২৬ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

জিন্স পরা লোকটির বয়স ৩২শ বছর!

Advertisement

ইউরোপীয় আর এশীয় প্রাচীন মানবেরা গাউন, আলখাল্লা, টিউনিক আর টোগা পড়ত। ৫৩০০ বছর আগের ওটজি দ্য আইসম্যানকে দেখে তেমনটাই বলেছিলেন গবেষকরা।

চীনের তারিম বেসিন থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা  একটা প্যান্ট পেয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো প্যান্ট এটি, বয়স বলা হচ্ছে ৩২০০ বছর। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্যান্টটি দেখিয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনারদেরও।  তারা বলেছেন, ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেন আরামে দৌড়ানো যায় তার জন্য এতে বুননশিল্পের অবাক সব প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। প্যান্টটি ইউরোপ আর এশিয়ায় ঘোড়াকে গৃহপালিতকরণের ইতিহাসও জোড়া দিল।

১৯৭০ দশকের শুরুতে চীনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা তিন সহস্রাব্দ পুরোনো ৫০০ মানুষের মমি নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন। মমিগুলো পাওয়া গেছে তারিম নদীর অববাহিকার ইয়াংহাই গোরস্থানে। চীনের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ওই জায়গাটি মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য যোগান দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে। জিনজিয়াং অঞ্চলের শুরুর দিকের বসতি থেকে শুরু করে ফ্যাশনের সূচনাকালের সূত্র যোগাচ্ছে ওইসব সূত্র।

একটি মমি বিশেষ নজর কেড়েছে গবেষকদের কারণ এটি আস্ত আছে। আরো কারণ হলো এর জামাকাপড়ও আগের মতোই বলা চলে অক্ষত। চীনের কাছের একটি শহর তুরফানের নামে মমিটির নাম রাখা হয়েছে তুরফান মানব। গবেষকদের মনে হয়েছে মানুষটি ছুটির দিন মানে রবিবারের সেরা পোশাকটি পরে বের হয়েছে। পায়ে তার নরম চামড়ার জুতো, উলের হেডব্যান্ডটি ঝিনুক ও দস্তার গোল গোল চাকতি দিয়ে সজ্জিত। মিসরের ফারাওরা বুঝি হেরে যায় তার পোশাক-আশাকে। আর সবকিছু ছাপিয়ে তুরফান নজর কেড়েছে তার প্যান্টটির জন্য। এর নকশা একেবারেই আধুনিক এবং এমনই টেকসই যেমন আজকের ডেনিম।

সায়েন্স নিউজে প্রকাশিত আগের গবেষণা জানাচ্ছিল, ইউরোপীয় আর এশীয় প্রাচীন মানবেরা গাউন, আলখাল্লা, টিউনিক আর টোগা পড়ত। ৫৩০০ বছর আগের ওটজি দ্য আইসম্যানকে দেখে তেমনটাই বলেছিলেন গবেষকরা।

মানুষের ইতিহাসে ফ্যাশন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এটা নিয়ে কমই মাথা ঘামানো হয়েছে। কারণ খুজেছেন পোশাক পণ্ডিত অলিভিয়া ওয়ারশ। বলছেন, ‘পোশাক-আশাক ও সাজ-সজ্জাকে আমরা লঘু বা বাড়তি কিছু বিবেচনা করি। অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, চিত্রকলা বা দর্শনের চেয়ে একে আমরা কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। সর্বোপরি হাড়গোড় যেভাবে গুছিয়ে রাখা হয় পোশাককে সেভাবে নয়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন বিশ্বের ফ্যাশন ধারা বুঝতে পারেন না বা খেয়াল কম করেন। অথচ আপনি কিন্তু পোশাকআশাক গবেষণা করে ওই সময়ের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চা এবং চলাচল বোঝার সুযোগ আছে।’  

পেছনে লেগেছে গোটা দল: তুরফান মানবের পোশাক কখন তৈরি হয়েছিল তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সেসঙ্গে কিভাবে তৈরি হয়েছিল সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তৈরির সময়কাল জানার জন্য কার্বন ডেটিং পন্থা কার্যকর পন্থা কিন্তু কিভাবে তৈরি হয়েছিল তা জানা সহজ কাজ নয়। তাইতো প্রত্নতাত্ত্বিক মাইক ওয়াগনার (পরিচালক, ইউরেশিয়া ডিপার্টমেন্ট অব দ্য জার্মান আর্কিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট) ভূতাত্ত্বিক, রসায়নবিদ আর ফ্যাশনডিজাইনাদের সমন্বয়ে একটি দল গড়ে তুলেছেন যারা তুরফান মানবের প্যান্ট রহস্য উন্মোচন করছে। তারা প্যান্টটির বুনন কায়দা খুজে বের করেছে আর তার ফলে পাওয়া গেছে না বলা কিছু কথা। ওয়াগনারের দল ‘আর্কিওলজিক্যাল রিসার্চ ইন এশিয়া’র মার্চ সংখ্যায় তাদের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছে। তাতে বলা হচ্ছে, একটা বুননযন্ত্র দিয়েই পুরোটা তৈরি হয়েছে তবে চারটি ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে। তার মধ্যে দুটি কৌশল অনন্য।  

প্যান্টটিতে কাটাকুটির চিহ্ন মেলেনি, তাতে যেভাবে সুতীবস্ত্র বোনে তেমন কোনো কৌশল এতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই পদ্ধতি পোশাককে অধিক নমনীয় করে তোলে তাই পরিধানকারীর অঙ্গসঞ্চালন সহজ হয়। এর ফলে গবেষকরা বুঝলেন যে ইয়াংহাইয়ের কবরবাসীরা মানে আদি মানবেরা ছিল শিকারী গোষ্ঠির আর চড়ত ঘোড়ায়।

গবেষকরা আশ্চর্য হলেন তাতবোনা পদ্ধতি তুরফান মানবেরাও জানত যা আজো পৃথিবীতে বিদ্যমান এবং উচু দরে সমাদৃত।

যেন আজকের কাউবয় জিনস: আজকের দিনে জিনসের কদর তো এই কারণেই যে, এটা টেকসই, সহজে একে বিক্ষত করা যায় না। পোশাকের মধ্যে ওটি যেন রোলস রয়েস। এর মধ্যভাগ বা হাটুর দিকটা ট্যাপেস্ট্রি (চিত্রিত কাপড়খণ্ড) বুনন পদ্ধতি প্রয়োগে ভারী করা হয় যেন ঘোড়ার পিঠে চড়ার সময় জয়েন্ট সুরক্ষিত থাকে আর ওপরের অংশে যোগ করা হয় নমনীয় কোমড়বন্ধনী। তুরফান মানবের প্যান্টটি ওই সব রীতি মেনেই তৈরি। ওয়াগনার ধারণা করেন, বসে বসেই বোনা হয়েছিল তুরফানের প্যান্ট। ওয়াগার ও তার দল তুরফানের প্যান্টটির বেশ কয়েকটি অনুকৃতি তৈরির কাজে মন দিয়েছে এবার। উদ্দেশ্য যতটা আসলটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। এজন্য একজন বিশেষজ্ঞ কারিগর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যে ভেড়ার পশম থেকে সুতা বানাচ্ছে এবং তুরফান মানবের আমলের মতো বুনন উপকরণ ব্যবহার করছে।  

এ পর্যায়ে এসে তারা একটি নতুন স্লোগান বলছে, পোশাক দিয়ে যায় চেনা। যেভাবে পোশাকটি তৈরি হয়েছিল আর যে উদ্দেশে সেটি পরা হয়েছিল তা আমাদের বলছে সেসব দিনের কথা যেগুলো লুকিয়ে আছে মাটির গভীরে।    তুরফান মানব তার পরের সময়ের ভ্রাম্যমাণ মানুষদের কথাও বলে। ক্রমেই বাড়ছিল প্যান্টের জনপ্রিয়তা,  ঘোড়ায় চড়িয়ের সংখ্যা যে বাড়ছিল দিনে দিনে তার ইঙ্গিত দেয় ওই কথা। তুরফানের প্যান্ট টাইটফিট অথচ দারুণ স্বচ্ছন্দ মানে দাড়াল  ঘোড়া দাবড়ানো নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে উঠছিল। প্যান্টটি ছড়িয়েও পড়েছিল সাইবেরিয়া বা কাজাখস্তানে। মধ্য আর পূর্ব এশিয়া তখন ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলেও সংস্কৃতির বিনিময় ঘটেছিল।

তাই সেন্ট লুইয়ের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান মাইকেল ফ্রেকেত্তি বলেছেন, সিল্ক রোড কীভাবে বিশ্বকে রূপান্তরিত করেছে তা তুরফান মানবের প্যান্ট দেখে বোঝা যায়। ওয়াগনারও সহমত পোষণ করে বলেছেন, বিভিন্ন দিক আর উৎস থেকে আসা মানুষ, গাছপালা, প্রাণী, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা মিলেছিল সিল রোডে এসে আর বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে। 

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement