২৬ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

অভিশপ্ত হীরা ‘কোহিনূর’ এর আশ্চর্য তথ্য!

Advertisement

কোহিনূর হীরা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস। ভারতের এই বহুমূল্য রত্ন বর্তমানে ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারে শোভা বৃদ্ধির কাজ করছে। পৃথিবীতে কোহিনূরের থেকেও অনেক দামী এবং বড় হীরা আছে। তবে সেগুলো নিয়ে মানুষের মনে অতটা কৌতূহল নেই। যতটা কোহিনূর হীরা নিয়ে আছে। আর সেসবের কারণ হলো একটাই, সেটা হলো এই কোহিনূর হীরা অভিশপ্ত।

এই হীরা আজ পর্যন্ত যার কাছে গেছে, তার জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। তার জীবনে কালো ছায়া নেমে এসেছে। এর থেকে বাদ যায়নি মুঘল সম্রাট শাহজাহান। এমনকি এই হীরার অভিশাপে বড় বড় সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এই কোহিনূর হীরা আজ পর্যন্ত কোথাও বিক্রি হয়নি বা কোনো নিলামে উঠেনি। প্রতিবারই কোনো যুদ্ধ অথবা কোনো ছলনার মাধ্যমে এই হীরা হাতবদল হয়েছে।

এই অভিশপ্ত হীরাটি ভারতের একটি খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ক্রমাগত হাতবদল হয়ে বর্তমানে এই হীরাটি পৌঁছে গেছে ইংল্যান্ডে। ভারত এবং পাকিস্তান এই দুইটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্রমাগত এই দুইটি দেশ ইংল্যান্ড সরকারকে চাপ দিচ্ছে কোহিনূর ফেরত দেয়ার জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই কোহিনূর কি ভারতে ফেরত আনা সম্ভব? কোহিনূরের বর্তমান মালিক কীভাবে এর অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলেন? কীভাবে এটি ভারত থেকে ইংল্যান্ডে গেল? আর কেনই বা এই হীরাটিকে অভিশপ্ত হীরা বলা হয়?কোহিনুরকে কেন অভিশপ্ত হীরা

ভারতবর্ষের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের গোলকুণ্ডা খনি থেকে এই বহুমূল্য হীরাটি পাওয়া গেছে। এর সবচেয়ে পুরনো উল্লেখ পাওয়া যায় পাঁচ হাজার বছর পুরনো একটি সংস্কৃত লেখায়। যেখানে এটিকে ‘সামন্তিকা হীরা’ নাম দেয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা, এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছিল এবং পুরান মতে, এটি হলো ভগবান সূর্যের দেয়া একটি উপহার। এরপর প্রায় চার হাজার বছর এই হীরার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।

১৩০৮ সালে এটি আবার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। সেই সময় এটি মালওয়ার রাজার সম্পত্তি ছিল। এরপর আবার ২০০ বছর এটির উল্লেখ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। তবে এর উল্লেখ আবার পাওয়া যায় বাবরনামাতে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধের সময় গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিৎ সিং, তার সমস্ত সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য আগ্রার কেল্লায় রেখেছিলেন। যার মধ্যে বহুমূল্য রত্ন কোহিনূর হীরাটিকেও রেখেছিলেন।

যুদ্ধে জিতে বাবর এই হীরাটিকে নিয়ে নেন। সেই সময় এই হীরার চমক দেখে এবং এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট বাবর। তখন তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘বাবর হীরা’। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৩০০ বছর এই হীরা মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পত্তি ছিল। কিন্তু ১৭৩৮ সালের দিকে ইরানের শাসক নাদের শাহ মুঘল সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ করে।কোহিনুরকে কেন অভিশপ্ত হীরা

এর এক বছর পর ১৭৩৯ সালে তিনি মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে হারিয়ে তাকে বন্দি করেন এবং মুঘল রাজসম্পত্তি লুট করেন। যার মধ্যে বাবর হীরা অর্থাৎ কোহিনূরও ছিল। বলা হয়, তিনি মোহাম্মদ শাহের সঙ্গে নিজের রাজমুকুট বদলানোর সময় ছলনার মাধ্যমে এই হীরা নিজের কবজায় করে ফেলেছিলেন। এই ইরানি শাসক যিনি দিল্লিতে লুট করেছিলেন তিনি এই হীরার নাম রেখেছিলেন ‘কোহিনূর হীরা’।

দিল্লিতে লুট চালিয়ে তিনি এই হীরা নিয়ে চলে যান ইরানে। এরপর সেখান থেকে হাতবদল হয়ে এই হীরা পৌঁছে যায় নাদের শাহের নাতি শাহরুখ মির্জার হাতে। সেখান থেকে এই হীরা পৌঁছায় নাদের শাহের সেনাপতি আহমেদ আব্দালির কাছে। আহমেদ আব্দালি পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন এবং কোহিনূর হীরা তার বংশের কাছেই থেকে যায়।

