২৯ মার্চ, ২০২৪, শুক্রবার

৯ বছর পর প্রথমবার প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা খেল সিমেন্টশিল্প খাত

Advertisement

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, আবাসন খাত ও গ্রামে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের ওপর ভর করে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে। করোনার দুঃসময়েও সিমেন্ট খাত প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থেকে ছিটকে পড়েনি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে সদ্য বিদায়ী ২০২১–২২ অর্থবছরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় এই শিল্পেও প্রবৃদ্ধি হবে—এমনটিই ছিল প্রত্যাশ্যা। তবে সেই প্রত্যাশা মাটিচাপা দিয়ে ৯ বছরের মধ্যে প্রথমবার প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা খেয়েছে সিমেন্ট শিল্প খাত।

সিমেন্টশিল্পের কাঁচামালের শতভাগই আমদানিনির্ভর। কাঁচামাল আমদানির তথ্য দিয়ে সিমেন্ট উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়। কাঁচামাল আমদানির তথ্যে দেখা যায়, গত ৯ বছরের মধ্যে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে প্রথমবারের মতো কাঁচামাল আমদানি কমেছে। কাঁচামাল আমদানি কমলেও উৎপাদন কমার চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সিমেন্ট উৎপাদকেরা ধারণা করছেন, গত অর্থবছরে ৮ শতাংশের কাছাকাছি উৎপাদন কমেছে।

দেশে সিমেন্টের চাহিদা বাড়তে থাকায় গত এক দশকে উৎপাদনপ্রযুক্তিতে পরিবর্তন এনেছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। ব্যবসা ও কারখানা সম্প্রসারণ করেছে অনেক কোম্পানি। নতুন প্রযুক্তি ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগও হয়েছে বিপুল। কিন্তু এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অস্থিরতায় এই বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, সিমেন্টের কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়ার কারণ চাহিদা কমে যাওয়া। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় দেশেও মূল্য সমন্বয় করতে হয়েছে। আবার রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সংকটময় পরিস্থিতিতে আবাসন খাত ও গ্রামীণ অর্থনীতি থমকে গেছে। সরকারও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। এ জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের শ্রেণিকরণ করা হয়েছে।

“ডলারের দামের অনিশ্চয়তার কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে ভয় পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে সামনে কাঁচামাল আমদানি আরও কমে যেতে পারে।
মো. আলমগীর কবির, সভাপতি, সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতি

আলমগীর কবির আরও বলেন, ডলারের দামের অনিশ্চয়তার কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে ভয় পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে সামনে কাঁচামাল আমদানি আরও কমে যেতে পারে। তখন শুধু সিমেন্ট খাত–ই নয়, উৎপাদনমুখী খাতগুলোতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো ক্লিংকার, জিপসাম, স্ল্যাগ, চুনাপাথর ও ফ্লাই অ্যাশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে সিমেন্ট উৎপাদকেরা ৩ কোটি ৩৫ লাখ টন কাঁচামাল আমদানি করেছেন। আগের অর্থবছরের (২০২০–২১) তুলনায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৮ লাখ টন বা ৮ শতাংশ। কাঁচামালের আমদানি কমলেও খরচ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ২০২১–২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৪০টি প্রতিষ্ঠান (একই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ) এ কাঁচামাল আমদানি করেছে। কোম্পানিভেদে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি বাড়লেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই আমদানি কমেছে।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্য সব পণ্যের মতো বিশ্ববাজারে সিমেন্টের কাঁচামালেরও দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি জাহাজভাড়া। ২০২০–২১ অর্থবছরে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বন্দর পর্যন্ত টনপ্রতি গড়ে খরচ হয়েছে ৪৪ ডলার। গত অর্থবছরে এই খরচ ৩২ শতাংশ বেড়ে ৫৮ ডলারে উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ক্লিংকার আমদানিতে টনপ্রতি ৬৯ ডলারও খরচ পড়েছে। এখন টনপ্রতি ক্লিংকার আমদানিতে খরচ পড়ছে ৬২–৬৩ ডলার। ক্লিংকার উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লার দাম না কমায় বিশ্ববাজারে খুব বেশি কমেনি এই কাঁচামালের দাম।

উদ্যোক্তারা বলছেন, নির্মাণশিল্পের প্রধান দুই উপকরণ হলো সিমেন্ট ও রড। এই দুটি উপকরণের দাম যখন বেশি থাকবে তখন ব্যক্তিপর্যায়ে বাড়িসহ অবকাঠামো নির্মাণের পরিমাণ কমে যায়। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় গত অর্থবছরে রডের দাম বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠেছিল। বেড়েছে সিমেন্টের দামও। মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সিমেন্ট বিক্রিতে। আবার সরকারি যেসব বড় প্রকল্পে সিমেন্টের চাহিদা রয়েছে, সেগুলোর কোনোটি শেষ হয়েছে কোনোটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাতেও চাহিদা কিছুটা কমেছে।

“ব্যাংকগুলোয় ডলারের দামে এখন যে নৈরাজ্য চলছে, তা থামানো না গেলে শুধু সিমেন্টশিল্প নয়, দেশের শিল্পায়নই বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করছে, সেই দামে আমদানি ঋণপত্রের দর সমন্বয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে।”
আমিরুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রিমিয়ার সিমেন্ট

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া চাপ সামাল দিতে সরকার উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাঁট করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে এ, বি ও সি—এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এ শ্রেণির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলেও বি শ্রেণির প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর সি শ্রেণির প্রকল্পগুলো আপাতত স্থগিত থাকবে। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাঁটের প্রভাব পড়বে সিমেন্ট বিক্রিতে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরও বিক্রি ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করছেন না উদ্যোক্তারা।

জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ব্যাংকগুলোতে ডলারের দামে এখন যে নৈরাজ্য চলছে, তা থামানো না গেলে শুধু সিমেন্টশিল্প নয়, দেশের শিল্পায়নই বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করছে, সেই দামে আমদানি ঋণপত্রের দর সমন্বয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রয়োজনে শিল্পের কাঁচামাল, অতিপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, ওষুধ ও রপ্তানিমুখী পণ্যের কাঁচামাল ছাড়া আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা উচিৎ।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement