শেয়ার বাজার, ব্যাংক আমানতে, নগদ টাকা, ফ্লাট ক্রয়সহ সকল ক্ষেত্রে বিনা প্রশ্নে ১০ শতাংশ কর দিয়ে এবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। করোনার ধাক্কার মধ্যেও ঢাকায় প্রায় সব রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে।
দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা এই সুযোগ আর না বাড়ানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষভাবে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ বাড়ানো, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও রাজস্ব বাড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে তাঁর বাজেট ঘোষনায় গতবারের মতো কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ বহাল রাখার ব্যাপারে কিছু জানাননি।
বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক, ১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২১-এর মধ্যে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা অপ্রদর্শিত অর্থ, জমি, ভবন, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
চলতি বাজেটে সরকারের দেওয়া সুযোগ নিয়ে এযাবৎকালে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। দুই শতাধিক ব্যক্তি ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিপরীতে ২৬০ কোটি টাকা সাদা করায় এনবিআর কর পেয়েছে ২৬ কোটি টাকা। জমি কেনার মাধ্যমে এক হাজার ৫০০ করদাতা কালো টাকা সাদা করায় কর মিলেছে ১২৪ কোটি টাকা। অ্যাপার্টমেন্ট কিনে দুই হাজার ৬০০ করদাতা কালো টাকা সাদা করায় কর আদায় হয়েছে ১২২ কোটি টাকা। আর ছয় হাজারের বেশি করদাতা নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত ও অন্যান্য আর্থিক স্কিমে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি কর আদায় হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে এভাবে মোট সাদা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ: ১৯৮৭ সালে কালো টাকা সাদা করতে ২০ শতাংশ কর ধরা হয়। আয়কর রিটার্নে ‘অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়’ ঘোষণা করলে করদাতার রিটার্নে রেয়াতি হারে পর্যায়ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালেও একই হারে কর আরোপ করা হয়। সেটা ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই সময় দ্রব্যাদি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ, যন্ত্রপাতি, প্লান্টস, যন্ত্রাদি ও সব ধরনের সরঞ্জাম প্রস্তুতকরণে বিনিয়োগ এবং দুই বছর শেয়ার বিক্রি করতে না পারার শর্তে নতুন শেয়ার বা স্টকে বিনিয়োগের বিধান রাখা হয়। ২০০০ সালেও এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কালো টাকার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। আর ঘোষিত আয় সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—এমন বিধান যুক্ত করা হয়। কালো টাকা সাদা করতে করহার কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় ২০০৫ সালে। ওই সময় বলা হয়, ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেসের কাছে ঘোষণা করলে আয় সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না। ঘোষিত আয়ের ওপর হ্রাসকৃত ৭.৫ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হবে।
সাদা হয়েছে যত কালো টাকা : স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সামরিক আইনের আওতায় প্রথম সুযোগ দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর পালাক্রমে সব সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। আর এই সুযোগ নিয়ে প্রায় ১৪ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা আসে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ১/১১ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ হয়। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টাকা সাদা করার সুযোগ নেয়।
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়, কেউ নতুন শিল্পে বিনিয়োগ করলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আর ৭.৫ শতাংশ কর দিলে কর অবকাশ সুবিধাও দেওয়া হবে।
২০১৭ সালের ৮ জুন জাতীয় সংসদকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত (২০১৭ সাল) দেশে অপ্রদর্শিত ১৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। আর তা থেকে রাজস্ব এসেছে এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।