কিন্তু যখন তার বংশধর সুলতান শাহ সুজা এই হীরা লাহোরে নিয়ে যান, তখন এই খবর পৌঁছে যায় শিখ সাম্রাজ্যের রাজা রঞ্জিত সিংয়ের কাছে। এরপর ১৮৩৯ সালে সুলতান শাহ সুজাকে হারিয়ে এই হীরা নিজের কবজায় করে ফেলেন মহারাজা রঞ্জিত সিং। মহারাজা রঞ্জিত সিং এই হীরাকে নিজের মুকুটে ব্যবহার করেন। তবে তার মৃত্যুর পর কোহিনূর হীরা চলে আসে তার ছেলে দিলীপ সিংয়ের কাছে। তবে ততদিনে ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন শুরু হয়ে গেছিল।

১৮৪৯ সালে মহারাজা দিলীপ সিংয়ের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় দিলীপ সিং ও তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির সঙ্গে লাহোর সন্ধি হয় এবং সেই সন্ধি মতে বলা হয়, দিলীপ সিংয়ের কাছে থাকা কোহিনূর হীরা ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়াকে দেয়া হবে। এরপর ১৮৫০ সালে লর্ড ডালহৌসি এই বহুমূল্য হীরাটিকে লাহোর থেকে মুম্বাইতে নিয়ে আসেন এবং সেখান থেকে লন্ডনে পাঠানো হয়।

এরপর ১৩ জুলাই ১৮৫০ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সামনে এই হীরাটিকে রাখা হয়। তখন মহারানী ভিক্টোরিয়া সেটিকে পুনরায় কাটিং করার নির্দেশ দেন। এরপর এটি মহারানীর মুকুটে ব্যবহার করা হয়। আর এভাবে কোহিনূর হীরা হয়ে যায় ইংল্যান্ড রাজপরিবারের সম্পত্তি।

কোহিনূর হীরা অভিশপ্ত কেন?
যদি এমনটা মেনে নেয়া হয় এই কোহিনূর হীরা, যা সামন্তিকা হীরা নামে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছিল। তাহলে মহাভারতে বলা হয়েছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বংশ অর্থাৎ যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ একটি তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। যদিও এই দুইটি ঘটনার পিছনে অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে।

১৩০৪ সালে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি এই কোহিনূর হীরার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এই হীরা যে ব্যক্তির কাছে থাকবে, সে হবে এই পৃথিবীর রাজা। তবে তার জীবনে নেমে আসবে অভিশাপ। কিন্তু তখন এই কথায় কেউ বিশ্বাস করেনি। তবে যখন এই হীরা কাকাতিও বংশে ছিল তখন সে বংশ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। সেই সময় ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কাকাতিও রাজা প্রতাপ রুদ্রের কাছ থেকে এই হীরাটি নিয়ে নেন। তখন যুদ্ধে কাকাতিও সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এরপর বেশ কিছু বছর পরে এই হীরা মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের হাতে আসে। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই হুমায়ুনের খারাপ দিন শুরু হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই শেরশাহ দিল্লিতে আক্রমণ করেন এবং দিল্লি জয় করে ফেলেন। হুমায়ুন পরবর্তীকালে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান। যখন শেরশাহের কাছে কোহিনূর হীরা এসেছিল, তিনি একটি যুদ্ধে খুবই নির্মমভাবে মারা যান।

আর এই হীরা মোহর বংশে অভিশাপ ডেকে এনেছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, ছেলের সঙ্গে বাবার সংঘাত, সিংহাসনের জন্য লড়াই, এই সব মোহর বংশে সাধারণ বিষয় হয়ে পড়েছিল। সম্রাট শাহজাহান তার ময়ূর সিংহাসনে এই বহুমূল্য হীরাটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে এরপর থেকে তার খারাপ সময় শুরু হয়ে যায়। নিজের ছেলের হাতে তিনি বন্দি হন এবং বন্দি অবস্থায় তিনি মারা যান। ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায়।

এই হীরা যখন নাদের শাহ লুট করেন, তার কিছুদিন পর তার অনুগামীরা তাকে হত্যা করেছিলেন। এরপর কোহিনূর হীরা পৌঁছে যায় আফগানিস্তানে। সেখানে কোহিনূর হীরার মালিক শুজা শাহকে হারিয়ে মহারাজা রঞ্জিত সিং কোহিনূরকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু এর ঠিক এক বছরের মধ্যেই মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যু হয়। তারপর তার ছেলে দিলীপ সিং এই হীরার মালিক হন। কিন্তু ব্রিটিশদের আক্রমণে তিনি তার সাম্রাজ্য হারান এবং এই হীরা লন্ডনের রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে চলে যায়।

এই কোহিনূর হীরা কি লন্ডন থেকে ভারতবর্ষে ফেরত আনা সম্ভব?

স্বাধীনতার পর থেকে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বহুবার এই হীরাটির উপর নিজেদের মালিকানা দাবি করেছে। তবে প্রতিবারই ব্রিটিশ সরকার দিলীপ সিংয়ের সঙ্গে হওয়া লাহোর সন্ধির উল্লেখ করেছেন, যেখানে তৎকালীন কোহিনূরের মালিক দিলীপ সিং এই হীরা ব্রিটিশ সরকারকে দেওয়ার শর্তে স্বাক্ষর করেছিলেন। তাই প্রতিবারই কোনো দেশ যখন এই হীরাটিকে দাবি করেন, ব্রিটিশ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়।

কিন্তু সেই হিসেবে দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকাররা সেই সময় ছলনার মাধ্যমে এই হীরাটিকে নিয়েছিল। কোহিনূর হীরা হলো ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের সম্পত্তি। আর রানী এলিজাবেথ হলো ইংল্যান্ডের সংবিধানের উপরে। তাই ইংল্যান্ড সরকার চাইলেও কোনো আইন পাস করে বা অন্য কোন উপায়ে এই কোহিনূর হীরা কাউকে দিতে পারবে না, যতক্ষণ না রানী নিজে এই বিষয়ে সম্মতি দিচ্ছেন।

কোহিনূর হীরা কি সত্যিই অভিশপ্ত?

কোহিনূর হীরা যদি অভিশপ্ত হয়, তাহলে রানী এলিজাবেথ বা রানী ভিক্টোরিয়া কেন এই অভিশাপের আওতায় এলেন না? কোহিনূর যে একটি অভিশপ্ত হীরা, এটি একটি লোককথা। ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন কোনো নথি পাওয়া যায়নি যেখানে এই হীরাটিকে অভিশপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই হীরার প্রত্যেকটি মালিকদের সঙ্গে হওয়া ঘটনাগুলোর উপর ভিত্তি করে হীরাটিকে অভিশপ্ত বলা হয়।

রানী ভিক্টোরিয়া এই কোহিনূর হীরাকে নিজের সম্পত্তি বানানোর পর ঘোষণা করেন, ইংল্যান্ডে কোনো রাজা এই হীরা ব্যবহার করতে পারবে না। শুধুমাত্র রাজার স্ত্রী বা কোনো নারী এই হীরা ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ কোহিনূরের অভিশাপ শুধুমাত্র পুরুষ মালিকদের মধ্যেই কাজ করে। সেই মতে, ইংল্যান্ডে যখন কোনো পুরুষ শাসক এসেছিলেন, তারা কখনো এই হীরাটিকে ব্যবহার করেননি।

কোহিনূর হীরার বর্তমান মূল্য কত?

কোহিনূর হীরা আসল মূল্য ঠিক কত তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। কারণ এটিকে কেউ কখনো কেনেনি। প্রতিবারই যুদ্ধ বা কোনো ছলনার মাধ্যমে এই হীরা জয় করা হয়েছে। তাও এটির ঐতিহাসিক এবং এর আকারের ভিত্তিতে কোহিনূর হীরার দাম হতে পারে আনুমানিক প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

কোহিনূরের বিষয়ে কিছু আশ্চর্য তথ্য-

> এই হীরাটি পাঁচ হাজার বছরে বহুবার হাতবদল হয়েছে এবং এর মালিকেরা এটির আকারের অনেক পরিবর্তন করেছেন।

> এই হীরাটি যখন খনি থেকে তোলা হয়েছিল তখন এর ওজন ছিল আনুমানিক প্রায় ৮০০ ক্যারেট বা প্রায় ১৬০ গ্রাম।

> বর্তমানে এটির ওজন ১০৫ ক্যারেট বা ২১ গ্রাম।

> এটির বর্তমান মালিক হলেন ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ।

> ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের জুয়েলারি, যার বর্তমান মূল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই জুয়েলারির মধ্যে বহু মূল্যবান কোহিনূর হীরাও আছে। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বেশিরভাগ সম্পত্তি হলো অন্য কোনো দেশ থেকে আনা।

> কোহিনূরের আকারে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি এর নামেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

> হীরাটির বর্তমান নাম হলো কোহিনূর, যা ইরানের সুলতান নাদের শাহ দিয়েছিলেন।

> কোহিনূর শব্দের অর্থ অপূর্ব আলোর ঝলকানি বা আলোর পাহাড়।

> বলা হয়, এই হীরা যার কাছে থাকে সে হয়ে যায় সারা পৃথিবীর রাজা। তবে এর মালিকের জীবনে নেমে আসে এক অভিশাপ।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement