২৯ মার্চ, ২০২৪, শুক্রবার

বর্তমানে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে অন্তত ৫ মাসের খাদ্য আমদানি সম্ভব : প্রধানমন্ত্রী

Advertisement

বর্তমানে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে অন্তত পাঁচ মাসের খাদ্য আমদানি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যে রিজার্ভ আছে, সেই রিজার্ভে অন্তত পাঁচ মাসের আমদানি করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যদি তিন মাসের আমদানির পরিমাণ রিজার্ভ থাকে, তাহলে সেটাই যথেষ্ট। এটা হলো বাস্তবতা।’

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় একাদশ জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে সমাপনী ভাষণে এসব কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন।

এ সময় দেশবাসীকে তাদের নিজেদের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি যে কোনো সংকট মোকাবিলায় রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে এবং আমাদের সকলেরই এ চেষ্টা করা উচিত।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদনটা ধরে রাখতে হবে। আর আমদানীকৃত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বাড়াতে হবে এবং এ জন্য তার সরকার বিভিন্ন দেশে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, বিশ্ব মন্দার মধ্যেও তার সরকার অর্থনীতিটাকে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সকলকে কৃচ্ছ্র সাধন করতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ও পানির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

প্রতিটি পরিবারকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘ইউরোপের অনেক উন্নত দেশে রেশনিং চলছে এবং এই শীতে বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত রাখতে তারা নতুন পরিকল্পনা করছে। কাজেই আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে এবং আগে থেকেই যে কোনো অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এই মুহূর্তে যে জিনিসটার খুব বেশি প্রয়োজন নেই, সেই বিলাস দ্রব্য আমদানি আমাদের কমাতে হবে। আর এর ওপর আমাদের ট্যাক্সও বসাতে হবে বেশি করে।’

বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট সরকারি ঋণ জিডিপির ৩৬ শতাংশ। আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অন্তত এতটুকু বলতে পারি, আমরা কোনো দিনও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। আমরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছি। আমরা ঋণখেলাপি (লোন ডিফল্টার) হইনি কখনো। আর ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ হবো না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত অর্থ ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ আলাদা নয়। বাংলাদেশকেও তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। কারণ, প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যাদের খাদ্যপণ্য, জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে, তারাও সংকটে পড়েছে। এর পরও আমি বলব, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাদের চাহিদা সরকার পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার পরও চাপ রয়েছে, কেননা পণ্য উৎপাদনেও ভর্তুকির পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে।’

তার সরকার করোনার মধ্যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার, যেটা বিএনপি আমলে (২০০৫-০৬) অর্থবছরে ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। পাশাপাশি বাজেটে উন্নয়ন খাতে সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে আমাদের ভর্তুকি ধরা ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। আজকে সেখানে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়ে প্রয়োজন হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ দিতে গেলে এই ভর্তুকি দিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানি তেলে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ১৯ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। খাদ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভর্তুকির প্রয়োজন হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা। টিসিবি বা অন্যান্য জনবান্ধব কর্মসূচিতে ভর্তুকি লাগছে ৯ হাজার কোটি টাকার। কেননা এক কোটি মানুষকে বিশেষ কার্ড দিয়ে সরকার স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে। সার ও কৃষিপণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ৪০ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। তার মানে ১ লাখ ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকার শুধু ভর্তুকির চাহিদা বেড়েছে।’

সরকারপ্রধান এ সময় বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কিছু উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ডিজেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ১৩২ ডলার বা তার বেশি থেকে প্রায় ১৭০ হয়েছে। গ্যাস সরবরাহে নভেম্বর মাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটারেই ১০ টাকা ৬০ পয়সা হারে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এলএনজিকে প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ৪৮ টাকা। সেভাবে ইউরিয়া সার ৭৫ টাকায় ক্রয় করে ২২ টাকায়, টিএসপি ৫৯ টাকায় করে কৃষক পর্যায়ে ২২ টাকায় এবং অন্যান্য সারও এভাবে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে ন্যায্যমূল্যে কৃষক সরবরাহ করতে ভর্তুকি বহু গুণে বেড়ে গেছে।’

“প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক বছরে বিশ্ববাজারে চিনি, মসুর ডালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, যার অধিকাংশই আমাদের আমদানি করে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চাল, গম, আটার মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।”

প্রধানমন্ত্রী এত কিছুর পরও দেশে ‘১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন’ খাদ্য মজুত রয়েছে বলেও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘কাজেই আমাদের চিন্তার কিছু নেই। এরই মধ্যে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আগাম আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া সকল দেশের সঙ্গেই আলোচনা চলছে এবং কিছু চুক্তিও হয়েছে।’

রিজার্ভ নিয়ে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি একটি হিসাব দেখিয়েছেন, যেখানে শুধু খরচটাই দেখিয়েছেন। কিন্তু আয়টা যুক্ত করেননি। আমাদের কিছু আয় আছে, সেটাও বাস্তব।’

রিজার্ভের হিসাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ’৯৬ সালের (২৩ জুন) সরকার গঠনের সময় তিনি রিজার্ভ পেয়েছিলেন ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই রিজার্ভকে প্রায় ৪ বিলিয়নের কাছাকাছিতে উন্নীত করে। এরপর দ্বিতীয়বার সরকারে আসে (৬ জানুয়ারি) ২০০৯ তারিখে, তখন রিজার্ভ ছিল ৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (৮ জানুয়ারি) ২০১৪ তারিখ যখন টানা দ্বিতীয় এবং মোট তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ সরকারে আসে, তখন রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার ৫ থেকে ১৭ বিলিয়নে উন্নীত করেছে। এরপর চতুর্থ দফা এবং টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের সময় (৭ জানুয়ারি) ২০১৯ রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং (৩০ জুন) ২০২০ তারিখে ৩৬ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়।’

তিনি আরও বলেন, (৩০ জুন) ২০২১ তারিখে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং (৩০ জুন) ২০২২ তারিখে তা ৪১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। করোনার সময় আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য ব্যয় প্রায় বন্ধ থাকায় তা প্রায় ৪৮ বিলিয়নে উঠে গিয়েছিল। পরবর্তী আমদানি বৃদ্ধি এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বস্তবায়ন এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমে বর্তমান (৩ নভেম্বর) ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দঁড়িয়েছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement