২৫ এপ্রিল, ২০২৪, বৃহস্পতিবার

বৃষ্টিপাত না হওয়া ও পলি জমে মাছের উৎপাদন কমছে কাপ্তাই হ্রদে

Advertisement

অতীতে কাপ্তাই হ্রদে বড় প্রজাতি কিংবা কার্পজাতীয় মাছের উল্লেখজনক উৎপাদন হলেও কালের বিবর্তনে এই চিত্র এখন পুরোই বিপরীত। বিএফডিসির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কাপ্তাই হ্রদে বিগত কয়েক বছরে বড় প্রজাতির মাছের পোনা ছাড়ার হার বাড়লেও মৎস্য আহরণ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সে হার কমেছে প্রতিবছর। জেলা মৎস্য অফিস মনে করছে, সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া ও পলি জমে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের চ্যানেলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, আর তাই কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমছে।

ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর আয়তনের জায়গা নিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে তৈরি করা হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। রাঙামাটির আট ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলায় বিস্তৃত এটি। কাপ্তাই হ্রদের রক্ষণাবেক্ষণ ও মাছ চাষের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) বার্ষিক প্রজাতিভিত্তিক মৎস্য বিবরণীতে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ছোট-বড় মোট ৪৪ প্রজাতির মাছ আহরণের তথ্য রয়েছে। যার মধ্যে ২৭ প্রজাতির বড় মাছ ও ১৭ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। তবে বিএফডিসির বার্ষিক আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রজাতিতে ছোট মাছ কম হলেও আহরণ ও আয়ের ৯০ শতাংশের বেশি আসে ছোট মাছ থেকে। আর প্রজাতিতে বেশি এবং প্রতিবছর নিয়মিত পোনা ছাড়া হলেও বর্তমান সময়ে আহরণ এবং আয়ের মাত্র ১০ শতাংশের কম আসে বড় মাছ থেকে।

বিএফডিসির বার্ষিক মৎস্য অবতরণ ও শুল্ক আদায়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, রাঙামাটি প্রধান বিপণনকেন্দ্র, কাপ্তাই, মহালছড়ি ও মারিশ্যা—এই চার অবতরণকেন্দ্রে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬০৭ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৫৩ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ১০৪ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৪৫৫ টন ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৫৪ টন মাছ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ পাঁচ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ কোটি ৪২ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ কোটি ৭৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এই আয়ের ৯০ শতাংশের ওপরে শুল্ক আদায় হয়েছে ছোট প্রজাতির মাছ হতেই।

কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় বা বড় প্রজাতির মাছের আধিক্য বাড়াতে প্রতিবছরই মাছের পোনা ছাড়ে বিএফডিসি। গত পাঁচ বছরের পোনা অবমুক্তকরণের হিসাব বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৩ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬টন ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬০ টনের অধিক পোনা মাছে ছাড়া হয়েছে। তবে পোনা মাছ অবমুক্তকরণ বাড়লেও বড় মাছের উৎপাদন ক্রমেই নিম্নগামী।

যদিও এ নিয়ে জেলে, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, বিএফডিসি ও গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন ঠিকমতো সঠিক সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। যার কারণে কাপ্তাই হ্রদ পানি থাকছে না প্রয়োজনমতো। এতে করে মা মাছগুলো জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। অপরদিকে ২৩ সেন্টিমিটারের নিচের মাছগুলো জেলেদের জালে চলে আসছে। আর কার্পজাতীয় মাছের বৃদ্ধি কমছে। আবার মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের চ্যানেল বরকল, কাচালং, সুবলং, রীংক্ষ্যং চ্যানেলগুলো প্রায় পলি জমে নষ্ট হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদনে।

রাঙামাটি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ জানান, সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া ও পলি জমে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের চ্যানেলগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন চ্যানেল নাই বললেই চলে। এই প্রাকৃতিক প্রজননের চ্যানেল বাড়ানো গেলেই কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটির ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের মৎস অবতণ কেন্দ্রগুলোতে যে মাছ আসে তার হিসাবে প্রায় ৯০ শতাংশই ছোট মাছ। বাকিগুলো কার্প জাতীয় মাছ। তবে জেলেদের কাছ থেকে স্থানীয় বাজারে প্রচুর কার্পজাতীয় মাছ চলে যায়, যার হিসেবে আমাদের কাছে আসে না। কিন্তু কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন কমছে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়া ও মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রগুলো পলি জমে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এই উৎপাদন কমছে। কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর আমরা পোনা মাছ কাপ্তাই হ্রদে ছাড়ছি।

প্রসঙ্গত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। এই হ্রদ স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি প্রায় ২৫ হাজার জেলের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement