৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, রবিবার

সৈয়দ নজরুল ইসলাম

Advertisement

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মনসুর এবং কামারুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্রসম। এই চারজনকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়তো সম্ভব না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছেন জাতীয় এ চার নেতা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে ঘাতকের ব্রাশ ফায়ারে নিহত হওয়া এ চার নেতাকে বাঙালি জাতি আজো মহান নেতা হিসেবে চেনেন।

মুজিবনগরের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার যমোদল দামপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে এমএ (ইতিহাস) এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনকালে গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কর বিভাগে অফিসার পদ লাভ করেন। ১৯৫১ সালে সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি ময়মনসিংহে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে সমাসীন ছিলেন।

১৯৬৬ সাল থেকে ৬-দফা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আইয়ুব সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবসহ বহুসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। সেই সঙ্কটময় সময়ে (১৯৬৬-৬৯) সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং এর অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে (জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৬৯) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনের লক্ষ্যে রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারের সাথে বিরোধী দলগুলোর গোলটেবিল বৈঠকে (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১০-১৩ মার্চ, ১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি গণপরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে (১৯ মার্চ, ১৯৭১) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সঙ্গী। ২৫ মার্চ (১৯৭১) শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। নবগঠিত এই সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রিপরিষদে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠনে তিনি নিরলস কাজ করেছেন।

১৯৭২ সালে তিনি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-২৮ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদে দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। তিনি শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি হন।

ওই বছর বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য কর্তৃক সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এরপর দেশে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হয়ে পুরনো সহকর্মীদের কয়েকজনকে তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ চার নেতা (তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান) উক্ত মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে ২৩ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে বনানী গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement