৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, রবিবার

জাতীয় চার নেতার আত্মত্যাগ চির অম্লান

Advertisement

৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসে ঘৃণ্য ও কলঙ্কিত দিন। এদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় রাতের অন্ধকারে জাতির চার সূর্যসন্তান, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর ও জাতীয় চার নেতাকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

কারাগারের ভেতরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে এমন বর্বরোচিত হত্যায় সেদিন বিশ্বকে হতবাক করেছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল মানবতা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ২ মাস ২০ দিন পরেই দেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আরেকটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সফল করে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আত্মপরিচয়কে ভূলুণ্ঠিত করতেই বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে হত্যা করা হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর প্রধান ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এই চার নেতা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেন। এতে মোশতাক তার ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ২৩ আগস্ট এই চার নেতাকে গ্রেপ্তার ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করা হয়। মোশতাক নিজের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে কারাগারের ভেতরেই ৩ নভেম্বর তাদের হত্যা করে। এই চার নেতা বর্ণাঢ্য দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনসহ প্রতিটি সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী নেতা।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। রাত দেড়টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। পিকআপে কয়েকজন সেনাসদস্য বসা। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ছিলেন আমিনুর রহমান। কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলারকে কারাগারে আসার নির্দেশ দেন। জেলার আমিনুর রহমান তার কক্ষে ঢুকতেই টেলিফোন বেজে ওঠে। টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয় রাষ্ট্রপতি আইজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। আইজি সাহেব ফোনে কথা বলে জেলারকে জানালেন, প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর। সেনাসদস্যদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন চার নেতাকে একত্র করার আদেশ আসে। কারা মহাপরিদর্শক একটি কাগজে চার নেতার নাম লিখে জেলারের হাতে দেন। এই চার নেতা হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।

কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। অপর একটি কক্ষে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। তাদের এক জায়গায় আনা হলো। কিন্তু চার নেতার কেউই জিজ্ঞেস করলেন না, তাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে। চারজনকে একত্র করতে কিছুটা সময় লাগে। এ কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের খারাপ ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। চার নেতাকে একত্র করার পরই সেনাসদস্যরা গুলি করে তাদের হত্যা করেন। কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেনি।

পরের দিন পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান, তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন। সেদিন বিকালে খবর আসতে শুরু করে তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এই চার নেতাকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়তো সম্ভব নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রাখেন তারা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম মহান মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তান কারগারে বন্দি ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। সেই সংকটময় সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি গণপরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হন।

তাজউদ্দীন আহমদ ১০ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে বন্দি অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাজউদ্দীন আহমদ গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর তিনি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে অর্থ এবং পরে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি সংবিধান রচনায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬ দফা আন্দোলনের সময় দেশরক্ষা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মনসুর আলী ১৯৪৮ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং পিএলজির ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনায় তিনি অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে আবদুল্লাহ আল মাহমুদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মনসুর আলী পুনরায় পাবনা-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করলে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

জেলখানায় নিহত অপর জাতীয় নেতা এএইচএম  কামরুজ্জামান। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফার আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে কামরুজ্জামান রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর- দুটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা এই চার নেতাকে জেলের অভ্যন্তরে হত্যার পেছনে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করারই অংশ। জাতির পিতার আদর্শ সমুন্নত রেখে ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা রুখে দিতে এই চার নেতা অতীতের মতো জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারে- এটাই ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের ভয়। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং তারপর চার নেতাকে হত্যা প্রকৃতপক্ষে একই ষড়যন্ত্রের অংশ। একাত্তরে বিজয়ের ঊষালগ্নে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বাঙালিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা হয়েছে। একইভাবে সেই পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা খুনি মোশতাক ও তার দোসররা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সত্যের কাছে তাকে পরাজিত হতেই হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement