২০ এপ্রিল, ২০২৪, শনিবার

ঐতিহ্যের রেঁস্তোরায়

Advertisement

কৈশোরের শেষদিককার কথা। শ্রেণীকক্ষে মনোনিবেশের বালাই ছিলো না তখন। সময় হয়ে এলেই শিক্ষককে মনে করিয়ে দেয়া নিজেদের ঈমানি দায়িত্ব বলে ভাবতাম। সেই সময় এক শিক্ষক বলেছিলেন, “ঘড়ির কাটা আর ঘোড়ার মাঝে ফারাক নেই।“ সেই সময়ও ঘোড়দৌড়ের ধূলো উড়িয়ে গত হয়েছে বহুদিন। স্মৃতির অলিন্দে রয়ে গেছে শুধু স্যারের সেই বেদবাক্য।

চোখের সামনে হাতগলে চলে যাওয়া নিরবধি কাল, শুধু মনের মগজে হিসেব রাখাই সার। একেই বোধহয় বলে ‘সময়’। ক্ষয়িষ্ণু সময় সবকিছুকে নিঃশেষ করে দেয়। অবয়ব থেকে অবকাঠামো, ঝুরঝুরে, গুড়ো কখনোবা স্যাঁতস্যাঁতে। তবু সময় ছাপিয়ে কিছু জিনিস রয়ে যায়। ক্ষয়িষ্ণু বৈশিষ্ট্য পাশ কাঁটিয়ে টিকে থাকে অবকাঠামো, আর কিংবদন্তী হয়ে যায় কাহিনীরা।

সময়ের পাঁজরে জড়িয়ে যেমন কিংবদন্তী হয়েছে শতবর্ষী বোস কেবিন। মেঘ মেঘ বিকেল সন্ধ্যার মতো লাগে। বোস কেবিন আগের মতোই আছে, বুড়ো হয়নি একদম, তরুণ হচ্ছে যেন দিন দিন। ঠিক Curious Case of Benjamin Button সিনেমার নায়কের মতো। যে কিনা জন্মেছিলো বলিরেখা ত্বক আর বার্ধক্যের চেহারা নিয়ে। আর বয়স বাড়তেই সুদর্শন হয়ে হয়ে উঠছিলো। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ…

নারায়ণগঞ্জ, প্রাচ্যের ড্যান্ডির খেতাব আর নেই। শীতলক্ষ্যায় জল গড়িয়েছে বহুদূর। ব্যবসা আর নগরায়নের থাবায় তিলোত্তমা শহর পরিণত হয়েছে বন্দর নগরীতে। ইতিহাস আর ঐতিহ্য খুঁজে পেতে যে কোন শহরের পুরোনো স্থাপনাগুলোর বিকল্প নেই। যেখানে বরাবরই পিছিয়ে আমরা। বোস কেবিনই তাই অনেকের ভরসা।

অন্তত এখানে এলে একলহমার তিনপুরুষের গপ্পের খোঁজ পাওয়া যায়। ঐতিহ্যের হাত ধরে বোস কেবিন ভ্রমণ পিপাসু আর রসনা বিলাসীদের মনযোগের কেন্দ্রে। নীল সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা ‘নিউ বোস কেবিন’। তবে নিউ সবসময় উহ্য। মুখে মুখেই থেকে গেলো বোস কেবিন।

কিংবদন্তীর কথা বলছি

সেই ডামাডোলের সময়। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার স্বাদ নিতে উত্তাল। রাজনীতির মাঠে পরিণত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ রাজের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। রাজনীতিতে জনমত গড়ে তোলা ছিলো চ্যালেঞ্জিং। রাজনীতির মাঠ গরম করতে বার্মা থেকে বাংলা, ব্যাপক গণযোগ করছেন নেতাজী। পুলিশের লাল তালিকায় নাম উঠেছে।

সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৯৩১ সালের নভেম্বরের শীতের সকালে নামলেন নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাটে। হাজারো সমর্থকদের ঢল তখন ঘাটে। স্টিমারে বসেই শুনেছিলেন সরকার তার ঢাকা জেলার ভেতর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তিনি নামতেই নারায়ণগঞ্জ থানায় তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হলো।

অন্যদিকে বোস কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু ওরফে ভুলু বোসও জানলেন সে খবর। নেতাজী তখনও নারায়ণগঞ্জ থানায়। নেতাজী চা পছন্দ করতেন খুব। সে খবর জানতেন ভুলু বাবু। স্বয়ং বোস কেবিনের কর্ণধার গরম দুই কেতলি আর কাপ হাতে ছুটলেন থানায়। কড়া লিকার আর হালকা লিকার দুটোই সাথে নিয়েছিলেন তিনি। ভুলুবাবুর হাতের চা-এ খেয়ে খুশি হয়েছিলেন নেতাজী। তাঁর আশীর্বাদে সিক্ত হয়েছিলেন বোস কেবিনের প্রথম প্রজন্ম।

তবে আশীর্বাদ ফলেছিলো শতভাগ। বোস কেবিনে পা পড়েছে সব মহারথীদের। অখন্ড পাকিস্তান থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ। বোস কেবিনে বসেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মতো ইতিহাস পালটে দেয়া নেতারা।

নারায়ণগঞ্জের চুনকা থেকে শুরু করে হালের শামীম ওসমান বা সেলিনা পারভীন আইভি। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব থেকে জেলা বার সমিতির নেতা। সবাই জীবনের কোন না কোন সময়ে এসেছেন, বসেছেন এবং খেয়েছেন এই বোস কেবিনে। এসেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শামসুল হকসহ অনেকেই।

বোস কেবিনের দিন

নৃপেন্দ্র চন্দ্র বসু ওরফে ভুলু বোসের আদি নিবাস মূলত ছিলো বিক্রমপুরের। ১৯২০ সালে এন্ট্রাস পাস করেও দারোগার চাকরি নেননি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের কারণে। স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া ভুলুবাবু বিপ্লবীদের যোগাযোগের কাজটা করতেন। কিন্ত সে সময় স্থায়ী কোন কার্যালয় নেয়া সম্ভব নয়। আবার কলকাতা থেকে আসা চিঠিও পেতে হবে সুচারুভাবে, গোপনীয়তার সাথে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯২১ সালে নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ নং রেলস্টেশন ও স্টিমার ঘাটের কাছে বোস কেবিন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কেবিনের ঠিকানায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিঠি আসত।

পদ্মপাতায় পানি যেমন টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। সময়ও গড়িয়েছে ঠিক তেমনি। দেখতে দেখতে শতবর্ষে পা রেখেছে বোস কেবিন। এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা কোন প্রতিষ্ঠান। যা দেখেছে তিনটি রাষ্ট্রকে। যে কোন দেশের ইতিহাসে স্মরণিকা হয়ে থাকার যোগ্য।

স্বাদে আহ্লাদে

বোস বাবুদের কড়া লিকারের চায়ের নামডাক একদম শুরু থেকেই। এখানে এসেছেন আর চা পান করেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চা খেয়েই তৃপ্তির ‘আহ’ দিয়ে শুরু। মনে হয় মগজে ধাক্কা দিলো। সন্ধ্যার কাছাকাছি বলে অর্ডার করলাম কাটলেট আর আলুর চপ। ২০ টাকার চা আর ৮০ টাকার কাটলেট। দুপুরের দিকে এলে স্বল্প তেলে রান্না এক পোলাও পাওয়া যায়। দেরী হয়ে যাবার কারণে স্বাদ নেয়া হয়নি। তবে ডিম, পরোটা, মুরগিসহ সবই পাওয়া যায়।

অর্ডার করতেই চা আর কাটলেট চলে এলো। দেখলাম এখানে হাল আমলের মতো সসের প্রচলন নেই। শশা আর পিঁয়াজের মিশ্রণ দেয়া হয়। কড়া লিকারের চা, কাটলেট আর মেঘসন্ধ্যায় এক ঐতিহ্যের রেস্তোরাঁ। বাহ, আর কি চাই !  

তেঁতুল বিচির রঙের ঘন খয়েরি রঙের বার্নিশ করা আসবাব। সারবাধা চেয়ার টেবিল। চা  পরিবেশন করা হয় স্টিলের থালায় করে। মাথার উপর কাঠের পাটাতন। ঘুরুতে থাকা সাবেকি আমলের পাখা। তাঁকিয়ে মনে হলো ফার্স্ট জেনারেশন ন্যাশনাল ফ্যান। আমাদের বাসাতেও আছে একটা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে অনেক আগেই। বাড়ির কথা মনে পড়লো। স্মৃতিমেদুর হৃদয়ে সংক্রমণ ঘটালো আদ্রতা।  

বের হবার আগে  ভুলুবাবুর নাতি তারক চন্দ্র বসুকে জিজ্ঞেস করলাম বোস কেবিনের নামের সাথে নেতাজীর কোন সম্বন্ধ আছে কিনা। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “আমরাও কিন্ত বোস, পরিবারের উপাধি অনুসারেই নাম রাখা।“ বিদায় দিয়ে বললেন, “আবার আসবেন।“

বিদায়ের প্রত্যাবর্তন

একটা সময় ছিলো প্রতিবছরই আসা হতো। সংসার ধর্মে জড়িয়ে তিনবছর পর গেলাম নারায়ণগঞ্জের চেম্বার রোড সংলগ্ন বোস কেবিনে। বিদায় এক আবশ্যক পর্ব। দ্রুত বা বিলম্ব, বিদায় নিতেই হয়। পুরনো বন্ধুর মতো, ছেড়ে আসা পাড়ার মতো উঠে আসতে হয়। বিশ্বায়নের যুগে ‘জীভে জল’ রসনা সহজ হয়েছে অনেক।

বাড়িতে বসেই অনলাইন অর্ডারে স্বাদ নেই কোন এক ম্যাক্সিকান ডিশের। তাই স্বাদের প্রশ্নে আহামরি কিনা জানি না। তবে আহ্লাদের প্রশ্নে আমাদের এমন অনেক হোটেল রেস্তোরা উপরে থাকবে অবশ্যই। ককো শ্যানেল বলেছিলেন, “The right ingredients can create a legend.”  এই বোস কেবিন-এর ক্ষেত্রে লিজেন্ডটা কি? শুধুই স্বাদ, নাকি তিন রাষ্ট্র , তিন প্রজন্ম আর ঐতিহ্যের দর্শন। ভাবতে ভাবতেই ঢাকাগামী বাসে উঠলাম।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement