২৩ এপ্রিল, ২০২৪, মঙ্গলবার

বাংলার শ্বেত শকুন তাজমহলে

Advertisement

রাজস্থানের ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য থেকে কিছুক্ষণ আগে আগ্রা এলাম। সকাল থেকে পেটে একটুও দানাপানি পড়েনি। তাই তাজমহলে ঢোকার আগে নাশতা সেরে নিচ্ছি। আমরা যে রেস্তোরাঁয় নাশতা করছি, সেটি তিনতলায়; ওপরে কোনো ছাদ নেই। নাশতা শুরুর পরপরই আকাশে একটি শিকারি পাখিকে চক্কর দিতে দেখলাম। ক্যামেরা হাতের কাছেই ছিল। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ফোকাস করতেই পাখিটিকে চিনতে পারলাম।

গতকাল সকালেই ভরতপুরে প্রথমে একটি কমবয়সী ও পরে দূর আকাশে একঝাঁক একই প্রজাতির বয়স্ক পাখি উড়তে দেখেছি। আগ্রার পাখিটি বয়স্ক। দ্রুত শাটারে ক্লিক করলাম। নাশতা শেষ করে তাজমহলের দিকে পা বাড়ালাম। তাজমহলের ভেতর ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে আবিষ্কার করলাম—এখানেও বেশকটি একই প্রজাতির পাখি রয়েছে, যারা তাজমহলের চারদিকে চক্কর দিচ্ছে। ওদেরই একটিকে কিছুক্ষণ পর তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর একচিলতে চরে নামতে দেখলাম। বাংলাদেশের ভবঘুরে এই পাখিটিকে ভারতের রাজস্থান (ভরতপুর) ও আগ্রায় বিশেষ করে তাজমহলে দেখে খুবই ভালো লাগল। সাত বছর আগে তাজমহলের একটি ভবনের ছাদে ময়ূর দেখেছিলাম।

তাজমহলে দেখা শিকারি পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য ৫৮-৭০ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ১৫৫-১৭০ সেমি ও ওজন ১.৬-২.২ কেজি। পালকহীন মুখমণ্ডল কমলা-হলুদ।

পুরো দেহের পালক ময়লা সাদা। মাথা ও ঘাড়ের পালক পাটকিলে। ডানা দুটি সুচালো এবং ডানার প্রান্ত-পালক কালো। ওড়ার সময় ডানা-ঢাকনির সাদা-কালো ও লেজ-ঢাকনির সাদা পালক চোখে পড়ে। চোখ লালচে-হলুদ, চঞ্চু হলুদ এবং পা ও পায়ের পাতা গোলাপি। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মুখমণ্ডল ধূসর এবং দেহ ও ডানার পালক কালচে-বাদামি।

ওরা বনের প্রান্ত, লোকালয়, ভাগাড় ও কসাইখানার আশপাশে বিচরণ করে। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। তবে মৃতদেহ ও উচ্ছিষ্ট বেশি থাকলে ছোট বা বড় দলে দেখা যায়। ওরা খাবারের খোঁজে আকাশে চক্কর দিতে থাকে অথবা উঁচু গাছ বা দালানে বসে থাকে। মৃত প্রাণী, পচা মাংস বা মাছ মূল খাদ্য। প্রায়ই ময়লা-আবর্জনার স্তূপে খাদ্য খুঁজতে দেখা যায়। সচরাচর নীরব থাকে। কিন্তু উত্তেজিত হলে ‘হিস হিস’ বা ‘ঘোঁত ঘোঁত’ শব্দ করে।

ওরা সারাজীবনের জন্য জোড় বাঁধে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল প্রজননকাল। এ সময় স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে খাড়া পাহাড়, বিল্ডিংয়ের ভগ্নাবশেষ বা উঁচু গাছের ডালে মাচার মতো বাসা বানায়। পুরোনো কাঁথা, চুল, পালক ইত্যাদি দিয়ে বাসার গদি তৈরি করে। একই বাসা বছরের পর বছর মেরামত করে ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে দুটি, রং ইটের মতো লাল। প্রথম কয়েকদিন স্ত্রী ডিমে তা দেওয়ার পর স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে তা দেয়। ডিম ফোটে ৩৯-৪৫ দিনে। ছানাদের লালনপালনও মিলেমিশে করে। ছানারা ৭১-৮৫ দিনে উড়তে শেখে। ওড়া শিখে গেলে মাসখানেক পর নিজে নিজে শিকার করতে শেখে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১৪ বছর।

তাজমহলে দেখা শিকারি পাখিটি এ দেশের বিরল ও ভবঘুরে পাখি শ্বেত শকুন। সাদা গিদরি বা গিদরনি শকুন নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে গিদনি বা গিন্নি শকুন। ইংরেজি নাম ইজিপশিয়ান ভালচার, হোয়াইট ইজিপটিয়ান ভালচার বা ফারাওস চিকেন। অ্যাক্সিপিট্রিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Neophron percnopterus। কয়েক বছর আগে কাপ্তাইয়ে প্রথমবার ও এরপর রাজশাহীতে দুবার শ্বেত শকুন দেখার তথ্য রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত শকুনদের মধ্যে আকারে ওরাই সবচেয়ে ছোট। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন পাখিটি দক্ষিণ ইউরোপ থেকে উত্তর আফ্রিকা হয়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement