২০ এপ্রিল, ২০২৪, শনিবার

‘আজ্ঞাবহ’ গভর্নর ফজলে কবিরের নিশ্চিন্তে বিদায়

Advertisement

মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর ফজলে কবির। টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দেশের ইতিহাসে আইন পরিবর্তন করে দ্বিতীয় মেয়াদে নিযুক্ত করা হয় তাকে। পুরোটা সময় ‘সহাবস্থানের’ বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফজলে কবির। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের কাছে ছিলেন ‘আজ্ঞাবহ’ গভর্নর।

বিদায় বেলায় আবেগাপ্লুত হয়ে গভর্নর বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার ছয় বছর তিন মাস পার হয়ে গেল। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন দায়িত্ব নিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার পর যখন দেশে ফিরছিলাম, বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রথম কাজ কী হবে? আমি বলেছিলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। এরপর কর্মকর্তাদের মনোবল চাঙা করা।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স অসাধারণ। অন্য কোনো দেশে এমনটি পাওয়া যায় না। এখানে অনেক মেধাবীর সমন্বয় ঘটেছে। দেশের অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমনটি দেখা যায় না। যা আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে পেয়েছি।

ফজলে কবির গভর্নর হিসেবে পুরোটা সময়ই আজ্ঞাবহ ও সহাবস্থান নীতি প্রদর্শন করেছেন। দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তেই আপত্তি জানাননি তিনি। সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান দুই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। সরকার যা চেয়েছে তা-ই করেছেন তিনি। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা, ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ব্যাংক পরিচালকদের জন্য আইন পরিবর্তন, সুদহার ৯ শতাংশ করা— কোনো ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তোলেননি ফজলে কবির

বিদায়ী গভর্নর বলেন, করোনার সময় অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সবার ধারণা ছিল টিকা কার্যক্রম শেষ হলে চ্যালেঞ্জ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জ তার কোনো সীমা নেই। আমি এক মেয়াদের চ্যালেঞ্জ রেখে বিদায় নিচ্ছি। আমার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে যিনি গভর্নর হবেন, তিনি মূল্যস্ফীতি ও ডলার রেটের মতো চ্যালেঞ্জ শক্ত হাতে মোকাবিলা করবেন।

২০১৬ সালের ১৫ মার্চ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তখনকার গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। কোনো আলোচনা ছাড়াই এর পরের দিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ সাবেক অর্থ-সচিব ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ফজলে কবির। সেই হিসাবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গভর্নর হিসেবে তার মেয়াদ তিন মাস ১৩ দিন বাড়িয়ে দেয় সরকার। যা ওই বছরের ৩ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল।

ওই সময় এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ফজলে কবির গভর্নর থাকবেন। পরে গভর্নর পদের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন সংশোধন করা হয়। ফলে ফজলে কবিরের মেয়াদ ২০২২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত বেড়ে যায়।

“আমি দেশের অর্থনীতির জন্য যা করতে পেরেছি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। তা হলো সম্মান ও ভালোবাসা। আমি সরকারের কাছ থেকেও অনেক সম্মান পেয়েছি। এর মধ্যে মুজিববর্ষ, পদ্মা সেতুর স্মারক নোটে আমার স্বাক্ষর রয়েছে। এটা অনেক সম্মানের”

“বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির”

হিসাব করলে দেখা যায়, প্রথম দফায় চার বছর, দ্বিতীয় দফায় তিন মাস ১৩ দিন এবং তৃতীয় দফায় এক বছর ১১ মাস ১৫ দিন অর্থাৎ মোট ছয় বছর তিন মাস গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ফজলে কবির।

ফজলে কবির ১৯৫৫ সালের ৪ জুলাই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে রেলওয়ের সহকারী ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকার সময় তিনি ছিলেন সচিব। পরে তাকে অর্থ-সচিব করা হয়।

স্ত্রী মাহমুদা শারমিন বেনু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। চাকরি শেষ হওয়ার একদিন আগে তাকে সচিব মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে, তিনি কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব ছিলেন না।

ফজলে কবির গভর্নর হিসেবে পুরোটা সময়ই আজ্ঞাবহ ও সহাবস্থান নীতি প্রদর্শন করেছেন। দায়িত্বে থাকাকালে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তেই আপত্তি জানাননি তিনি। সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান দুই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। সরকার যা চেয়েছে তা-ই করেছেন তিনি। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা, ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, ব্যাংক পরিচালকদের জন্য আইন পরিবর্তন, সুদহার ৯ শতাংশ করা— কোনো ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তোলেননি ফজলে কবির। অর্থাৎ তিনি যা করেছেন সবই ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ছিল প্রভাবশালীদের চাপও। এসব কারণে বেশ সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।

প্রথম দফায় চার বছর, দ্বিতীয় দফায় তিন মাস ১৩ দিন এবং তৃতীয় দফায় এক বছর ১১ মাস ১৫ দিন অর্থাৎ মোট ছয় বছর তিন মাস গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান ফজলে কবির।

ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকারের নির্দেশনা ছিল ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহার নয়-ছয় শতাংশে নির্ধারণ করা। যদিও সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দেবে না— এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই ১৯৯০ সালে। এটি ছিল সংস্কারের বড় একটি পদক্ষেপ। সারা বিশ্ব সুদহার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। অথচ, সরকার চেয়েছে বলে সুদহার নির্দিষ্ট করে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে, পরোক্ষভাবে সুদহার প্রভাবিত করার কিছু অস্ত্র সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকে। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (দ্য ফেড) যখন নীতিনির্ধারণী সুদহারে পরিবর্তন আনে, তখন সারা বিশ্বে এর প্রতিফলন দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া রাজনৈতিক নয়।’ এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যাংকারদের বিভিন্ন সভা হলেও সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো জবাব দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বতন্ত্রভাবে বসে শুধু ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করেছে।

বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিনির্ধারণী সব সিদ্ধান্ত নিজেরাই চূড়ান্ত করে। কিন্তু ফজলে কবিরের সময় এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াও পাল্টে যায়। কিছু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত হয় পাঁচ তারকা হোটেলে বসে, কিছু ব্যাংকমালিকদের সঙ্গে নিয়ে বা তাদের আগ্রহে কিংবা সরকারের নির্দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ ছিল শুধু আলোচনার নোট ঠিকঠাক টুকে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী নির্দেশনা জারি করা। এমন অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেকোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিরল। যা অত্যন্ত খারাপ নজির হিসেবে বিবেচিত হবে— বলছেন ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল, কিস্তি না দিয়েও নিয়মিত থাকার সুযোগ— এমন সব সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসায়ীদের কাছে প্রিয়পাত্র হিসেবে থাকবেন গভর্নর ফজলে কবির। পাশাপাশি ব্যাংকারদের বেতন বৃদ্ধি, ঢালাও প্রমোশনসহ নানাবিধ সুবিধা তাকে ‘মহানায়ক’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।

অভিযোগ আছে, ফজলে কবিরের আমলে ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের স্বেচ্ছাচারিতা, গুরুতর অনিয়ম ও বিচ্যুতিগুলো যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, তা এ খাতের সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করেছে। ঋণ জালিয়াতি, অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মে এ খাতে দৈন্যদশা বিরাজ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফজলে কবিরের সময়ে আর্থিক খাতে তেমন উন্নতি না হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে চালু হয় সচিবালয় প্রথা। ফাইল স্বাক্ষরের আগেই সংশ্লিষ্টদের কাছে ফোন করে বলা হতো অগ্রগতি ও উৎকোচের কথা। গভর্নর সচিবালয়ে চালু হয় ‘সিন্ডিকেট সচিবালয়’ প্রথা। বিশেষ বিশেষ গ্রুপের অনিয়ম না ধরে দেওয়া হয় অনৈতিক সুবিধা। এছাড়া ‘রাতের পাখি’ হিসেবে অভিহিত হন বিদায়ী গভর্নর। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত অফিস হলেও ফজলে কবির বেশির ভাগ সময় অফিস করেছেন দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা-৯টা; কোনো কোনো সময় রাত ১০টা পর্যন্ত।

গত ৩০ জুন নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হন গভর্নর ফজলে কবির। বলেন, ‘সাবেক গভর্নরদের কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নেই। তারা বলেন, এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে। অসম্ভব। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি।’

নতুন নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যোগদানের পর নতুন চারটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। যাচাই–বাছাই করেই তা দেওয়া হয়। একটি বাতিলও করা হয়। হয়তো অনেক অনুরোধ ছিল। কিন্তু কোনা চাপ ছিল না।’

খেলাপি ঋণের রেকর্ড

২০১৬ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ফজলে কবির যখন যোগ দেন তখন দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যোগদানের ঠিক তিন মাসের মাথায় খেলাপি ঋণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।

ফজলে কবিরের সময়ে আর্থিক খাতে তেমন উন্নতি না হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে চালু হয় সচিবালয় প্রথা। ফাইল স্বাক্ষরের আগেই সংশ্লিষ্টদের কাছে ফোন করে বলা হতো অগ্রগতি ও উৎকোচের কথা। গভর্নর সচিবালয়ে চালু হয় ‘সিন্ডিকেট সচিবালয়’ প্রথা। বিশেষ বিশেষ গ্রুপের অনিয়ম না ধরে দেওয়া হয় অনৈতিক সুবিধা। এছাড়া ‘রাতের পাখি’ হিসেবে অভিহিত হন বিদায়ী গভর্নর
২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে খেলাপি ঋণ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকায়।

এরপরই সরকারের নির্দেশনায় খেলাপিদের ঋণ নিয়মিত করতে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি কমাতে মাত্র দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্টের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়ে ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট- সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা- ২০১৯’ জারি করা হয়। এরপরও ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে মহামারি করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় ঋণের কিস্তি না দিয়েই খেলাপি নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সময় কাগজে-কলমে কমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০২০ সালে খেলাপি বা মন্দ ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। কিন্তু ২০২১ সালের তা বেড়ে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকায় ঠেকে।

গভর্নরের বিদায় বেলায় তার রেখে যাওয়া সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২২ সাল) মার্চ মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ফজলে কবির যখন যোগ দেন তখন দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। বিদায় বেলায় তা ঠেকে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায়। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ
ফজলে কবিরের আমলে অর্থাৎ গত ছয় বছরে নানা সুবিধা পাওয়ার পরও খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫৪ হাজার কোটি টাকা বাড়ে।

চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে নেই অগ্রগতি

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। ওই রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া ওই অর্থ প্রথমে যায় ফিলিপাইনের মাকাতি শহরের রিজাল ব্যাংকের চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে দ্রুত সেই অর্থ উত্তোলন করেন হ্যাকাররা। শেষ পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সহযোগিতায় মাত্র দেড় কোটি ডলার উদ্ধারে সামর্থ্য হয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ফজলে কবিরকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ছয় বছরের বেশি সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে থাকলেও রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনতে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি তাকে। এ সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতিও সেভাবে চোখে পড়েনি। রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।

রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ১৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ফিলিপাইনের দুটি ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। মূল অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান আরসিবিসিসহ বাকি ১৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা এখনও চলমান।

হাজার হাজার আমানতকারী অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করলেও মেয়াদ শেষে ‘আজ্ঞাবহ’ গভর্নর নিশ্চিন্তে বিদায় নেন

দুরবস্থা কাটেনি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র এখন সবারই জানা। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এর উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। নানা অব্যবস্থাপনায় দেওয়া হচ্ছে ঋণ। যা আর ফেরত আসছে না। ফলে আমানতকারীদের জমানো টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, পথে বসছেন তারা।

ছয় বছরের বেশি সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে থাকলেও রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনতে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি তাকে। এ সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতিও সেভাবে চোখে পড়েনি। রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পথে আরও অনেক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগ আছে, আর্থিকভাবে ডুবতে থাকা অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি ফজলে কবির। এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমিয়ে বিপাকে আছেন আমানতকারীরা। অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন তারা। অন্যদিকে, মেয়াদ শেষে ‘আজ্ঞাবহ’ গভর্নর নিশ্চিন্তে বিদায় নিলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement