২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, মঙ্গলবার

বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা

Advertisement

স্বচ্ছ চায়ের কাপে ঢালার পর চায়ের সোনালি রং দেখা যায়, সেখানে ভাসছে খাবার যোগ্য স্বর্ণের প্রলেপ। বাংলাদেশের চা বাগানে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তৈরি করা এবং সোনার প্রলেপ দেয়া সোনালি রঙের এই চা হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা। এমনটাই দাবি করছেন এর উৎপাদকরা।

চায়ের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ তাদের উৎপাদিত ‘গোল্ডেন বেঙ্গল টি’ নামের বিশেষ চা-য়ের মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ১৪ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এই বছরের মে মাস নাগাদ তার এই চা বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে গত কয়েক বছর অত্যন্ত গোপনে এই চায়ের চাষ করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের চা শিল্প গবেষকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে এমন দামী চায়ের চাষাবাদের কথা বলা হলেও তাদের কাছে এরকম চা সম্পর্কে কোন তথ্য নেই।

চায়ের প্রকারের দিকে এটি ব্ল্যাক টি হলেও স্বচ্ছ পেয়ালায় পরিবেশন করলে এই সোনালি রঙে দেখা যাবে। প্রায় সাড়ে চার বছর সময় নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে এই চা উৎপাদন করা হয় বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। লন্ডন টি এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অলিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে এই চা তৈরি করা হয়। এর জন্য অনেক বেশি যত্নের পাশাপাশি বিদেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীরা চা তৈরি করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় মেশিনের কোন সহায়তা নেয়া হয় না।

চা, কফি বা গরম পানি খেয়ে কি ভাইরাস দূর করা যায়?

তিনি বলেছেন, ২০১৬ সাল থেকে তারা এই চায়ের চাষ শুরু করেছেন। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের কয়েকটি চা বাগানের অংশ বিশেষ ভাড়া নিয়ে তারা নিজেদের তত্ত্বাবধানে এই চায়ের চাষ করছেন। প্রায় পাঁচ বছর পর, নয়শো কেজি চা থেকে এক কেজি সোনালি চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। সেই চায়ের পাতায় মেশানো হয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রলেপ।

উৎপাদকরা বলছেন, এর মধ্যেই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে তারা গোল্ডেন বেঙ্গল চা অর্ডার পেতে শুরু করেছেন। অনেক সময় অনেক গাছে সোনালি পাতা ধরেই না। আবার কোন কোন সময় সোনালি এই পাতা পেতে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়। দীর্ঘসময় ধরে, প্রশিক্ষিত কর্মীদের মাধ্যমে আস্তে আস্তে এই চায়ের পাতা সংগ্রহ করা হয়। তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটিকে চায়ে রূপ দেয়া হয়। তার একটি পর্যায়ে এর সঙ্গে গোল্ড ফ্লেক্স বা স্বর্ণের গুঁড়ো মেশানো হয়,” বলছেন মি. রহমান।

তিনি দাবি করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন, বিশেষ যত্ন ও প্রক্রিয়া, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মীদের ব্যবহারের কারণে এই চায়ের মূল্য বেড়েছে। বাংলাদেশের কোন চা বাগানে এই চায়ের চাষাবাদ হচ্ছে, ব্যবসায়িক কারণে তা তিনি জানাতে রাজি হননি।

এর মধ্যেই একাধিক অনুষ্ঠানে এই দামী চায়ের প্রদর্শনী হয়েছে। এই বছরের মে মাস নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে গোল্ডেন বেঙ্গল চা বাজারে আনার পরিকল্পনা করছে লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ। লন্ডনভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের নানা দামী ব্র্যান্ডের চা সংগ্রহ করে বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তারা বিশ্বের একাধিক রাজপরিবারের জন্যও চা সরবরাহ করে। তবে এবারই প্রথম তারা সম্পূর্ণ নিজেদের তত্ত্বাবধানে চা উৎপাদন করছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা বাংলাদেশে উৎপাদনের কথা বলা হলেও এই সম্পর্কে বাংলাদেশের চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে কোন তথ্য নেই বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ ইসমাইল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”বাংলাদেশে আমরা চা নিয়ে গবেষণা করলেও এতো দামী চায়ের যে এখানে চাষাবাদ হচ্ছে, এরকম কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। সুতরাং কী কারণে বা কোন বিশেষত্বের কারণে এই চা-য়ের এতো দাম, সেটা সম্পর্কেও আমাদের কোন ধারণা নেই।”

তিনি জানান, চায়ের নানা জাতের মধ্যে বিশ্বে এখন পর্যন্ত ‘হোয়াইট টি’ দামী চা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে হোয়াইট টি-র চাষাবাদ খুব একটা হয় না। বাংলাদেশের প্রায় সব চা বাগানে ব্ল্যাক টি-র চাষাবাদ হয়ে থাকে। এর বাইরে গ্রিন টি, ইনস্ট্যান্ট টি, ওলং টির কিছুটা চাষ হচ্ছে।

মি. হোসেন বলছেন, কয়েক বছর আগে চা নিয়ে গবেষণার সময় তারা একটি বিশেষ পদ্ধতি বের করেছিলেন। তাতে দেখা গেছে, বিশেষ জাতের ‘ব্ল্যাক টি’ চা গাছের কচি সোনালী পাতা সংগ্রহ করে বিশেষভাবে গান মেটালের মাধ্যমে তাপ দেয়া হলে পাতা থেকে ঘাম বের হয়। সেটি আবার শুকানো হলে সেই পাতা সোনালি বর্ণের হয়ে ওঠে। সেই পাতা থেকে যে চা তৈরি হয়, সেটির রঙ সোনালি হয়ে থাকে।

তবে গোল্ডেন বেঙ্গল চা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়, তা তিনি ধারণা করতে পারছেন না। বাংলাদেশের একাধিক চা কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেও এই চায়ের বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অলিউর রহমান অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘ব্যবসায়িক কারণে আমরা অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে এই চায়ের উৎপাদন করেছি। চা বাগানের কিছু অংশ চুক্তির মাধ্যমে নিয়ে সেখানে আমাদের বিশেষ জাতের চা গাছ রোপণ করেছি। এরপর আমাদের নিজস্ব কর্মীরা সেসব গাছ থেকে চা পাতা সংগ্রহ করে উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে।’ তিনি জানান, এর মধ্যেই তারা বিশ্বের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে এই চায়ের ক্রয়াদেশ পেয়েছেন।

যে দামে বিক্রির কথা উৎপাদকরা বলছেন, ‘গোল্ডেন বেঙ্গল টি’ সেই ১৪ লাখ পাউন্ডে বিক্রি হলে এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম কোন চা, যা এতো দামে বিক্রি হচ্ছে।

কারণ এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে দামী যে চা ব্র্যান্ডগুলো রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশি কোন চা নেই। যদিও বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ চা উৎপাদন হয়। তবে শুধু বাংলাদেশের নয়, সেক্ষেত্রে এই চা হবে বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা। কারণ বিশ্বে এর আগে সবচেয়ে বেশি মূল্যে চা বিক্রির রেকর্ডও ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে ১৮৫৪ সাল থেকে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক চা উৎপাদন শুরু হয়। বাংলাদেশের চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান থেকে রেকর্ড ৯ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এসব চায়ের বেশিরভাগই দেশের বাজারে বিক্রি হয়।

২০২১ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র তিন লাখ ১৩ হাজার কেজি চা। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, এক লাখ ৮০ হাজার কেজি চা। এরপরে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement