২৬ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

চামড়া খাতে খেলাপি ঋণের পরিমান ১৫০০ কোটি টাকা

Advertisement

• নানামুখী সমস্যায় সংকটের মুখে চামড়া শিল্প
• চামড়া ক্রয়ে ঋণ দেওয়া হবে ২৪৫ কোটি টাকা
• অর্থের চেয়ে বেশি প্রয়োজন নীতিসহায়তা

প্রতি বছরই কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে দেওয়া হয় সহজ শর্তে ঋণ। কিন্তু তা আদায় হয় না। এছাড়া চামড়া খাতে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন সময় বিশেষ সুবিধাও দেয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের অর্থ নিজের মনে করে খেয়ে ফেলা হয়। ফেরত দেওয়ার কথা মাথায় থাকে না। ফলে এ খাতে মন্দ ঋণের হার ১০ শতাংশের ওপরে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে চামড়া খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর প্রান্তিকে এ হার ছিল ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৮৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

চলতি বছরের মার্চ শেষে চামড়া খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর প্রান্তিকে এ হার ছিল ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৮৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তর করে মালিকরা আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়েছেন। এরপর করোনাসহ নানামুখী সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত সংকট কাটেনি। সাভারে কারখানা প্রস্তুত করতে নগদ অর্থ যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। এখন কাজ করার মূলধন নেই। করোনার কারণে ব্যবসাও খারাপ। সময় মতো ঋণের অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে ঋণখেলাপি হচ্ছেন অনেকে।

‘সাভারে জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়ায় নতুন ঋণও নিতে পারছেন না মালিকরা। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে’— উল্লেখ করে শাহীন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা জমির মালিকানা সমস্যার সমাধানসহ সরকারের নীতিসহায়তা চাই। যদি নীতিসহায়তা দেওয়া হয় তাহলে নতুন করে চামড়া খাত ঘুরে দাঁড়াবে, পাশাপাশি নতুন ঋণ নেওয়া সহজ হবে। খেলাপি ঋণও কমে আসবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত চামড়া খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। তাদের বিতরণ করা ঋণরে পরিমাণ সাত হাজার ১২৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ অর্থাৎ এক হাজার ৩৭০ কোটি ৬০ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে।

“হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তর করে মালিকরা আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়েছেন। এরপর করোনাসহ নানামুখী সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত সংকট কাটেনি। সাভারে কারখানা প্রস্তুত করতে নগদ অর্থ যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। এখন কাজ করার মূলধন নেই। করোনার কারণে ব্যবসাও খারাপ। সময় মতো ঋণের অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে ঋণখেলাপি হচ্ছেন অনেকে”
(“মো. শাহীন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিটিএ”)

বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিয়েছে চার হাজার ৯৫৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা অর্থাৎ ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১৮২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। খেলাপির পরিমাণ ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

চামড়া খাত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এ খাত আশানুরূপ সুবিধা পায়নি। চামড়া খাতে বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ আছে। এ ঋণের বিপরীতে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হয়। অনেক কারখানার মালিক সময় মতো ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারেন না। ফলে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, বি‌শ্বের অন্যান্য দে‌শের মতো সমমা‌নের পণ্য তৈ‌রি ক‌রেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দাম পাচ্ছেন দেশীয় উৎপাদনকারীরা। শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্সের অভাব দে‌খি‌য়ে পণ্যের মূল্য কম দি‌চ্ছে আন্তর্জা‌তিক ক্রেতা প্র‌তিষ্ঠানগু‌লো। এজন্য ম্যাপিং করে এগোনো দরকার। এটা করতে পারলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাত থেকে আট থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করা সম্ভব। তবে এজন্য নেওয়া কর্মপরিকল্পনাগুলো সময় মতো এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন জরুরি।

“আমরা জমির মালিকানা সমস্যার সমাধানসহ সরকারের নীতিসহায়তা চাই। যদি নীতিসহায়তা দেওয়া হয় তাহলে নতুন করে চামড়া খাত ঘুরে দাঁড়াবে, পাশাপাশি নতুন ঋণ নেওয়া সহজ হবে। খেলাপি ঋণও কমে আসবে”
(“মো. শাহীন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিটিএ”)

একই সঙ্গে চামড়া খাতের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ‘লেদার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ গঠনের প্রস্তাব করেন ড. এম আবু ইউসুফ।

দেশে সংগ্রহ করা পশুর চামড়ার বেশির ভাগই আসে ঈদুল আজহার সময়। এ কারণে প্রতি বছর কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ঋণ সুবিধা দেয় ব্যাংকগুলো। আগের বছরের ঋণ পরিশোধ করলেই নতুন ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে ঋণের বেশির ভাগ অর্থই ফেরত দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে মন্দ ঋণ কমছে না।

ঈদুল আজহা উপলক্ষে এবারও কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ঋণসুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের দেওয়া ঋণ খেলাপি হলে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে।

তবে, নিয়ম মতো ঋণ পরিশোধ না করায় এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। করোনার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে চামড়া কিনতে যেখানে ৫৫৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক, এবার তার অর্ধেকেরও কম ঋণ দিতে চায় তারা। সবমিলিয়ে ২৪৫ কোটি টাকার ঋণ দিতে প্রস্তুত ব্যাংকগুলো। যদিও এ পরিমাণ ঋণ শেষ পর্যন্ত বিতরণ সম্ভব হয় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

“বি‌শ্বের অন্যান্য দে‌শের মতো সমমা‌নের পণ্য তৈ‌রি ক‌রেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দাম পাচ্ছেন দেশীয় উৎপাদনকারীরা। শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্সের অভাব দে‌খি‌য়ে পণ্যের মূল্য কম দি‌চ্ছে আন্তর্জা‌তিক ক্রেতা প্র‌তিষ্ঠানগু‌লো। এজন্য ম্যাপিং করে এগোনো দরকার”
(“অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়”)

জানা যায়, চলতি বছর জনতা ব্যাংক ঋণবাবদ ১২০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। গত বছর একই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিতরণ হয় মাত্র ৪০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি দেয় ২০৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক এবার ৩০ কোটি টাকার ঋণ দেবে। ২০১৯ সালে তারা দিয়েছিল ১৫৫ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক দেবে ৭০ কোটি টাকা। করোনার আগের বছর ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে দেয় ১৩০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক এবার ২৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০১৯ সালে তারা দিয়েছিল ৭০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, ৯০-এর দশকে বিতরণ করা ঋণের বেশির ভাগ অর্থই ফেরত না আসায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা এবার চামড়া কিনতে তেমন ঋণসুবিধা দিচ্ছে না।

“কোরবানির সময় পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা চাহিদার চেয়ে অনেক কম। আমরা বলেছিলাম, পুরোনো ঋণের হিসাব না করে নতুন করে ঋণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি, এবার আশানুরূপ চামড়া সংগ্রহ হবে”
(“শাহীন আহমেদ, এমডি, এসকর্ট ফুটওয়ার্স লিমিটেড”)

এ বিষয়ে এসকর্ট ফুটওয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার মতো ঋণ অনুমোদন করেছে। চামড়া কেনার জন্য এই পরিমাণ অর্থ যৎসামান্য। কারণ, কোরবানির সময় পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা চাহিদার চেয়ে অনেক কম।’

ট্যানারি উদ্যোক্তাদের এ নেতা বলেন, চামড়া কিনতে নয় মাসের জন্য নগদ ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। যারা আগের বছরের ঋণ পরিশোধ করেন তারাই নতুন ঋণ পান। সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের পর এ খাতে সমস্যা চলছে। নতুন করে কারখানা প্রস্তুত করতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। অনেকে আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। এ কারণে আমরা বলেছিলাম, পুরোনো ঋণের হিসাব না করে নতুন করে ঋণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। তারপরও আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা করছি, এবার আশানুরূপ চামড়া সংগ্রহ হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement