মেলা হলো মানুষের এক আনন্দ সম্মিলন। আর পৌষমেলা হলো শীতে হাজার বছরের বাঙালির ভূমি থেকে উৎসারিত নবান্ন উৎসবের একটি সম্প্রসারিত সর্বজন নন্দিত রূপ। ভাবের বাহন যেমন ভাষা, তেমনি একটি জাতির পরিচয় বহন করে তার সংস্কৃতি।
বাঙালির বাঙালি হিসেবে পরিচয়ের এক অনুপম উপদান হলো বাঙালি সংস্কৃতি। তা অন্যসব জাতির সংস্কৃতি থেকে বাঙালিকে এক অনন্য অসাধারণ রূপ দান করেছে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারাবছরই লেগে থাকে নানা উৎসব, পালা-পার্বণ।
বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষ কেন্দ্র করে বাঙালির উৎসবগুলো আয়োজিত হয়। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব পালন করা হয়। সব ঋতুর মধ্যে শীতকালের উৎসবগুলো ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। শীতকালে পৌষ কেন্দ্র করে আয়োজিত বাঙালির প্রাণের উৎসব হলো পৌষমেলা। তা সময়ের হাত ধরে ঐতিহ্য পরম্পরায় চলে আসছে।
এ মেলার এক বর্ণিল ইতিহাস রয়েছে। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ মেলা শুরু হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত একটি বার্ষিক উৎসব।
সেখানে প্রতিবছর ৭ পৌষ এই মেলা শুরু হয়ে তিন দিন ধরে চলে। ইতিহাস গতভাবে শান্তিনিকেতনের এই মেলার রূপকার ও প্রকৃত স্রষ্টা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছা অনুযায়ী যে স্থানে এই মেলা অনুষ্ঠিত হতো, প্রতিবছর তার একটি স্থানীয় নাম ‘ভুবনডাঙ্গার মেলা’।
এই মেলায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্র ঐতিহ্য ও ভাবনা অনুসরণ করেই শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা চলেছে বহু বছর ধরে। এই বাংলার বিভিন্ন স্থানে পৌষমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও গ্রামের লতাপাতা নামক স্থানের আফজালুন্নেছা সিকদার সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাঠে নিয়মিত পৌষমেলার আয়োজন করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য যান্ত্রিক জীবনের বাইরে প্রকৃতির কোলে একটু শান্তির সুবাতাস উপভোগ করার প্রয়াসে।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অনুষঙ্গগুলো যেন দিন দিনই হারিয়ে যাচ্ছে। আবহমান বাংলার হাজার বছরের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উৎসব পৌষমেলা ও নবান্ন উৎসব।
অতিপ্রাপ্তির বিবেকহীন চাওয়া মানুষকে বেপরোয়া, অশান্ত ও অসুখী করে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা অনেক উন্নতি করেছি সন্দেহ নেই, হারিয়েছিও কম নয়।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়- বর্তমানে আমরা এতটাই যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছি যে, অতিকষ্টেও প্রাণখুলে কাঁদতে পারি না; সুখে মনখুলে হাসতেও পারি না। উন্নতির অসম-অমানবিক প্রতিযোগিতায় নিজের অজান্তেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি।
অথচ বুঝতেই পারি না। আমরা সবাই ধনী হতে চাই, কেউ সুখী হতে চাই না। সুখী মানুষই প্রকৃত ধনী। জাপান বা সুইজারল্যান্ডের মানুষ জীবনকে উপভোগ করার জন্য বাঁচে, অর্থ উপার্জনের জন্য নয়।
একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, আমরা সম্পদ আহরণের লাগামহীন প্রতিযোগিতায় নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছি। ধনী হওয়ার অমানবিক ও অযৌক্তিক চেষ্টার কারণে অনেকেই বিভিন্ন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যহানির শিকার হন। তা অর্থের বিনিময়ে কখনই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী প্রয়াত স্টিভ জবস বলেন, ‘লক্ষ কোটি টাকার বিনিময়েও মৃত্যুশয্যার পরিবর্তে সুস্থশয্যা কেনা যায় না।’ মানবজীবন একটাই। অর্থের পেছনে ঘুরে এ জীবনকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না। আসুন, আমরা ধনী হওয়ার অসৎ অমানবিক চেষ্টা ছেড়ে সুখী হওয়ার সৎ মানবিক পথে কাজ করি। এ জন্য দরকার আমাদের শিকড়ের সন্ধান ও সংস্কৃতির সুষ্ঠু ধারাকে পুনর্জীবিত করে এর চর্চা এবং নিরন্তর সযত্ন লালনের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
‘পৌষ মোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয় আয় আয়,
ডালা যে আজ ভরেছে দ্যাখ পাকা ফসলে মরি হায় হায় হায়।’
কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর পৌষ ঘিরে উৎসবের রঙ লাগে ঘরে ঘরে। বাংলা কৃষ্টির অকৃত্রিম এই সৃষ্টি বাঙালির আপন ভুবনকে যেমন করে তুলেছে উৎসবের রঙে রঙিন, তেমনিভাবে বাঙালির ঐতিহ্যকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। আধুনিক রুটিনমাফিক যান্ত্রিক জীবনে শীতের রুক্ষ-শুষ্ক-মলিনতার মধ্যে পৌষমেলা যেন এক শুদ্ধ উষ্ণ আবেশ।
বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সর্বজনীন উৎসব পৌষমেলা। পৌষে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌষমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে গ্রামবাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতিকে সাধারণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পাওয়া যায়। এই মেলা আমাদের যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু বিরতি নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই উৎসবের বিভিন্ন আয়োজনে বাঙালির বাঙালিয়ানার বিভিন্ন উপাদানের সমারহ থাকে। এই মেলায় পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, লাঠিখেলা, পিঠা উৎসব, মঞ্চনাটক, পালাগান, কবিগান, সাপখেলা, নাগরদোলা, গৃহে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রিসহ নানা রকম আয়োজন থাকে।
আধুনিককালে ইলেকট্রনিক দুনিয়ায় মগ্ন নতুন প্রজন্মের কাছে পৌষমেলা কেবল এক প্রাণের মেলাই নয়, এ যেন শিকড়ের সন্ধানে ফিরে যাওয়া চিরায়ত বাংলার কোলে; বহুকাল ধরে চলমান শীতকালীন গ্রামীণ বাঙালি ঐতিহ্যকে এ প্রজন্মের দুই কামরায় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরের আত্মার কাছাকাছি আনার দুরন্ত এক আয়োজন। এই আয়োজন সংস্কৃতির ধারায় বাঙালিয়ানাকে ধারণ করে বয়ে নিয়ে চলছে অনন্ত এক অনন্দের উৎস সন্ধানে। এই সংস্কৃতিচর্চা বাঙালির পরিচয়কে আরও সমৃদ্ধ করে চলেছে নিরন্তর।
পৌষমেলার আয়োজন ও তার আবহমানকালের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে সৎ, মানবিক, বিবেকবান সমাজ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সুকুমার চর্চাগুলোকে আমাদের সযত্ন লালন করতে হবে। পৌষমেলা সব বাঙালির মেলা। আসুন, আমরা পৌষমেলায় মিলিত হই।