২৬ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুত উৎপাদনে লাগাম

Advertisement

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ হ্রাস ও উৎপাদন কম হওয়ায় জ্বালানির দাম হু-হু করে বেড়ে গেছে।

দাম বাড়ার কারণে অনেক দেশ উচ্চমূল্য দিয়ে আমদানি করতে পারছে না। ফলে জ্বালানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাটছাঁট করেছে।

তারা চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকদের বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতে পারছে না। এমনকি গৃহসামগ্রীর কাজে বিদ্যুতের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।

জ্বালানিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাবে আগামীতে অর্থনৈতিক মন্দা আরও জেঁকে বসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

বুধবার রাতে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।

এতে বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও দাম সম্পর্কে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে তারা বলেছে, ২০২১ সালের তুলনায় বিশ্বে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। চলতি বছরে আরও কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী বছরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাহিদা কমবে। এ কারণে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে আসবে। তবে জ্বালানিনির্ভর পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর মধ্যে কৃষি উপকরণের বিভিন্ন ধরনের সার, শিল্পের কাঁচামাল, চাল, অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। কমবে জ্বালানি, গম, ভোজ্যতেলের দাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সুদের হার বাড়ানোর ফলে এর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এতে ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে জ্বালানি, খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের চড়া দামের কারণে মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। যে কারণে বিশ্বের অনেক দেশকে এখন রেকর্ড হারে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জ্বালানিসহ খাদ্যের দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এসব দেশ ব্যাপক হারে খাদ্য আমদানি করে। ফলে এসব দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ২০ শতাংশে উঠে গেছে। ওইসব দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করায় এবং মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করায় অর্থনৈতিক কাজে মন্দা আরও বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপে জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। কেননা ইউরোপের জ্বালানির বড় অংশই আসত ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। মোট জ্বালানির প্রায় ৩৪ শতাংশই ওই দুটি দেশ সরবরাহ করে। রাশিয়ার আক্রমণের কারণে ইউক্রেন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না। একই সঙ্গে যুদ্ধের কারণে তাদের জ্বালানি উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অপরদিকে ইউরোপ ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না। এতে তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়েছে।

রেকর্ড উচ্চমূল্যের কারণে জ্বালানির মধ্যে তরল গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা ইউরোপের দেশগুলো চড়া দামে কিনে নিচ্ছে। কেননা আগামী শীতে তাদের জ্বালানির চাহিদা বাড়বে। ফলে বাড়তি দামের কারণে গ্যাসের কার্গো সব যাচ্ছে ইউরোপে। এদিকে জাপান ও কোরিয়া তরল গ্যাস কিনতে না পেরে তাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আবার পরমাণু কেন্দ্রগুলো চালু করেছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে ৫৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ৩ হাজার ৯৩১ মেগাওয়াট। দেশে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫২টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট। এরমধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের অভাবে বন্ধ রয়েছে ১১শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক কেন্দ্র।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে দেশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা সম্ভব হতো। যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে এখন প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে গড়ে ৯ হাজার ২শ মেগাওয়াটের মতো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে দেশীয় গ্যাসের পাশাপাশি ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হতো। এই এলএনজিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে শিল্পকারখানা ও আবাসিক গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা হতো।

এদিকে গ্যাসের অভাবে দেশের অনেক শিল্পোৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে চিনি শিল্প গ্যাসের অভাবে উৎপাদন চালাতে পারছে না। ফলে বাজারে চিনির দাম বেড়ে গেছে। এমন গ্যাস নির্ভর সব শিল্পেরই একই অবস্থা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চড়া মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে ইউরোপ-আমেরিকাসহ এশিয়ার দেশগুলোতেও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে। ফলে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে।

এতে মূল্যস্ফীতির হার আগামীতে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। চাহিদা কমার কারণে আগামীতে বেশকিছু পণ্যের দাম কমতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে। তবে এগুলোর দাম আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে কমবে। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের জ্বালানি, কৃষিপণ্যের মধ্যে গম, ভোজ্যতেল ইত্যাদি।

মন্দা কাটিয়ে উঠার পর আবার হঠাৎ করে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাবে। এতে দামও বাড়বে। কিন্তু উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বাড়বে না। ফলে পণ্যের সংকট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামের ২০২১ সালে সূচক ছিল ৯৪ দশমিক ৪ পয়েন্ট। ২০২২-এ তা বেড়ে হয়েছে ১৫১ দশমিক ৭ পয়েন্ট। আগামী বছর তা কমে ১৩৪ দশমিক ৭ পয়েন্ট হবে। নন এনার্জি পণ্যের দাম বাড়বে। এর মধ্যে এসব পণ্যের সূচক ২০২১ সালে ছিল ১১২ পয়েন্ট। চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ১২৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট হয়েছে। বছরের শেষ দিকে তা আরও বাড়তে পারে। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে তা কমে হবে ১১৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট।

শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়বে। এসব পণ্যের সূচক ২০২১ সালে ছিল ৮৫ দশমিক ৫ পয়েন্ট। চলতি বছরে তা সামান্য কমে ৮১ দশমিক ২ পয়েন্ট হতে পারে। আগামী বছর তা আরও বেড়ে ৮৪ দশমিক ৭ পয়েন্ট হবে। ফলে শিল্পের খরচ বাড়বে। শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে এসব পণ্যের দামও বাড়বে।

ইউরোপে গ্যাসের সংকটের কারণে সারের দাম বাড়বে। গত বছর সব ধরনের সারের মূল্য সূচক ছিল ১৩২ দশমিক ২ পয়েন্ট। চলতি বছর তা বেড়ে ২১৯ দশমিক ৫ পয়েন্ট হয়েছে। আগামী বছর তা হবে ২১৯ দশমিক ৮ পয়েন্ট। অর্থাৎ ২০২১ সালে যে পরিমাণ ১৩২ ডলারে কেনা হয়েছে। তা আগামী বছর কিনতে লাগবে ২২০ ডলারা।

একইভাবে বাড়বে চালের দাম। গত বছর যে চাল ৩৩৫ ডলারে কেনা হয়েছে। তা কিনতে এখন লাগছে ৪৩৫ ডলার। আগামী বছর আরও বেড়ে ৪৩৭ ডলার লাগবে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement