২৭ জুলাই, ২০২৪, শনিবার

ধারাবাহিক উপন্যাস : এখন অনেক রাত

Advertisement

(এক)
আজকের দিনটা একেবারেই অন্যরকম। পৌষের এই শেষ সময়টায় কুয়াশা নেই তেমন। ঝকমকে আলো গিলে খেয়েছে কালো মেঘ। তবে ভোর থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি বাড়িয়ে দিয়েছে কনকনে ভাবটা। সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রেন। শান্তিবাগের দোতলা পুরনো বাড়িটার শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে নামছি আমি আর বাবা। বাবার কাঁধে সুটকেস। আমার কাঁধে লেপ-তোষকের দশাসই এক বস্তা। ছাদের চিলেকোঠা বেয়ে বৃষ্টির পানি চু্ইঁয়ে পড়ছে অবিরাম।

দরোজায় দাঁড়িয়ে মা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাবা খানিকটা ধমকের সুরেই চেঁচিয়ে উঠলেন।

– সাগরের মা, তুমি ছেলেটার মাথা খাইবা। এত্তবার কইছি যাত্রাকালে কান্না অশুভ ব্যাপার। কোন কিছুই তো মানলা না জীবনে আমার কথা।

গজগজ করে বাবা নেমে গেলেন নিচে। আমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলাম। মা দৌড়ে এসে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিলেন বুকে।

-সাবধানে থাকিস। ঠিকমত খাইস। চিঠি দিস।

কী বলা উচিত বুঝতে না পেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাবার পিছু নিলাম। পুরনো ক্যাসিও হাতঘড়িটায় দেখে নিলাম ছটা পঁয়ত্রিশ। ট্রেন ছাড়তে এখনো এক ঘন্টা দেরি। বাসার বাইরের ছোট্ট বাগানটায় ভেজা গাঁদাফুল। ঘাসফুলের লাল রঙ পুরনো ইটের মর্যাদাকে যেন খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বাড়িকে ঘিরেই এতটুকু জীবনের কত স্মৃতি, কত আবেগ, কত দুঃখগাঁথা। এতটা লম্বা সময়ের জন্য এ বাড়ি ছাড়তে হবে ভাবিনি কখনো।

জন্মের পর এ বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও থাকিনি কখনো। চব্বিশ বছরে মায়ের আঁচল টেনেই যেন বড় হয়েছি আমি আর আমার ছোট ভাই হিমেল। বাড়িটা আমাদের না। বাবা আদমজী জুট মিলের শ্রমিক নেতা ছিলেন। আদমজীর অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার হাবিল মিয়া বাবাকে থাকতে দিয়েছিলেন দোতলার দুটি রুমে। তখন থেকেই অনেকটা কেয়ারটেকারের মত বাড়িটার দেখাশোনা করে আসছেন বাবা।

শ্রমিক রাজনীতিতে টিকতে না পেরে বাবা আমাদের ছোটবেলাতেই চাকুরি ছেড়ে দেন। তখন থেকেই বাড়ির নিচে ছোট্ট একটা মুদি দোকান চালিয়ে কোনমতে চলে চারজনের সংসার। টানাটানির অন্ত নেই। নিচতলায় হাবিল চাচার দুসর্ম্পর্কের এক আত্মীয় পরিবার নিয়ে থাকেন। মিল বন্ধ হওয়ার পর হাবিল চাচা খুলনার কোন এক বেসরকারি মিলে চাকুরি নিয়ে চলে যান।

বৃষ্টি থামেনি। কনকনে উত্তুরে হাওয়াও বইছে জোরেশোরে। বাবা স্যুটকেস রেখে কোথা থেকে যেন একটা অটোরিক্সা জোগাড় করে এনে মালপত্র ঠেসে পেছনে ওঠালেন। তাড়া দিলেন।

-হা কইরা দেখিস কী। ওঠ। পরে তো ট্রেন মিস করবি।

কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে প্রায় ঠেলেই আমাকে বেবিট্যাক্সিতে বসালেন বাবা। ভেতর থেকে মাথা বের করে উঁকি দিলাম। মা দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাত নেড়েই যাচ্ছেন। দু’চোখ ভিজে উঠল নিজের অজান্তে। বাবা বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন হয়ত। ট্যাক্সিতে উঠেই শক্ত করে ধরলেন আমার হাত। চব্বিশ বছরের জীবনে বাবাকে প্রচন্ড রাগী মানুষ বলেই জানি আমি। কখনো নরম হতে, কখনো কাঁদতে দেখিনি। আজ বাবার শক্ত হাতের বন্ধন আমার ভেতরটা কেমন যেন নাড়িয়ে দিল।

বাবার ভেতর কী তাহলে অন্য আরেক মানুষ বাস করে। বাইরের কঠিন মানুষটার ভেতর কী এক অদ্ভুত কোমল শিশুর সরলতা লুকিয়ে রাখেন! বুঝতে দেননা কাউকে, পাছে কাঠিন্য হারিয়ে যায় কোমলের আড়ালে। আসলে মানুষের বাইরের চেহারা দেখে কতটুকু চেনা যায় তাকে! একজন মানুষকে চিনতে একজনমও যথেষ্ট না, আবার কাউকে এক লহমাই চিনে ফেলা যায়, পড়ে ফেলা যায় খোলা বইয়ের পাতার মত। বাবাকে কী আসলেই তাহলে চিনতে ভুল করেছি!

টানাপড়েনের সংসার বলে বাবার কাছে কোন আবদার তোলার সাহস হয়নি কখনো। দু’একবার বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা দিতে গিয়ে বাবার কাছে এটা সেটা দাবি করে যে রূদ্রমূর্তি দেখেছি, বাকি জীবনে তাই আর সাহস করে বাবার সামনে মাথা উঁচু করে কিছু চাওয়ার সাহস হয়নি।

আজকের দিনটা তাই সত্যিই একেবারে অন্যরকম। সামান্য বৃষ্টিতেই মালিবাগ, শান্তিনগর এলাকায় হাঁটু পানি। পানি ঠেলে ইঞ্জিন নৌকার মত ভটভট শব্দে এগুচ্ছে অটোরিক্সা। লোকজনের আনাগোনা নেই তেমন। কয়েকটি স্কুল ভ্যান। এলোমেলো করে রাখা রিকশা। কয়েকটা ভাঙাচোরা বাস। ফুটপাথে চায়ের দোকানগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে। বাবা চুপচাপ আমার হাত ধরে বসে আছেন। যেন দুজনে কথা বলা ভুলে গেছি। নীরবতাও যে কখনো কখনো শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠতে পারে এই মুহুর্তটা না আসলে হয়তো জানা হত না কখনো।

সাতটার ঠিক আগে আগে স্টেশনে পৌছলাম আমরা। এখানে সেখানে মানুষের জটলা। বাবা সামনের দোকান থেকে পানির বোতল, হরেক রকম বিস্কুট কিনলেন। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাবে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। সামনের দিক থেকে তিন নম্বর বগিতে আমার সিট। মোটা একটা লাল সোয়েটার, গ্যাভাডিনের প্যান্ট আর গলায় মাফলার পরায় এই শীতেও প্রচন্ড ঘাম হচ্ছে। মানুষের ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। বাবাই জোরাজুরি করে মালপত্র ওপরে ওঠালেন। পাশের যাত্রী না আসা পর্যন্ত চুপচাপ আমার হাত ধরে বসে রইলেন। আমিও নিশ্চুপ, নিঃস্তব্ধ। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। বাবাকে অনেকটা ঠেলেই নামালাম। জানালার কাছে ছুটে গেলেন বাবা। মুখে যেন খই ফুটতে লাগল।

-তোর সেলিম আংকেলকে সব বলা আছে। উনি সিলেট থেকে তোকে বড়লেখা নিয়ে যাবে। আর শোন সিলেট স্টেশনে নেমে দেখবি প্ল্যাটফর্মেই রাতুল স্টোর। ওখানে গিয়ে দাঁড়াবি। তোর আংকেলকে বলেছি লাল সোয়েটার, ফর্সা একহারা গড়নের সাগর। তোকে দেখলেই চিনবে। তুই ওখানে নেমে ফোন দিস। আর শোন। চিন্তা করিস না। খাবি ঠিকমত। চা বাগানের অফিসে ল্যান্ড টেলিফোনও আছে। আমি খবর নিব। আর শোন…..

ট্রেনের চাকা গড়াতে শুরু করেছে। আমার হাত শক্ত করে ধরে ট্রেনের সাথে ছুটছেন বাবাও। একুশ বছরে বাবার চোখে প্রথমবার জল দেখছি। বাবা কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন। আমিও কাঁদছি জানালায় গলা বের করে। আমার মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছেন। বাবার কাছে আজ যেন ফিরে গেছি সেই শিশুবেলায়। দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে ট্রেন। হাত ছুটে গেল একসময়। পেছনে পড়ে রইল বাবা। ঝিক ঝিক কুউউ শব্দে এগিয়ে চলেছে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। ভবিষ্যতের সন্ধানে সামনে ছুটে চলেছি চব্বিশ বসন্তের আনকোরা এই যুবক। যার সামনে অপেক্ষমান সোনালী স্বপ্নেরা। সে স্বপ্নেরা কতটা মুঠোবন্দি হয়, বা হাত ফসকে বেরিয়ে যায়- কে জানে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্ম্পার্টমেন্টটায় আমার সিটের মুখোমুখি আরেক সিট। ছয়জনের আসনের পাঁচজনই এক পরিবারের। সতের আঠার বছরের এক তরুণী, তার মা, ছোট দুই ভাই বোন ও একজন মধ্যবয়সী লোক। লোকটি কথাবার্তায় বেশ ভদ্রগোছের।
ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। টঙ্গী ছাড়িয়ে পূবাইলের দিকে এখন।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে জানালা গলে কনকনে শীতের ঝাপটা এসে লাগছে মুখে। জানালার পাশে মন খারাপ করে বসে আছি। কখনো আপনজনকে ছেড়ে এভাবে দূরে থাকা হয়নি কখনো। জানালায় মুখ রেখে বৃষ্টিভেজা মাঠ, পেছনে ছুটে যাওয়া ঘরবাড়ি দেখছি। মা’র জন্য প্রচ- মন খারাপ লাগছে। পাশের আসনের যাত্রীরা হাসি ঠাট্টায় মশগুল। বড্ড বেমানান হয়ে মুখ গোমড়া করে বসে থাকা ছাড়া যেন আর কোন কাজ নেই।

-তুমি কোথায় নামবে বাবা।

-জ্বি সিলেট।

-ওহ ভালই হল। একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

-জ্বি।

-সিলেটে কোথায় যাবে বাবা।

-জ্বি , আমি সিলেট যাইনি কখনো। বাবা বড়লেখায় একটা চা বাগানে আমার চাকুরি ঠিক করেছেন। বাবার বন্ধু আছেন একজন সেলিম সাহেব। উনি চা বাগানের ম্যানেজার।

-খুব ভাল। আমরা থাকি হবিগঞ্জে। আমি ডা. পারমিতা। আমার হাজব্যা- সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার।

-জ্বি।

-ও আমার মেয়ে পলি।

যাত্রার প্রায় ঘন্টাখানেক হল। আসলে সেভাবে তাকানো হয়নি মুখোমুখি বসা অষ্টাদশী তরুণীর দিকে। মুখ তুলে তাকালাম। লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নামিয়ে নিল। ঘিয়ে রঙের থ্রিপিস, মাথায় স্কুল ছাত্রীদের মতো দুটো বেনী, ঝুমকো ফুলের মত নাকফুল, শ্যামলা বরণ তরুণীর চোখে চোখ পড়তেই চব্বিশ বসন্তের পরে যেন পঁচিশ বসন্ত বাতাস এসে দোলা দিল মনে।

-জ্বি। স্লামালেকুম।

-ওয়ালেকুম সালাম। পলি আমি সাগর।

-জ্বি। পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।

-সাগর আমার মেয়ে পলি, হবিগঞ্জ সরকারি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে পড়ছে। এবার এইচএসএসসি দেবে। আর ওর নাম পল্লব। ক্লাস সেভেনে পড়ছে। পান্না আমার একমাত্র আদরের মেয়ে।

ছোট মেয়ে পান্নাকে বুকে টেনে নিলেন ডা. পারমিতা। পান্না আমার পাশেই বসে ছিল। দৌড়ে মায়ের বুকে মুখ গুজল। পলি খানিকটা আদুরে গলায় ছুটে গেল মায়ের কাছে।

-মা, সত্যিই কী পান্না তোমার আদরের মেয়ে। আমরা কেউ না।

-পাগলি মেয়ে।

তিন ছেলে মেয়েকে পরম আদরে বুকে টেনে নিলেন ডা. পারমিতা। আমার পাশে বসা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক উঠে এগিয়ে গেলেন সামনে।

-আর আমি! এই পারমিতা পরিবারের সবচেয়ে আপন মানুষ।

-ওহ, সাগর। উনি শামসু ভাই। আমাদের হাসপাতালের স্টাফ। অবশ্য স্টাফ বলবো না। উনি আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য।

বিগলিত হাসিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন শামসু মিয়া। আমিও মুখে হাসি ঝুলিয়ে আপন করে নিলাম তাকে।

-জ্বি, বাবাজি আমি শামসু মিয়া।

-জ্বি।

-দেখছেন না আমার এক চউক্ষে ছানি।

-জ্বি।

-এইডাই হইল গিয়া আমার আসল পরিচয়।

-কিভাবে!

-হাহাহা, আপনে হবিগঞ্জ টাউন থেইক্যা বানিয়াচঙ, যেইহানে যাইবেন। কইবেন, কানা শামসু। হাহাহাহা। ঠিকতে বুইঝ্যা লইবো। কী আর বলব বাজান। হবিগঞ্জ টাউনে কী শামসুর অভাব আছে! কিন্তু কানা শামসু কইলাম একজনই।

-হাহাহা, মজার তো।

-তুমি কিছু মনে কর না বাবা। শামসু ভাই খুব সাধাসিধা মানুষ। একটু বেশি কথা বলেন। দেখেছো না হঠাৎ করেই তোমাকে কত আপন করে নিয়ে কথা বলছে।

মধ্যবয়সী ডা. পারমিতা বা শামসু মিয়া, কারও প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু অষ্টাদশী পলি। ঠিক মুখোমুখি বসে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ডা. পারমিতা যে বললেন, শামসু মিয়া হঠাৎ করেই তোমাকে আপন করে নিয়েছে।

আসলে আপন করে নিয়েছে তো পলি। ঘিয়ে রঙা জামায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। বৃষ্টির ঝাপটার সাথে দমকা হাওয়া তেড়ে আসছে থেমে থেমে। বাতাসে চুল উড়ছে। খোলা চুল মুখে আছড়ে পড়ছে থেমে থেমে। কোমল হাতে সে চুল সরানোর অজুহাতে আড়চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। মৃদু হাসি। সে হাসির কী কোন মানে আছে? নাকি নিছক এক রহস্যময়তা।

নারীদের এই হাসির মর্মভেদ করতে পারাটাই যেন এ যাবৎকালের পুরুষের সবচেয়ে বড় সাফল্য। যে মর্মভেদ করতে পেরেছে, সেই দ্বিগি¦জয়ী, আর মর্মার্থ না বুঝলে অন্ধকারে এক ফোটা আলোতে দাপিয়ে বেড়ানো উইপোকার মতই সে পুরুষের জীবন। যে জীবনে মোহ আছে, ঘোর আছে, দমকা হাওয়ায় দপ করে নিভে যাওয়ার মত আলো আছে, কিন্তু সত্যিকারের বোধ নেই, প্রেম নেই, বোঝাপড়া নেই।

সময়ের সাথে গতি বাড়ছে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের। পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় ফেলে আসার খারাপ লাগা, অন্যদিকে নতুন একটি পরিবারের আথিথেয়তা, ভাল আর খারাপ লাগার মিশেলে এগিয়ে চলেছে সময়। পেছনে পড়ে থাকছে ছবির মত সাজানো গ্রাম, স্টেশনের পর স্টেশন, ব্যাস্ততা, কুলিদের হাঁকডাক- চা গরম, চানাচুর। চারপাশে কত শব্দ। কত ছুটোছুটি। ব্যস্ততা। হুল্লোড়। কিন্তু আমার মন যেন থেমে আছে সেই এক স্টেশনেই।

বার বার কানে ভাসছে ‘‘ ও আমার মেয়ে পলি’’। পলিকে এত চেনা লাগছে কেন! আগে কী কখনো দেখা হয়েছে তার সাথে? মনে পড়ছেনা। তাহলে কেন এত বেশি চেনা, এত বেশি আপন মনে হয়। কিছু কিছু মানুষকে এক মুহুর্তেই এত আপন করে নেবার রসায়ন কী কোন মনস্তত্ববিদ আবিস্কার করেছেন এখনো! নাকি তুমুল এক রহস্যময়তার বেড়াজালেই থেকে গেছে মনের অন্ধকার কুঠুরিতে মিষ্টি আলো ছড়ানো কিছু মুখ। যে আলোতে পথ খুঁজে নেয় উদাসী মন। ঠিকানা খুঁজে নেয়, আপন করে নেয় আপনার চেয়েও আপন করে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে নেমে যাচ্ছে সূর্য। কুউউ ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। কোথায় কোন স্টেশন জানা নেই। ঘুমে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। আমার দাদাজান। খাকি হাফ প্যান্ট পরে, হাতে বেতের লাঠি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে আসলেন। তড়াক করে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমেই আমার ঘাড়ের কাছে লাঠি ধরলেন।

একটুও পালানোর চেষ্টা করবেনা ছোটু। আমি তোমার দাদাজান সৈয়দ আবুল বাশার। ব্রিটিশ পুলিশের খাস অফিসার। হুম নড়বেনা।

আমি বোকার মত তাকিয়ে আছি দাদাজানের দিকে। তিনি লাঠি ঘুরিয়ে আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে পেটে একটা গুতো দিয়েই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

-হা হা হা হা… ভয় পেলে বুঝি দৌহিদ্র। হাহাহাহাহাহ, সৈয়দ বাশারের নাতি ভয় পেল। হাহাহাহা। শোন ভয় পেলে তো চলবেনা রে দাদাভাই। এগিয়ে যা, আর শোন মেয়েটা কে রে?

-জ্বি দাদাজান। পলি।

-পলি কে রে!

-জ্বি, পলি। আর তো কিছু জানিনা দাদাজান।

হঠাৎ কাঁধে প্রবল ঝাঁকুনি। চোখ খুলতেই শামসু মিয়ার বিস্ফোরিত চোখ।

-কী মিয়া, ঘুমের মধ্যে পলি পলি করতাছেন।

সমস্বরে হেসে উঠল পলির পরিবারের সবাই। লজ্জায় রাঙা হয়ে পলি কুকড়ে বসে রইল আমার মুখোমুখি জানালায়। অপ্রস্তুত আমিও জ্বি, হু ছাড়া আর কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। কোন মানে খুঁজে পেলাম না আজগুবি এই স্বপ্নের।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করলেন ডা. পারমিতা। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন।

-বাবা তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। যাও মুখে পানি দিয়ে এসো।

-জ্বি আন্টি।

মুখ ধুয়ে আসতেই প্লেটে সাজানো নানান পদের খাবার। জোরাজুরি করে খাইয়ে দিলেন। সিলেট স্টেশন সম্ভবত কাছাকাছি। যাত্রীরা যার যার মালপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। সামনের একটা ছোট্ট স্টেশনে থামতেই হুড়োহুড়ি করে নেমে গেল ডা. পারমিতার পরিবার। মনটা প্রচ- খারাপ হয়ে গেল।

এই কয়েক ঘন্টার পরিচয়েই কোন গোপন সুতোয় যেন টান পড়ে ব্যাথা পেলাম বুকের ভেতর। মনে হল, পুরো পথ এত আপন করে নিয়ে শেষ পর্যন্ত না বলেই চলে গেল পরিবারটি! আমার ধারনা ঠিক না। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগমুহুর্তে জানালায় এসে দাঁড়ালেন ডা. পারমিতা। হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট। মুঠোয় ধরিয়ে দিয়েই হাঁটা দিলেন উল্টো পথে। সে পথ দিয়ে চলে গেল স্বপ্নকন্যা পলিও। ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে আবার। জানালায় মাথা গলিয়ে হাত বাড়ালাম। এবার ঘুরে দাঁড়ালো পলি। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে হাত নাড়লো। এই হাত নাড়ানো বিদায়ের নয়, এ হাত কাছে ডাকার আকুলতার।

পলিদের বিদায়ের পর চিরকুটটা খুললাম। গোটা গোটা হাতের লেখা।

‘‘সাগর। যাত্রাপথে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। ভাব বিনিময় হয়। কিন্তু তুমি সবার থেকে আলাদা। তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তুমি আমার সন্তানের মতই। যোগাযোগ রেখ। ফোন করো। আমার মোবাইল নাম্বার এবং হাসপাতালের টিএ-টি নাম্বার দিলাম। মোবাইলে না পেলে হাসপাতালে ফোন করে আমাকে চাইলেই হবে। সময় করে বাসায় এসো। – ইতি ডা. পারমিতা।’’

চিরকুটের উল্টো দিকে ডা. পারমিতার বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর। বুকপকেটে চিরকুটটা রেখে কখন যেন আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেছি। দীর্ঘ যাত্রা পথের সব ক্লান্তি যেন নেমে এল শরীরে। ঘুম ঘুম ভাব। তুমুল হই চই এ তন্দ্রা ভাঙলো। একজন মহিলার আহাজারি। হায় হায় রে আমার সব গেল রে।

-ধর শালারে। ধর। এই যে এই যে। ধর। একটারেও নামতে দিবি না।

কয়েকজন তাগড়া যুবক লাঠিসোটা হাতে ঢুকে পড়েছে কামরায়। ট্রেন তখন থেমে আছে। সিলেট রেলস্টেশন। কয়েকজনকে বেধড়ক মারপিট করলো ছেলেগুলো। বোকার মত বসে রইলাম। দু’জন এসে আমার কলার ধরে টেনে তুলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাকে সজোরে ঘুষি মারল। খানিকক্ষণ অন্ধকার দেখলাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে। ঠোট গড়িয়ে লাল সোয়েটারে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত জমাট বাঁধছে। আমি চিৎকার করে বলছি কিছু করিনি আমি। কেন মারছেন।

যতই চিৎকার করি ততই মারের তীব্রতা বাড়ছে। প্ল্যাটফর্মজুড়ে হৈ চৈ। মানুষের জটলা। কোথা থেকে কয়েকজন পুলিশ বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছুটে এল কামরায়। ছেলেগুলোকে শান্ত করে আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে গেল রেলওয়ে থানায়। পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ আর মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে এক কনস্টেবল। ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা হয়ে গেছি আমি।
মালপত্র টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল এক কনস্টেবল। পুরনো লাল ইটের একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভবন।

থানার ডিউটি অফিসারের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো আমরা ছয়জন। অপরাধ জানিনা। ডিউটি অফিসারের পাশে কতগুলো ভাঙাচোরা চেয়ার টেবিল। কয়েকজন পুলিশ মাথা নিচু করে ফাইলপত্র ঘাটছেন। থানা ভর্তি মানুষ। কারও কোন বিকার নেই। ডানদিকের একটা টেবিল ঘিরে দর্শনার্থী আর কয়েকজন পুলিশের জটলা। একটু পর পরই খেঁকিয়ে উঠছেন বয়স্ক একজন সাব ইন্সপেক্টর। থেমে থেমেই শোরগোল করে উঠছেন দর্শনার্থীরা। ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ।

বয়স্ক এসআই মাবুদ মিয়া ঝাড়– হাতে বসে আছেন। টেবিলে একটুকরো কাগজ বিছানো। কাগজে সম্ভবত চিনির সিরা বা মিষ্টি কিছু। পাশেই একটা প্লাস্টিকের বৈয়ম। মাবুদ মিয়া মনযোগ দিয়ে কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা মাছি বসলেই ঝাড়ু নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছেন। সামনে দাঁড়ানো লোকজন হৈ হৈ করে উঠছেন। আবার মাবুদ মিয়া খ্যাঁক করে উঠে মরা মাছিটা বৈয়ম এ ভরছেন।

-ওই শালারা মজা লস , না? ওদিকে কী দেখছ? ওসি রমজান আলী স্যার আইতাছেন। টেরেনের মধ্যে টানকি মারস না? আবার ওই মহিলার ব্যাগের থেইক্যা একুশ হাজার টাকা নিছস। সব শালারে ঝুলায়া পিডালে বাপের নাম ভুইল্যা যাবি।

-আমি কিছু জানিনা স্যার।

লোকটি আমার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন। ঘুরেই হাতের উল্টো পিঠে কষে একটা চড় মারলেন। আমি চুপ। ব্যাথায় কেঁকিয়ে উঠলাম। অকারণে চড় খেয়েও সবাই কেমন নির্বিকার। সবার তাকানো দেখে মনে হল, যেন পুলিশের চড় খাবার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে।

মাছি মেরেই চলেছেন এসআই মাবুদ মিয়া। সোৎসাহে সে দৃশ্য গিলছেন অন্যরা। গত রাতে মাবুদ মিয়ার হাত থেকে পালিয়ে গেছে জিন্দাবাজারের কুখ্যাত ডাকাত কানা সিরাজ। তাই ওসি রমজান আলী ডিউটি ক্লোজ করে মাছি মারতে দিয়েছেন। সারা দিনে এক হাজার একটা মাছি মারতে না পারলে এসআই মাবুদ মিয়াকে পুলিশ ফাঁড়িতে ক্লোজ করানোর হুমকি দিয়েছেন। তাই নাওয়া খাওয়া ভুলে মাছি মারায় ব্যস্ত মাবুদ মিয়া।

শোরগোল ছাপিয়ে হঠাৎ ওয়াকিটকির আওয়াজ জোরালো হয়ে উঠলো। সবাই কেমন যেন সন্ত্রস্ত্র।

-চার্লি ওয়ান, ওসি স্যার এইমাত্র গেট দিয়ে ঢুকলেন।

-ইকো ফাইভ ওভার।

ডিউটি অফিসারের সামনে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয়েছে আমাদের। কারও মুখে কোন রা নেই। ওসি রমজান আলী দুজন ফোর্স নিয়ে গটগট করে ঢুকলেন। হাঁটার গতিতে থলথলে ভুড়ি নেচে উঠছে। পুরু গোঁফ। প্রায় ছয়ফুট মত লম্বা মানুষটার চেহারা সাক্ষাত দৈত্যের মত। বাইরে থেকে দেখতে আসলেই ভয়ঙ্কর ওসি রমজান আলী। এসেই হুংকার।

-সব কটাকে লকাপে ঢুকাও। শালার পুতরা এত্তবড় সাহস, আমার এলাকায় পিক পকেটিং করস। একেকটার বাপের নাম ভুলায়া দেব আজ।

বলার দেরি নেই। ঘাড়ে ধরে লকআপে ঢোকানো হলো আমাদের। একশ ওয়াটের একটা ব্রিটিশ আমলের বাল্ব ঝুলছে মাথার ওপর। নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুম থেকে গা গুলানো গন্ধ। নোনা ধরা দেয়ালে আসামিদের নানা ধরনের শিল্পকর্ম! খানিক পরে মোটা একটা বেতের লাঠি নিয়ে লকআপ খুলে ঢুকলেন রমজান আলী। সাথে সেই দুই কনস্টেবল। লাইনে দাঁড় করানো হলো। ওসি সাহেব তার বয়ান শুরু করলেন।

-শোন ছোকরারা। চেহারা সুরত তো দেখি কারও খারাপ না। ভদ্র ঘরের সন্তান বইল্যাই মনে হইতাছে। তোমাগো সাইজ করনের আগে একটা গল্প বলি। আশা করি গল্পের মর্ম বুঝবা। গল্পটা হইল গিয়া। ওই ছোকরা তাকাস ক্যান।

ঠাস করে চড় কষিয়ে দিলেন আমার পাশেরজনকে। দেখে ভদ্রলোক বলেই মনে হয় লোকটাকে। চড় খেয়ে ফিচ করে কেঁদে দিলেন। বেতের লাঠি বেশ কৌশলে ঘুরিয়ে সামনে পায়চারি করছেন ওসি সাহেব।

-ওই বেডা, মাইয়া মাইনসের লাহান কানবি না। শোন একটা সত্যি গল্প কই। আমার বন্ধু আরব আলী। নেংটাকালের বন্ধু। আরব আলী যেই ডাল ধরে, হেই ডালই গোড়া সুদ্দা উপড়ায় পড়ে। তো আরব আলী একবার মুরগির ফারম করল। ছয়মাসের মাথায় হেই পুঁজিও যায় যায় অবস্থা। লস আর লস। শ্যাষে আমারে কইল রমজান, এই ব্যবসার বাত্তিও বুঝি নিভল। আমি তহন থাকি গফরগাঁও। মাত্র ওসি হইছি। দুই দিনের ছুটি নিয়া বাড়ি গেলাম। এই তোরা হুনতাছস না!

একজনের হাঁটুর নিচে সজোরে বেতের লাঠি চালালেন রমজান আলী। ও বাবারে বলে ক্যাঁকিয়ে উঠে লোকটা বসে পড়লো।

– মন দিয়া শুন। আরব আলীর খামারে গেলাম। ব্যারামে তখন অর্ধেক মুরগি ছাফা। মুরগি আছিল সাড়ে তিনশ। ছয় মাসে নাইম্যা গেছে অর্ধেকে। সন্ধ্যার পরে বাত্তি জ্বালায়া লাঠি হাতে নিয়া মুরগির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলাম। আরব আলীর খামারে বাঁইচা থাকতে চাইলে কাইল থেইক্যা সব কয়টা দুইটা কইরা ডিম দিবা। যে দিবো না। তার জন্য দরজায় ছুরি ঝুলানো থাকব। একটা ডিম পাড়বি তো, ভুরি ভোজ হোটেল এ- রেস্টুরেন্টে চালান হবি।

বিকৃত রকমের একটা হাসি হেসে উঠল লোকটা। পান চিবানো মুখ থেকে একদলা পান সুপারি ছুটে গিয়ে পড়ল মেঝেতে। তরমুজের বিচির মত কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে বুদ্বুদের মত লালা গড়িয়ে পড়ছে। লোকটা এত সহজ করে, এত হেসে খেলে গল্পটা বলছে, যেন কিছুই হয়নি, ক্লাসে অমনোযোগী ছাত্রদের গল্প শোনাচ্ছে। খানিকটা থেমেই শেষ মাথার হ্যাংলা মত লোকটার হাঁটু বরাবর লাঠি চালিয়ে আবার শুরু করলেন ওসি সাহেব।

-তার পরের কাহিনী শোন। পরদিন গিয়া দেখলাম সবাই দুইট্যা করে ডিম নিয়া বইস্যা আছে। মাঝখানে একটা মুখ লুকায়া রাখছে। কাহিনী কী! গিয়া দেখি একটা ডিম পাখনার নিচে লুকায়া রাখছে। মাথায় রক্ত উইঠ্যা গেল। চিল্লায়া কইলাম- আরব আলী ছুরি নিয়া আসো। মুরগি ঝাপায়া পড়ল পায়।

-আমারে মাইরেন না ওসি সাব।

-তো কী তোরে আদর করবো। সবাই দিল দুইটা ডিম। তুমি দিলা একটা। সাহস তো কম না।

-আমারে মাফ কইরা দেন ওসি সাব। আমি একটা দিছি এইডাই তো ভয়ে ভয়ে দিছি। আমি ডিম দিবো কেমনে, আমি তো মোরগ। আপনের ভয়ে তাও একটা পাইড়্যা ফেলছি।

-হাহাহাহাহাহা। শুনছস গল্প। বুঝসছ।

আবারো বিকৃত হাসিতে ফেটে পড়লেন দীর্ঘদেহী লোকটা।

-মোরগও ওসি রমজান আলীর ভয়ে ডিম দিছে। আর তোরা তো সব লাইনে নতুন পোলাপাইন। ঠ্যাং ভাঙার আগে স্বীকার কর।

-আমাদের মাফ করে দেন ওসি সাহেব। আমরা কিছু জানিনা।

আমার পাশের লোকটি এ কথা বলতেই উন্মত্ত ষাড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়লেন রমজান আলী। একচোট মেরে হুংকার দিয়ে বললেন।

-টাকা খোয়া গেছে একুশ হাজার। তোরা প্রত্যেকেই নিছস একুশ হাজার করে। প্রত্যেকেই ভালয় ভালয় স্বীকার যাবি। টাকা দিবি একুশ হাজার করে। তারপর ছাড়া পাবি। না হইলে নিশ্চিত চৌদ্দ শিক।

আমাদের কারও আকুতিতে মন গলার কোন লক্ষন নেই। সমানে সামনে যাকে পাচ্ছে বেধড়ক পিটিয়ে খিস্তি খেউড় আওড়ে যাচ্ছেন ওসি রমজান আলী। তার এক কথা, টাকা খোয়া গেছে একুশ হাজার। প্রত্যেকেই অপরাধী। প্রত্যেককেই একুশ হাজার করে টাকা দিলে তবেই মুক্তি।

শীতকাল বলে সন্ধ্যাও বুঝি ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। চারপাশে কেমন একটা গুমোট অন্ধকার নেমে এল ঝপাস করে। ফোন পকেটে নেই। বাসায় কোন খবর দিতে পারছি না। নতুন শহর। চেনা নেই, জানা নেই। দরজার ফাঁক দিয়ে প্ল্যাটফর্ম চোখে পড়ে খানিকটা। কয়েকটা নেড়ি কুকুর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। পাশেই একটা পিঠার দোকান। গরম ভাপা পিঠার ধোঁয়া উড়ছে। সারা দিনের জার্নি, তার ওপর এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ায় অস্বস্তি বাড়ছে ক্রমশ।

তীব্র শীতেও দরদর করে ঘামছি। মাথা ঘুরাচ্ছে। গা গুলাচ্ছে বিশ্রী রকমের। সেলিম আংকেলও হয়তো অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। আমি তো চিনিনা কিছুই। ঠিকানাও নেয়া হয়নি সেভাবে। রাত ঘনিয়ে আসলে কোথায় যাবো তারও কোন ঠিকানা নেই। আর ওসির ভাবভঙ্গিতে সহসা এখান থেকে মুক্তির আশা ভেতর থেকে নিবু নিবু হয়ে আসছে ক্রমশ। কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। টেনশন আর সারা দিনের ধকলে ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। প্ল্যাটফর্মে মিটি মিটি বাতি জ্বলছে একটা দুটো। লোকজনও কমতে শুরু করেছে। এলোমেলো ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভিতর। হঠাৎ নিজের নামটা গারদের ওপাশ থেকে শুনে চমকে উঠলাম।

-এই তুমি সাগর না?

-জ্বি। আমি সাগর।

-আমি সেলিম। তোমার বাবা, শামসুদ্দিন হায়দার আমার বাল্যবন্ধু।

-জ্বি আঙ্কেল। স্লামালিকুম।

হঠাৎ একজন আগন্তুকের গলায় থতমত খেলেন ওসি রমজান আলী।

-জ্বি, স্লামালেকুম। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।

-ওয়ালেকুম সালাম। ওসি সাহেব, আমাকে না চেনারই কথা। কখনো আপনার সঙ্গে কথা হয়নি। এসপি রহমান শেখ আমার ঘনিষ্ট। আমি আলাউদ্দিন টি স্টেটের জেনারেল ম্যানেজার।

-আরে ভাই আপনি। আরে আগে বলবেন না।

-ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ওসি সাহেব। ধমকাতে লাগলেন দুই কনস্টেবলকে।

-হাদার দল। ম্যানেজার সাহেবকে বসতে দে। চা দে।

-জ্বি না, ধন্যবাদ। চা খাবনা। আপনার দাওয়াত রইল চা বাগানে।

-জ্বি জ্বি ভাই আপনার মেহেরবানি। এমপি সাহেব বড় ভাল মানুষ। আপনি ওনার চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার। মানে খুব কাছের মানুষ। আর এদিক দিয়ে এসপি স্যার।

-এসপির নাম উচ্চারণ করেই দড়াম করে শূন্যে স্যালুট মারলেন বিশালদেহী রমজান আলী।

-তা সেলিম সাহেব, আপনার কী খেদমদ করতে পারি বলেন তো।

-জ্বি, ওই যে লাল সোয়েটার। ওর নাম সাগর। আমার ভাতিজা। ভুল করে সম্ভবত ধরে এনেছেন।

আমার মুখের দিকে তাকিয়েই জিভে কামড় দিলেন ওসি। যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। আমার সঙ্গে যে আরও পাঁচজন রয়েছে তাও ভুলে গেলেন। আবার চড়াও হলেন সেই দুই কনস্টেবল এর উপর।

-হারামজাদার দল। শুয়োরের দল। কামের কাম কিছুই করতে পারস না। যত্ত সব আকামের ধাড়ি। বড় বড় চোর ডাকাত ফসকাইয়া যাইতেছে চক্ষের সামনে দিয়া। আর তোরা কি না এই ভদ্রলোকের ঘরের ছেলেরে ধইরা নিয়া আসছস। ছি। ছি। আমার তিরিশ বছরের চাকরী জীবনের সব সুনাম বরবাদ হয়া গেল। ছাড় জলদি ওনারে।

খুব আদবের সাথে আমার কাঁধে হাত রাখলেন রমজান আলী।

-সরি বাবাজি। কিছু মনে করবেন না। ভুল তো মানুষেরই হয়। ভুল না হইলে আমরা আর মানুষ হইলাম কেমনে বলেন। মেশকাত শরীফে বলা আছে…. কী যেন…

থামিয়ে দিলেন সেলিম আঙ্কেল। ওসিকে একটা ধন্যবাদ নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ছুটলেন থানার দরজার দিকে। আমার কাঁধে ভারী ব্যাগ। আঙ্কেলও হাত লাগালেন। বাইরে যখন বেরুলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিজলী বাতি জ্বলছে এখানে সেখানে। মিটমিট করে জ্বলছে কুয়াশায় ঢাকা বাতিগুলো। প্ল্যাটফর্মের ইতিউতি জড়োসড় হয়ে কাঁথা গায়ে বসে আছে ভাসমান মানুষজন। চায়ের দোকানে দু’চারজন মানুষের জটলা। স্টেশনের গেটেই লাগানো ছিল আলাউদ্দিন টি স্টেটের হুড খোলা জিপ গাড়ি। ড্রাইভার নন্দলাল সাহেবী কায়দায় সালাম করে এক ঝটকায় গাড়ির পেছনে ছুড়ে ফেলে দিল আমার জিনিসপত্র। সেলিম আঙ্কেল সামনে বসলেন। আমি খোলা জিপের পেছনটায়।

শহর ছাড়িয়ে আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে জিপ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগামী যানবাহন। মূল সড়ক পেরিয়ে সরু রাস্তায় চলতে শুরু করল একসময়। হেডলাইটের আলোয় ছবির মত সুন্দর সারি সারি চা বাগান। এবড়ো খেবড়ো পথ। কুয়াশা ঘেরা আকাশে তারারা নির্বাসনে। সময় যত গড়াচ্ছে, বাড়ছে শীতের তীব্রতা। চাঁদহীন আকাশটা এই পরিবেশে বড্ড বেমানান। পুরো পথ জুড়ে কারও মুখে কোন কথা নেই। গাড়িতে মৃদু সুরে বাজছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। কোথাও কোন আলো নেই, শব্দ নেই। জনমানবহীন প্রান্তরে যেন ভাগ্যের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছি আমরা তিনটি মানুষ। এই চলার শেষ কোথায় কে জানে।

বাবা মার কথা খুব মনে পড়ছে। আসার পর এই বিপত্তির খবর পৌঁছেনি হয়ত। রাত এখন কটা বাজে? আটটা কী নয়টা। হাতের ক্যাসিও ঘড়িটার রেডিয়াম ডায়াল অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না। একটা অদ্ভুত ভাললাগা-খারাপ লাগার মিশেলে মোহনীয় এই যাত্রাপথ যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। চলুক না এভাবে জীবনটা। কোন ক্ষেদ নেই, এর চেয়ে বেশি চাওয়া নেই, পাবার স্বপ্ন নেই।

ঘন্টা দুয়েক চলার পর একটা বড় লোহার গেট পেরিয়ে প্যাঁচানো রাস্তায় খানিকটা ওপরে উঠে থেমে গেল জিপটা। আবারো লাফিয়ে নামল নন্দলাল। আরো দুজন উর্দি পরা যুবক ছুটে এল। গুরুগম্ভীর সেলিম আঙ্কেল হ্যান্ডসেক করলেন নেমেওরা তোমাকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দেবে। খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। তুমি রেস্ট নাও। কাল কথা হবে।

কথাগুলো বলেই হেঁটে বাংলোর দিকে চলে গেলেন তিনি। আমি অনুসরণ করলাম ওই দুই যুবকের দেখানো পথ। বাংলোর পেছন দিকটায় কয়েকটা ছিমছাম ঘর। কুয়াশা ঘেরা বাতিগুলোর আশপাশে অদ্ভুত এক ধোঁয়াশা। সেই ধোঁয়াশার ভেতর দিয়ে এগিয়ে খানিকটা পরেই পুরনো আমলের একটা দরজা। ওখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা।

ঘর খুলেই সব বুঝিয়ে দিল লোক দুটো। ঘরের সাথেই এটাস্ট বাথরুম। বেশ পরিপাটি। একটা মাঝারি খাট। চেয়ার। টেবিল। আলনা। একটা পুরনো আলমিরা। টেবিলে সুন্দর করে ঢেকে রাখা খাবার। থাকার জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা। দুজন বিদায় নিল। সারা দিনের ধকল শেষে কনকনে ঠা-া পানিতে কাঁপতে কাঁপতে একটা চটজলদি গোসল সেরে খাওয়া। তারপর সোজা বিছানায়। যে কোন সময় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবো, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

(চলবে)

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement