প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসায় যখন প্রতারণা মুখ্য, মা-বাবার প্রতি ছেলে-মেয়ের ভালোবাসায় যখন স্বার্থের গন্ধ, বন্ধুর ভালোবাসায় যখন ধর্ষণের আতঙ্ক, চারদিকে যখন স্বার্থের লড়াই, সেসময়ে কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা প্রকৃত ভালোবাসার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এমনই এক ব্যতিক্রম ভালোবাসা দেখিয়েছেন রাজশাহী নগর পুলিশের শাকমখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার।
করোনা মহামারির এক চরম সংকটকাল পেছনে ফেলে এসেছে রাজশাহীবাসী। লকডাউনের দিনগুলোতে ঘরবন্দি থাকায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খেয়ে না-খেয়ে পার করেছে দিন। এ সময় কেবল মানুষ নয়, চরম বিপর্যয়ে পড়েছে প্রাণিকুলও। চারপাশের দোকানপাঠ, হোটেল রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় অভুক্ত থেকেছে বেওয়ারিশ কুকুর। অবশ্য কিছু প্রাণিপ্রেমী মানুষও তখন এগিয়ে এসেছেন তাদের খাওয়াতে। তাদের একজন সাইফুল ইসলাম সরকার। রাজশাহী নগর পুলিশের শাকমখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন তিনি। এখন বদলি হয়েছেন দিনাজপুরে।
১ নভেম্বর, সোমবার পরিবার নিয়ে তিনি রাজশাহী ছেড়ে যান। যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, পথ আগলে দাঁড়ায় একদল কুকুর। যে কুকুরগুলোকে কঠিন সময়ে খাবার দিয়ে আগলে রেখেছিলেন ওসি, সেই কুকুরগুলো বুঝতে ভুল করেনি যে তাদের প্রতি মানবিক হওয়া মানুষটি হয়তো চলে যাচ্ছে।
রাজশাহী ছেড়ে যাওয়ার আগে ওসি সাইফুল ফেসবুকে একটি হৃদয় নিংড়ানো স্ট্যাটাস লেখেন। সেখানে তিনি এই কুকুরগুলো দেখে রাখারও আকুতি জানিয়েছেন সবার কাছে। তিনি লেখেন— ‘করোনাকালে থানার ভিতরে বসবাস করা ১০টি কুকুরের শরীর আর চোখমুখের দিকে চেয়ে আমার বুকটা কেঁদে উঠত। খাদ্যের অভাবে ওরা প্রায় মরতে বসেছিল।
আমি ও আমার মেয়ে বাসা থেকে বের হওয়ামাত্র অবলা, নিরীহ কুকুরগুলো আমাদের ঘিরে ধরত। আমরা ওদের ভাত, পাউরুটি খাইয়ে জানে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। কুকুর বিশ্বাসঘাতক হয় না, নিমকহারাম হয় না। এখনো আমার মেয়ে ও আমাকে দেখে কুকুরগুলো শরীর ঘেঁষে এসে বসে, খেলা করে, কিছু একটা বলতে চায়।’
তিনি যোগ করেন, ‘আজ ১ নভেম্বর। ঠিক ১৭ বছর আগে এই দিনে আমি পুলিশ হিসেবে খাতায় নাম লিখেছিলাম। আজ আমি সপরিবারে দিনাজপুরের উদ্দেশে রাজশাহী ছেড়ে যাচ্ছি। রেলস্টেশনে যাবারকালে কুকুরগুলো আমাদের পিছু নিয়েছিল।
ওরা কি বুঝতে পেরেছিল যে আমরা ওদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছি? আর তাদের সাথে দেখা হবে না, তাদের প্রিয় শখপাখির সাথে আর কোনো দিন খেলা হবে না। ওদের চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ।’
ওসি লেখেন, ‘কুকুরগুলোর কথা ভেবেই খারাপ লাগছে। আর শাহমখদুম থানার জনগণ যারা তাদের হৃদয় নিংড়ে আমাদের ভালোবাসেন, তাদের ছেড়ে যেতে কেমন লাগছে, সেটা বলাই বাহুল্য। কথা দিচ্ছি, যদি কখনো সুযোগ হয়, সাধ্যে কুলায়, স্থায়ী নিবাস গড়ে শাহমখদুম থানাবাসীকে প্রতিবেশী বানিয়ে আমৃত্যু তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হব।’
শাহমখদুম থানা চত্বেরে ৩০০ ফলদ গাছের চারাও রোপণ করেছিলেন সাইফুল ইসলাম। গাছগুলো বেড়ে উঠছিল তার পরম যত্নে। বিদায়বেলায় এই গাছগুলোর যত্ন নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তাই গাছগুলো নিয়েও তার হৃদয় ব্যথিত হয়, ‘যদি কোনো ভুল করে থাকি, কোনো একদিন আমার লাগানো ফলদ বৃক্ষগুলোর ফল গ্রহণের বিনিময়ে হলেও তোমরা আমায় ক্ষমা করে দিও হে শাহমখদুম থানাবাসী।’
চাকরিজীবনে রাজশাহীতে মানবিক ওসি হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাইফুল ইসলাম সরকার। করোনা সংক্রমণের সময় মানুষের দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ত্রাণ সংগ্রহ করে, নিজেদের রেশনসামগ্রী ও নগদ টাকা দিয়ে দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দায়িত্ব পালনেও ছিলেন সদাতৎপর। শাহমখদুম থানায় দুই বছর ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সে বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি, ‘কত তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, যা বলে শেষ করা যাবে না। তবে জ্ঞানত আমি কারো প্রতি অন্যায় করেছি, কাউকে হয়রানি করেছি, কাউকে সেবাবঞ্চিত করেছি, অনৈতিক সুবিধা দাবি করেছি; এমন অভিযোগ শাহমখদুম থানার মানুষদের জিজ্ঞেস করে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। অজান্তে, চাকরির বাধ্যবাধকতার খাতিরে যদি ভুল করে থাকি বা কারও মনে ব্যথা দিয়ে থাকি, সকলের কাছে আজ এই বিদায়বেলায় ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি আবেগী টাইপের লোক। প্রথমবার বগুড়ার দুঁপচাচিয়া থানা হতে যখন পোস্টিং হয়, তখন হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। আবার পূর্ব তিমুর মিশন হতে দেশে ফেরার সময় ওই দেশের শিশুদের বিদায় দেওয়ায় সময় চোখের জলে ধরে রাখতে পারিনি।’
চাকরি জীবনে কয়েক শ লাশের তদন্তের সাথে যুক্ত থাকায় কলিজাটা পুষ্টি হয়ে গেছে। পোস্টিংয়ের খবর শুনে একটু খারাপ লাগলেও এখন তেমন একটা বিচলিত হই না। ভাবি এটাই পুলিশ জীবন। এটা মেনে নিয়েই পুলিশে ভর্তি হয়েছি। নতুন কর্মস্থল, নতুন পরিবেশ, নতুন অভিজ্ঞতা; খারাপ কী।