৮ মে, ২০২৪, বুধবার

ঢাকার নামী হাসপাতালে ভুঁইফোড় হাসপাতালের আইসিইউ চক্র, রমরমা বাণিজ্য!

Advertisement

ধরুন আপনার কোন স্বজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ‍গুরুতর অসুস্থ। তার জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় সরকারি হাসপাতালে কভিড আইসিইউ যেন আকাশের চাঁদ। সরকার অনুমোদিত নামি-দামি হাসপাতালগুলোতেও ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা।

এর পরও শেষ চেষ্টা হিসেবে আপনি ঢাকার কোন নামী বেসরকারি হাসপাতালে ফোন দিলেন আইসিইউ এর সন্ধানে। তারা সোজা জানিয়ে দেবে-খালি নেই। এরপর শুরু আপনার ভোগান্তির পালা। খানিক পর থেকেই এমন এমন সব ভুঁইফোড় হাসপাতাল থেকে আপনার নাম্বারে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করবে যে আপনার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়ার যোগাড়।  

আপনি একের পর এক যেসব ফোনকল পাবেন তাতে থাকবে আইসিইউ খালি থাকার খবরসহ ঢাকার এমনকি বিশ্বের অনেক হাসপাতালের চেয়েও তাদের সেবা যে আধুনিক ও উন্নত তার একগাদা বিবরণ। সেসব হাসপাতালের নামও আপনি কখনো শোনেননি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদিত হাসপাতাল ও কভিড চিকিৎসা কেন্দ্রের তালিকাতেও তাদের অনেকের নাম মিলবে না।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- আপনার নাম্বার তারা পেল কোথায়? আপনি যে চার পাঁচ তিন তারকা হাসপাতালে খোঁজ নিতে ফোন দিয়েছেন- ঠিক সেখানেই লুকিয়ে আছে আইসিইউ বাণিজ্য চক্রের সদস্যরা। নিমিষেই তারা কমিশন বাণিজ্যের অংশ হিসেবে ভুঁইফোড় হাসপাতাল চক্রের কাছে চালান করে দিচ্ছে রোগীর স্বজনদের ফোন নম্বর।

দেশে দিন দিন কারোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলছে। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশেরই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ায় দ্রুত তারা শ্বাসকস্টজনিত সমস্যাসহ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এতে দেশের হাসপাতাল ও করোনার চিকিৎসা সেবার ওপর চাপ বাড়ছে।

ক্রমাগত করোনা রোগী বাড়তে থাকায় কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন, চিকিৎসা সামগ্রীসহ আইসিইউর সংকট দেখা দিচ্ছে। অনেক করোনা আক্রান্ত রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও আইসিইউ পাচ্ছেন না তাদের স্বজনরা। এতে এসব রোগীর অবস্থা আরও ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। আর এই সুযোগটাই লুফে নিচ্ছে রাজধানী ঢাকার ভুঁইফোড় হাসপাতালের আইসিইউ চক্র। আর তাদের রসদ যোগাচ্ছে খোদ নামী-দামী হাসপাতালের কিছু অসৎ কর্মকর্তা।

ঢাকার বড় হাসপাতালকেন্দ্রিক আইসিইউ বাণিজ্য চক্রের বিষয়ে ফেসবুকে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তাক শরীফ। তাঁর ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে দেয়া হলোঃ-

‘‘আমার বৃদ্ধা ফুফু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮০-র নিচে নেমে গেছে। আজ সকালে একটি আইসিইউ, নিদেনপক্ষে এইচডিইউর খোঁজে সারা শহর চষে বেড়িয়েছে সবাই। আমি নিজেও দু এক জায়গায় ফোন করে দেখেছি, লাভ হয়নি। শেষে আমার ছোট বোনের চেষ্টায় ধানমন্ডির নামকরা একটি হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করা গেছে।

মজার ব্যাপার হলো, আমার ফুফাত ভাই রাজু যখন একটার পর একটা হাসপাতালে আইসিইউর জন্য চেষ্টা করে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল তখন তার ও তার ছোটভাইয়ের কাছে আট থেকে দশটি ফোন এসেছে, আট-দশটি ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতাল থেকে। কেউ কখনো নামও শোনেনি এসব হাসপাতালের। ফোনে ঐসব হাসপাতালের ‘প্রতিনিধিরা’ আমার ফুফাত ভাইদের বোঝানোর চেষ্টা করছিল, তথাকথিত ভালো হাসপাতালগুলোর চেয়ে তাদের হাসপাতাল অনেক ভালো এবং প্যাশেন্টকে ওখানে পাঠানোর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর কিছুই হতে পারে না।

আমার ফুফুর অসুস্থতার খবর তারা কীভাবে পেল সে এক রহস্য বটে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস যেমন সক্রিয় তেমনি সক্রিয় হয়ে উঠেছে অন্যরকম কিছু ভাইরাসও। শেষ বিচারে কোনটি যে বেশি ভয়ংকর কে জানে!’’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউ এর সংখ্যা আরও কমেছে। গতকাল ২৩ জুলাই হাসপাতালগুলোতে ৪২ বেড ফাঁকা থাকার কথা জানালেও স্বাস্থ্য অধিদফতর আজ জানাচ্ছে, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৩৮টি।

ঢাকায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারিভাবে ১৬টি হাসপাতাল নির্ধারিত। এগুলোর মধ্যে ‑ সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হলেও সেখানে তাদের জন্য আইসিইউ নেই।

বাকী ১৩ হাসপাতালের মধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয় বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালর ১০ বেড আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছেন।

অর্থাৎ, রাজধানী ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বড় সাত হাসপাতালেই আইসিইউ ফাঁকা নেই। বাকীগুলোর মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ বেডের মধ্যে পাঁচটি, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের আট বেডের মধ্যে দুইটি, টিবি হাসপাতালের ১৬ বেডের মধ্যে ১২টি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ১০ বেডের মধ্যে চারটি ও ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের ২১২ বেডের মধ্যে ১৪টি বেড ফাঁকা রয়েছে।

ঢাকার করোনা রোগীদের অন্যতম চিকিৎসা কেন্দ্র কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটিতে কোভিড রোগী ভর্তি করার সক্ষমতা ৩০০ হলেও বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ৩৪৩ জন রোগী। আইসিইউ বেড রয়েছে ১০টি। বর্তমানে কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই। সব সিটেই করোনা রোগীতে ভর্তি আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটিতে ৩২ করোনা রোগী ভর্তি হয়েছেন আর ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৭ জন। এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনার চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ৪৩৯টি, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার সংখ্যা ৫৭টি ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের রয়েছে ৩৯টি।

করোনার এই সঙ্কটকালে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে ভুঁইফোড় হাসপাতালগুলো। কোনমতে একবার কোন রোগীকে হাসপাতালের করিডরে ঢোকাতে পারলেই পকেট সাবাড় করে নিচ্ছে। চিকিৎসা এবং সেবা না পেয়ে রোগীর অবস্থাও খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। অবিলম্বে এই আইসিইউ সিণ্ডিকেট বন্ধ ও ভুঁইফোড় হাসপাতাল এবং বড় হাসপাতালে তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement