৭ মে, ২০২৪, মঙ্গলবার

ঢাকার যানজটে স্থবির জনজীবন

Advertisement

তিলোত্তমা নগরী ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘোরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটারই সুষ্ঠ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান সমস্যা হলো যানজট। কার্যত এই সমস্যা শহরটাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে ফেলেছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। বাইরে বের হয়েই প্রথম যে সমস্যায় আমাদের প্রতিনিয়ত পড়তে হয় তা হলো যানজট।

যানজট কেবল ঢাকার সমস্যা নয় বরং এশিয়ার কয়েকটি দেশসহ অনেক বিশ্বেই যানজট মারাত্মক সমস্যা হয়ে বসে আছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। রাস্তার ভেতর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। তবে ঢাকার মতো এত প্রকট আকার ধারণ করা শহরের সংখ্যা এত নেই। কিছু কিছু এলাকায় তো গাড়ির গতির চেয়ে মানুষের হাঁটার গতিই বেশি!

যানজটের এই অবস্থার জন্য ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯ এ প্রকাশিত তথ্য মতে ঢাকা আছে প্রথম অবস্থানে, দ্বিতীয় অবস্থানে কলকাতা। ২০১৫ সালে এই অবস্থান ছিল অষ্টম। এখন যেহেতু আমরা প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছি তাই অবনতি হলেও অবস্থান বদলাবে না। পরিস্থিতি যে খুব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা বোঝার জন্য কোনো অবস্থান জানার দরকার হয় না। প্রতিদিনকার অবস্থা দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যায়। ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহন, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল এসব যানবাহন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার যানজট বৃদ্ধির জন্য বাস্তবিকপক্ষে পারস্পরিক কয়েকটি বিষয় দায়ী। ট্রাফিক সিগন্যাল আর ১০টা সাধারণ আইনের মতই মেনে চলার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তাই কয়েকবার ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করেও সাফল্য পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়েই ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় কঠোর হতে হয়। লোকাল বাসগুলো সবসময় একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলেছে। উল্টো পথেও চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গাড়ি। একবার জ্যাম তৈরি হলে তা আর যেন ছাড়ার নাম থাকে না। কারণ ততক্ষণে পেছনে শতশত গাড়ির বহর। ফলে খুব অল্প ভুলে এভাবে যানজট ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।

যানজট নিরসনের জন্য ঢাকায় নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। কিন্তু এসব ফ্লাইওভার তৈরি করেও সমস্যা সেই গোড়াতেই থেকে গেছে। শহরের ভেতরে গাড়ি চালানোর নিয়ম কানুনের কোনো তোয়াক্কা করছে না চালকরা। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভেতর আনতে হবে। একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি গাড়ি থাকতে হবে। সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। স্বল্প দূরত্বে সাইকেলের মতো যানবাহন জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে একদিকে যেমন যানজটের মাত্রা কমানো যাবে অন্যদিকে দূষণের মতো বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে যে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেসব গাড়ি রাখার মতো জায়গা ঢাকায় নেই। ইতোমধ্যেই এই শহরের ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে। বলাই বাহুল্য এর বেশিরভাগই ব্যক্তিগত। কারো আরাম আয়েশের জন্য প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হয় পাবলিক বাসে যাতায়াত করা মানুষগুলোকে।

মূলত যানজট নিরসনের জন্য দেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা দরকার যা ঢাকা শহরের মতো একটি সমস্যাপূর্ণ শহরের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি হলেও তা যেন কার্যকরী হয়।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরানো ও যানজট নিরসনে ঢাকার আশপাশে আরও চারটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। তারা বলেছেন, রাজধানীতে যাতে আন্তঃজেলা বাসগুলো প্রবেশ না করে ও সেখানে শুধু সিটি সার্ভিসগুলো চলে সেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

মেয়র তাপস বলেন, বহির্বিশ্বে তারা দেখেন, ইন্টারসিটি বাস বা গণপরিবহণগুলো শহরের মধ্যে প্রবেশ করে না। কিন্তু আমাদের শহরের মধ্যে মহাখালী ও সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সিটি বাস টার্মিনাল আমাদের কার্যকর নেই। যেখানে সেখানে সিটি বাস রাস্তার ওপরে থেকে যানজট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঘাটারচর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে আগে ১৬০টি বাস ২৯টির মতো কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। প্রতিযোগিতা করে তারা সড়কে বাস চালাত। তারা সেটি একটি কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন। বাসমালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। তারা সবাই চান, রাজধানীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শহরের বাস শহরের মধ্যে চলবে।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি বাদ দিয়েও বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ঢাকার যানজটে। এই ক্ষতি দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশের সমান। যানজটের কারণে দিনে নষ্ট হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। মহানগরে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ যানজটে থেকে মানসিকভাবে ‘যুদ্ধ’ করতে হচ্ছে। এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, যানজট প্রভাব ফেলছে কমপক্ষে ৯টি মানবিক আচরণে। বিশেষ করে নিয়োগ পরীক্ষা, হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া, জরুরি সভা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানেও বাধা তৈরি করছে যানজট। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ ঢাকায়। কিন্তু ঢাকয় তাদের উৎসাহ কমে যাচ্ছে যানজটের কারণে। ঢাকা মহানগর থেকে খুব কাছে সাভারে ডিইপিজেড, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে যেতে যানজট বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় । বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সড়কের অংশ কমে যাওয়ায় অবস্থা এখন আরো নাজুক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সংস্থার অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিযোগিতায় যানজটের তীব্রতা বেড়েছে ঢাকায়। তাঁদের মতে, রাজধানীতে যানজটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে পূর্ব ও পশ্চিমে সংযোগ সড়ক কম থাকা, অবৈধ পার্কিং, ফুটপাতের অবৈধ দখল, ভাসমান বিক্রেতাদের সড়ক দখল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, গণপরিবহন হিসেবে বাস নিবন্ধনের হার ২ শতাংশ, অথচ মোটরসাইকেল নিবন্ধনের হার ঢাকায় ৪৫ শতাংশ। বড় গাড়ির বদলে ছোট গাড়ি বেশি নিবন্ধনের উল্টো নীতিতে দিনে প্রায় স্থবির হয়ে থাকে ঢাকা। স্থবির ঢাকাকে সচল করতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত দুই মেয়রকে পুরনো মেয়রদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদি কর্মসূচি প্রণয়ন করতে সুপারিশ করেছেন গবেষকরা। বাসভিত্তিক গণপরিবহন ব্যবস্থা ও পথচারীবান্ধব ফুটপাত চালু, প্রায় ১০ লাখ রিকশাসহ ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিনিয়োগ ছাড়াই ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে তাঁরা মনে করছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ঢাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ১০ বছরে। তার পরও ঢাকায় যানজট কমছে না। ছোট গাড়িতে যাত্রী কম পরিবহন করা হয়; কিন্তু রাস্তার জায়গা দখল করে বেশি। এ কারণে যানজট তীব্র হচ্ছে। ঢাকায় কর্মঘণ্টা নষ্ট, জ্বালানির অপচয়সহ বিভিন্ন খাতে ২০১৪ সালেই ক্ষতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ছোট গাড়ি বেড়েছে, সংযোগ সড়ক বাড়েনি। বরং ছোট গাড়ি চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার করা হয়েছে; কিন্তু কোম্পানিভিত্তিক বাস চালুর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি চর্চাসহ বিভিন্ন কাজের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় যাত্রীদের ঢাকামুখী চলাচল বাড়ছে। দেশের শহরে বসবাসকারী ৩২ শতাংশের বেশি মানুষ ঢাকায় বাস করছে। আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা হলেও ঢাকায় আছে ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে ঢাকার পূর্বাংশের দিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া গুরুত্ব দিতে হবে ল্যান্ড জোনিং, সিটি গভর্নমেন্ট সিস্টেম চালু করার বিষয়ে। ঢাকায় বছরে স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ৩৫৮ হেক্টর জলাভূমি। দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বাস করে ঢাকায়। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২০ শতাংশ এবং মোট জাতীয় আয়ের ৩৩ শতাংশ আসছে এ শহর থেকেই। ৮০ শতাংশ রপ্তানিমুখী শিল্প রয়েছে ঢাকায়। গবেষকদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঢাকার যানজট নিরসন। ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার রেল ও সড়ক পথ করতে হবে। এ ছাড়া বাস টার্মিনালগুলো দ্রুত সরাতে হবে।  দৈনন্দিন জীবণ থেকে যদি যানজট নিরসন করা যায়, তবে দেশের আর্থিক উন্নতি সম্ভব। মানুষ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলবে এবং কাজ করতে উৎসাহী হবে। যানজট আমাদের প্রাত্যহিক জীবণ থেকে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করে। 

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement