১৯ মে, ২০২৪, রবিবার

মারের পর জখমে মরিচ লাগিয়ে দিত!

Advertisement

হাড্ডিসার ফারজানার শরীর। শরীরের তুলনায় পেট ফুলে আছে বেশ। মাথার চুল ছোট করে কাটা। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতচিহ্ন। কনুইয়ে পোড়া দাগ। কানেও আছে আঘাতের প্রভাব। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। অনেক কষ্টে কথা বলার সময় মনে হয়, গর্ত থেকে চোখ দুটো বের হয়ে আসবে। ফারজানার প্রকৃত বয়স এখন কত, তা তাকে দেখে বোঝা যায় না। পাশে বসা মা বললেন, সতের বছর।

ছোট বয়সে ফারজানাকে রাজধানীর এক বাসায় কাজে দিয়েছিলেন তার মা-বাবা। ফারজানার অভিযোগ, এলিফ্যান্ট রোডের ওই বাসায় সে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মারধরের সময় চিৎকার করলে বা কাউকে বললে তার মা-বাবাকে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হতো। তাই সে সব নির্যাতন সহ্য করছিল। ১৭ জানুয়ারি রাতে ফারজানাকে ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

ফারজানা যে বাসায় কাজ করত, সেই বাসার গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফ সুমির বিরুদ্ধে ২০ জানুয়ারি কলাবাগান থানায় মামলা হয়। ফারজানার বাবার করা এই মামলায় সাধারণ আঘাত, গুরুতর আঘাত, হত্যার হুমকিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। আসামিকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে আসামিকে কারাগারে পাঠান আদালত। তবে গতকাল সোমবার সামিয়া ইউসুফের জামিন হয়েছে বলে জানান তাঁর আইনজীবী মো. কাজল রশীদ বিশ্বাস।

২১ জানুয়ারি র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু নাঈম তালাতের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভুক্তভোগী ও তার বাবা বিল্লাল হোসেনের কথা অনুযায়ী, ফারজানা কাজে সামান্যতম ভুল করলেও তাকে মারপিট ও জখম করতেন সামিয়া ইউসুফ। প্রায়ই তাকে মারপিট করা হতো। ১৭ জানুয়ারি মারপিটের ঘটনায় ফারজানা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি করা হয়।

২৪ জানুয়ারি, সোমবার ফারজানার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে এক তরুণ বলতে থাকেন, ‘ফারজানার চুলকানি হয়েছে। তাই শরীরে দাগ হয়েছে। ফারজানার সিস্ট আছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার শরীরের এই দশা হয়েছে।’ পরিচয় জানতে চাইলে তরুণ দাবি করেন, তিনি সামিয়া ইউসুফের পরিবারের পক্ষ থেকে ফারজানাকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে এসেছেন।

তরুণ যখন চুলকানির কথা বলছিলেন, তখন ফারজানা উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে, ‘আপনি আমার জ্বালা কেমন বুঝবেন? মিথ্যা কথা বলেন কেন? এইগুলা চুলকানির দাগ? এইগুলা হলো মাইরের দাগ।’ ফারজানার দাবি, গৃহকর্তী তাকে টয়লেটে ঢুকিয়ে হাত-পা বেঁধে মার দিত। মারের পর জখমে মরিচ লাগিয়ে দিত। দেয়ালে মাথা বাড়ি মারত। খাবার দিত কম। এইটুকু ভাত, আর এইটুকু তরকারি। আমি আর কথা বলব না। আমি শুধু বিচার চাই। আমার সঙ্গে যা করেছে, তার জন্য শাস্তি চাই। ফারজানা আরো বলে, আমার পেটে লাথি মারছিল। তারপর পেট ফুলে গেছিল। আগে এক হাসপাতালে নিছিল। সেইখানে কোনো চিকিৎসা হয় নাই। আপনারে সারা শরীর দেখাতে পারছি না। সারা শরীরে খালি দাগ আর দাগ। সব মাইরের দাগ।

ফারজানা পাশে বসা মা জ্যোৎস্না বেগম বলেন, এখন একটু কথা বললেই মেয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। একই বাসায় ফারজানার ছোট বোন ও এক খালার মেয়ে থাকত। ফারজানার ছোট বোনের পায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। ফারজানা তিন হাজার টাকা বেতন পেত। তবে ওর ছোট বোন কোনো বেতন পেত না। ওই দুজনকেও বাসা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। জ্যোৎস্না বেগম আরো বলেন, এর আগে ফারজানাকে এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি—এ কথা তাঁকে গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। এতে তাঁর মনে খটকা লাগে। তিনি তাঁর স্বামী বিল্লাল হোসেনকে মেয়ের অবস্থার কথা জানান। পরে তাঁরা থানায় গিয়ে মেয়েকে উদ্ধারের আবেদন জানান।

এক ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগে থাকেন জ্যোৎস্না ও বিল্লাল। জ্যোৎস্না বলেন, ফোন করলেই ফারজানা তাঁকে বলত, সে ভালো আছে। তবে এক মাস আগে একবার ফারজানাকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখন তাকে কাছে আসতে দেওয়া হয়নি। ফারজানা দূর থেকে কথা বলে। তখন তিনি বুঝতে পারেননি, ফারজানাকে এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক ফারজানার চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্র দেখে বলেন, ফারজানার সারা শরীরে পানি এসেছে। ওর কিডনিতেও পানি জমেছে। ওষুধ দিয়ে শরীরের পানি বের করা হচ্ছে। ফারজানার টিউমার বা সিস্ট আছে। এ ছাড়া রক্তস্বল্পতা, প্রোটিনস্বল্পতাসহ নানান জটিলতা আছে। তার শরীরে ক্ষত বা দাগ আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার চিকিৎসা চলছে।

ফারজানার বাবার করা মামলা তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক শামীম হাজরা বলেন, ১৭ জানুয়ারি তাঁর নাইট ডিউটি ছিল। তখন তিনি জানতে পারেন, মেয়েকে বাসায় আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ নিয়ে থানায় এসেছেন মা-বাবা। তারপর মেয়ের মা-বাবাসহ ফোর্স নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। তখন ফারজানা অসুস্থতার জন্য কথা বলতে পারছিল না। মেয়েটিকে উদ্ধার করে থানায় আনা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেয়েটিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। সে রাতেই ফারজানাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। পরদিন ওসিসি থেকে ফারজানাকে অন্য কোনো হাসপাতালে ভর্তি করতে বলা হয়। পরে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হয়। কিন্তু সিট না থাকায় তাকে ভর্তি করা যায়নি। তাকে কমফোর্ট হাসপাতালে নিলে তারা এ ধরনের রোগী ভর্তি করে না বলে জানায়। পরে আবার বাধ্য হয়ে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হয়। সিট ফাঁকা হলে তাকে ভর্তি করা হয়।

এসআই শামীম হাজরা বলেন, প্রথমে ফারজানার মা-বাবা এ ঘটনায় কোনো মামলা করতে চাননি। পরে মামলা করতে রাজি হন। মামলার আসামি গৃহকর্ত্রী সামিয়া ইউসুফকে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে। ২১ জানুয়ারি আসামিকে আদালতে নেওয়া হয়। তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement