২৭ জুলাই, ২০২৪, শনিবার

তদারকির অভাব: দফায় দফায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি

Advertisement

৭৯ বছর বয়সী আবুল কালাম গত ১৪ বছর ধরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের জন্য প্রতিদিন ওষুধ খান। দু’বেলা নেন ইনসুলিন। বৈশ্বিক করোনায় আয় কমেছে। হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় এসব ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি।

বাজারে আবারও বেড়েছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম। এই নিয়ে কয়েক দফা ওষুধের দাম বাড়ল। এছাড়া ফার্মেসিভেদেও রয়েছে দামের পার্থক্য। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো ওষুধের দাম দ্বিগুণও রাখা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছেন ওষুধ প্রস্তুতকারকরা।

গত তিন মাসে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেষ্টেরল, গ্যাষ্ট্রিকসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ২৩ ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। ওষুধের দাম বাড়ানোয় বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের রোগীরা। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয় এ ধরনের রোগীর রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায় স্কয়ার, অপসোনিন, বেক্সিমকো, ইবনে সিনা, ইনসেপটা ও রেনেটাসহ বেশ কিছু কোম্পানির ওষুধের দাম বেড়েছে। এসব কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের মধ্যে গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরলসহ অত্যাবশ্যকীয় এসিফিক্স ২০ এমজি, ফিনিক্স ২০ এমজি, বাইজোরান ৩/২০ ও ৩/৪০ ছাড়াও ফ্লেক্সি, মোটিগার্ট, ডন, মুডঅন, মোনাস, অমিডন, রুপাট্রলসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ বর্ধিত দামে ওষুধগুলো বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পাতায় গড়ে এগুলোর দাম ২ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

বাড়তি মুনাফার লোভে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে বিক্রি করছে ফার্মেসিগুলো। ৭৫০ টাকার আইভেরা ৬ এমজি ট্যাবলেট ২৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকার স্ক্যাবো ৬ এমজি ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। ২৫ টাকার জিংক ট্যাবলেট ৫০ টাকা, ২০ টাকার সিভিট ট্যাবলেট ৫০ টাকা, ৩৬০ টাকার রিকোনিল ২০০ এমজি ৬০০ টাকা, ৪৮০ টাকার মোনাজ ১০ এমজি ট্যাবলেট ১০০০ টাকা, ৩১৫ টাকা অ্যাজিথ্রোসিন ৫০০ এমজি ট্যাবলেট ৬০০ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে।

ফার্মেসি মালিকদের অভিযোগ, তারা ওষুধের সরবরাহই পাচ্ছেন কম। বিক্রয় প্রতিনিধিরাই বেশি দাম নিচ্ছেন দোকানিদের কাছ থেকে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার-পাঁচদিন আগে স্কয়ার কোম্পানির মক্সাক্লেভ ১ গ্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটের (জেনেরিক অ্যামক্সিসিলিন+ ক্লেভলানিক অ্যাসিড) ১২টির দাম ছিল ৩৬০ টাকা। বর্তমানে তা ৫৪০ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে মক্সাক্লেভ ৬২৫ মিলি ১৮টি ট্যাবলেটের দাম ৪৫০ থেকে বেড়ে ৫৭৬ টাকা, ফেক্সো ১২০ মিলি ৫০টি ট্যাবলেট ৩২৫ থেকে বেড়ে ৪০০ ও ফেক্সো ২৪০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ১৮০ থেকে বেড়ে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া নেবুলাইজারে ব্যবহূত অপসোনিন কোম্পানির উইনডল প্লাস ১০টির দাম ১৫০ থেকে বেড়ে ২০০, মেট ৫০০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ৯০ থেকে বেড়ে ১২০, হাইসোমাইড ১০ মিলি ১০০টি ট্যাবলেট ৩৪৩ থেকে বেড়ে ৬৯০, একমি ল্যাবরেটরির কফরিড সিরাপ প্রতিটি ৫৫ থেকে বেড়ে ৬০, কেটিফেন ট্যাবলেট ৪৫ থেকে বেড়ে ৫০, লেপটিক ৫ মিলি ১০০টি ট্যাবলেট ৩০১ থেকে বেড়ে ৪০০, লেপটিক-২ ৫০টি ট্যাবলেট ২৫০ থেকে বেড়ে ৩০০, টপিয়াম ইনহেলার ১৫০ থেকে বেড়ে ২১০, সালফ্লু ১০০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ১৪৩ থেকে বেড়ে ১৯০, সালফ্লু ২৫০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ২৭২ থেকে বেড়ে ৩১৫, সালফ্লু ৫০০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ৪৫৩ থেকে বেড়ে ৪৮০, প্রোটোসাইড ২০ মিলি ৫০টি ট্যাবলেট ২২০ থেকে বেড়ে ২৫০ ও প্রোটোসাইড ৪০ মিলি ৩০টি ট্যাবলেট ৩০০ থেকে বেড়ে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতির জন্য স্বাস্থ্যসেবার নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাকে দায়ী করেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। তিনি বলেন, রাজধানীসহ দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। যা রোগীর জীবনঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, বাজারে ২৩ ধরনের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে এটাই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বাজার তদারকির কেউ নেই। নিয়মিত বাজার তদারকির ব্যবস্থা না থাকলে ওষুধের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ওষুধ কেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। পাশাপাশি ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রিও বন্ধ হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদনভিত্তিক ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি বাড়ায় এ খাতের যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এই খাতের উন্নতি বেশ দৃশ্যমান। তবে অযৌক্তিক এবং লাগামহীনভাবে যদি ওষুধের দাম বাড়তেই থাকে তা হলে স্বল্প আয়ের সাধারণ রোগী এবং অবসরে থাকা বয়সে প্রবীণরা বিপাকে পড়বেন। এটা ভেবে দেখা দরকার।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে সর্বমোট ২৬৯টি এ্যলোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৪ হাজার রকমের ওষুধ তৈরি করে। আর সরকারিভাবে উৎপাদিত হয় ১১৭ ধরণের ওষুধ। যার দাম নির্ধারণ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বেসরকারি কোম্পানীগুলো নিজেদের চাহিদা মতো ওষুধের দাম বৃদ্ধির অনুমতি নিয়ে রাখে। সুবিধামতো সময়ে তারা বাজারে বাড়তি দামে ওষুধ ছাড়ে।

ওষুধের এই বাড়তি দাম সম্পর্কে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, সরকার নির্ধারিত ১১৭টি ওষুধের বাইরে ব্যক্তিখাতের প্রতিষ্ঠান আলোচনা সাপেক্ষে নিজেদের পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। তিনি বলেন, বেশ কিছু ওষুধের দাম কমানো ও সমন্বয় করা হয়েছে।

হঠাৎ করে ওষুধের দাম বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক বলে দাবি করছে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি। তারা বলছেন, যেগুলোর দাম বেড়েছে তা আগে থেকেই অনুমতি নেয়া ছিলো।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement