১৯ মে, ২০২৪, রবিবার

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের প্রস্তুত করতে হবে

Advertisement

বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক ভ্যালু চেইন বা মূল্য শৃঙ্খল কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এই খাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রুত রূপান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি উত্পাদন কাঠামোর পরিবর্তন, ভোক্তাদের চাহিদা, পণ্যের মিশ্রণ, বাজারের গতিশীলতা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের আসন্ন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এই রপ্তানিমুখী খাতের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি, তৈরি পোশাক শিল্প এবং এই শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকদল এই ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের মুখোমুখি কিভাবে হবে সেটা এখন ভাবনার বিষয়। এই প্রেক্ষাপটে সামনের বছরগুলোতে তৈরী পোষাক খাতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং ভোক্তা চাহিদা পুনরুদ্ধারে যে অসম প্রবণতা রয়েছে তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। তাছাড়া, অতিমারি-পূর্ব কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে অতিমারি-প্ররোচিত চ্যালেঞ্জগুলো সংশ্লিষ্ট সকলকে তৈরী পোষাক খাতের উপর দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য করছে।

এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ “বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ও শ্রমিক: ভবিষ্যৎ চিন্তা (Bangladesh’s RMG Sector and Workers: Anticipating the Future)” শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করে।

তৈরি পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ গতিপথ এবং শ্রমিকদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের আসন্ন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এই খাতের জন্য কি কি পরিবর্তন আনবে সে বিষয়গুলোও এই সংলাপে আলোচিত হয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান একটি সূচনা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ২০২১ সালের প্রথম অর্ধ-বছরে প্রায় ১৩৭৯ খানায় একটি সমীক্ষা জরিপ চালানো হয় এবং সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে মূলত কোভিড অতিমারির প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং দেখা গেছে শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশ যদিও প্রথম ঢেউয়ের সময় মজুরি পাননি, কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন প্রায় ৯৮ শতাংশ শ্রমিকই তাদের মজুরি পেয়েছেন।

যদিও ফেব্রুয়ারি ২০২০ এর তুলনায় মার্চ ২০২১ এ খানার আয়ের পরিমাণ প্রায় ১১ শতাংশ কম গেছে। সমীক্ষা করা পরিবারের প্রায় ৬৭ শতাংশ পরিবারকে দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময়ে বিকল্প পন্থা হিসেবে ঋণ নিতে হয়েছিল এবং সেটি প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় বেশী। এই ঋণ পরিশোধ করতে তাদের গড়পড়তা প্রায় দুই বছর সময় লাগতে পারে বলেও তারা জানিয়েছেন। কাজ হারানো শ্রমিকদের মাত্র ২৫ শতাংশ বলেছেন তারা শ্রমিক ইউনিয়নের ভূমিকায় খুশি আছেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর সাবেক সভাপতি এবং মালেক স্পিনিং মিল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিন চৌধুরী এতে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, আগামী কয়েক বছরে পোশাক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার একটি বড়ো সুযোগ আছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর পরিচালক ও সাবেক সভাপতি এবং মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কেন্দ্র করে আলোচনা করেন। তিনি বলেন শ্রমিকদের আসন্ন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে এবং নতুন ধরনের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, অতিমারির ফলে শ্রমিকরা নানা ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য পড়েছে। যে কারণে রাষ্ট্র, গার্মেন্টস শ্রমিক, উদ্যোক্তা, গবেষক এবং নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিন্ত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য বীমা সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উপরে তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার মনে করেন শ্রম আইন অনুযায়ী এখন মজুরি মূল্যায়নের কথা চিন্তা করতে হবে, কারন শ্রমিকরা সর্বক্ষণ এ নিয়ে হুমকির মুখে থাকে। অতিমারির কারণে মালিক এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য একটি জরুরি তহবিল গঠন করতে হবে। মাহজাবিন কাদের, সিনিয়র এডভাইজার, ইকোনোমিক এফেয়ার্স এন্ড সি এস আর, এ্যামবেসি অফ দি কিংডম অফ দি নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ, মনে করেন শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক কে সংস্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশেরও উন্নয়ন করতে হবে।

ভবিষ্যতে ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আমদানির অনেক সুযোগ আছে বলে মনে করেন ড. আব্দুর রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড)। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, আগামি কয়েক দশকে পোশাক শিল্পে স্বয়ংক্রিয়তা যদি বেড়ে যায় তাহলে পোশাক উত্পাদন বাড়বে ঠিকই কিন্তু শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনার একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। তিনি মনে করেন, গার্মেন্টস শিল্পে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন আগামী সাত-আট বছরে হবে। আমরা যেহেতু পণ্য রপ্তানি করছি, উত্পাদনশীলতা কমে গেলে এর অভিঘাত শ্রমিকদের ওপরই বেশি পড়বে।

ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর পংকজ কুমার সংলাপে সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন এবং বলেন যে, আমরা শুধু পোশাক খাত নিয়েই কথা বলি কিন্তু পোশাক খাতের অন্যান্য বাহ্যিক বিষয় যেমন উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং তা কিভাবে হচ্ছে সেসবের ওপরেও আলোকপাত করা উচিত।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টার্চায বাংলাদেশ সংলাপের সভাপতিত্ব করেন। তিনি বাংলাদেশের শিল্পখাতের আগামী ৩০-৪০ বছরে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে এবং যে শ্রমিকরা যুক্ত আছেন তাদের আয়ের ভবিষ্যতের উপর আলোকপাত করার কথা উল্লেখ করেন।

আলোচনার সমাপ্তিতে তিনি বলেন, শ্রমিকদের পরিশ্রমেই বাংলাদেশের অর্থনীতি চলছে এবং কিন্তু প্রয়োজনের সময় তারাই আর্থিক সুরক্ষা পেলো না। শ্রমিকদের সামাজিক অধিকার, ভবিষ্যত সুরক্ষার নিশ্চয়তা, আয় বহির্ভূত সুবিধা এবং বিশেষ করে নারীদের শ্রমশক্তিতে আরও কার্যকর ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য একটি আপৎকালীন তহবিল গঠন করবার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এই বিষয়ের সাথে সংপৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, তৈরী পোষাক খাতের উদ্যোক্তা, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং উন্নয়নকর্মী এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা; এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement