবেলার তীব্র বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ১৫০৯ সালে সপ্তম হেনরির মৃত্যুর পর অষ্টম হেনরি সিংহাসনে বসেন এবং অতিসত্ত্বর তার বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এজন্য অবশ্য তাকে পোপের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছিল।

ইতিহাসবিদদের মতে, তারা সুখী হয়েছিল-ক্যাথারিন ও হেনরি একসঙ্গে শিকারে যেতেন এবং তারা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করতেন। ইংল্যান্ডের প্রজাদের ভেতরেও তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল রানি ক্যাথারিনের। শুধুমাত্র প্রণয়সঙ্গিনী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক প্রতিভার জন্যও হেনরির আস্থাভাজন ছিলেন তার অর্ধাঙ্গিনী। ১৫১৩ সালে যখন রাজা ফরাসিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে দেশের বাইরে ছিলেন তখন স্কটল্যান্ডের চতুর্থ জেমস ইংল্যান্ড আক্রমণ করে। সেই সঙ্কট মুহূর্তে রাজ প্রতিনিধি ক্যাথারিন ইংরেজ সেনাদের উদ্দেশে এমন ভীষণ উত্তেজনা সঞ্চারী ভাষণ দেন যে, ঐ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিজয়ের নেপথ্যে ওনার অবদানকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখার অবকাশ থাকে না।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে হেনরি আর ক্যাথারিনের সংসারে আপাতদৃষ্টিতে অশান্তির কোনো কারণ ছিল না। তবে ভেতরে ভেতরে তাদের দাম্পত্য জীবন আস্তে আস্তে বিষময় হয়ে উঠছিল। আর তার কারণ ছিল, হেনরির পুত্রসন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং ক্যাথারিনের বারংবারের ব্যর্থতা। ১৫১০ থেকে ১৫১৮ সালের মধ্যে রানি মোট ছয়টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে লেডি মেরি বাদে বাকি সবাই শৈশবেই মারা গিয়েছিল বা মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল!

এই কারণে হেনরি ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তার দরুন বেশ কিছু অবৈধ সন্তানেরও জন্ম হয়। যাদের মধ্যে হেনরি ফিটজরয়-ই একমাত্র ভাগ্যবান যে রাজকুমারের মর্যাদা পেয়েছিল। তবে ক্যাথারিনের কফিনে শেষ পেরেকটি বিঁধেছিল তখন, যখন রাজা অষ্টম হেনরি অ্যান বোলিন নামক এক নারীর মোহপাশে আবদ্ধ হন এবং তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কারণ এতদিনের অবহেলা তখন অপ্রয়োজনীয়তায় পরিবর্তিত হয়, হেনরি তার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।অবশ্য এই বিবাহ-বিচ্ছেদের ভাবনার পেছনে আরো একটি কারণ ছিল। সেই কারণটিকেই যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে ১৫২৭ সালে পোপ ক্লেমেন্ট সপ্তমের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করেন তিনি।

হেনরির ভাষ্যমতে, যেহেতু তিনি নিজেরই বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন, যা কিনা খ্রিস্টমতাদর্শের পরিপন্থী তাই তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল অভিশপ্ত। আর ক্যাথারিনের গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব ইত্যাদি এই পাপ-পঙ্কিল বৈবাহিক সম্পর্কেরই চরম পরিণতি। ক্যাথারিন অবশ্য এই যুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি সর্বসমক্ষে নিজেকে হেনরির ধর্মসম্মত স্ত্রী দাবি করেন।

তিনি বলেন, যুবরাজ আর্থারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্ক তাদের ভেতর কখনোই গড়ে ওঠেনি। আর্থারের মৃত্যুর পরেও তিনি ছিলেন যথাবৎ কুমারী। রাজবধূ ক্যাথারিনের এহেন জবানি তাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অসংখ্য মানুষের সমালোচনা আর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু করে রাখে। সে যাই হোক, হেনরি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য তদবির বহাল রাখে। এদিকে পোপ ক্লেমেন্ট পড়েছিলেন মহা দোটানায়। কেননা, ক্যাথারিনের ঘর ভাঙায় সামিল হয়ে তার ভাগ্নে রোমান সম্রাট চার্লস পঞ্চমের রোষানলে পড়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না।ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন

অন্যদিকে অষ্টম হেনরির সঙ্গে শত্রুতার ফলাফলও যে পোপতন্ত্রের জন্য মোটেও মঙ্গলকর হবে না, সেটাও তার অজ্ঞাত ছিল না। তাই বিভ্রান্ত ও শঙ্কিত পোপ দীর্ঘ সাত বছরেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না। আর তার এই সিদ্ধান্তহীনতার জের ধরেই পত্তন ঘটে ইংলিশ রিফর্মেশনের। হেনরি ১৫৩৩ সালের জানুয়ারিতে অ্যান বোলিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন। যদিও তার আগের বছর ডোভারে তারা গোপনে বিয়ে করে রেখেছিলেন বলে গুঞ্জন শোনা যায়। বিয়ের পাঁচমাস পরে নবনিযুক্ত আর্চবিশপ থমাস কার্নমার ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন ও সপ্তম হেনরির বিবাহ বিচ্ছেদের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কারণ ইংলিশ রিফর্মেশনের ফলে ইংল্যান্ড, রোমান পোপতন্ত্রের এখতিয়ারের বাইরে চলে আসে।

হেনরির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর কিম্বল্টন প্রাসাদে নির্বাসিতা অবস্থায় তিন বছরের মতো বেঁচে ছিলেন ক্যাথারিন অফ অ্যারাগন। তার শেষ দিনগুলো যে কতটা দুর্বিষহ ছিল, তার আভাস শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের এই ট্র্যাজিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বহু বই, নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্রও।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement