২৭ এপ্রিল, ২০২৪, শনিবার

পাহাড়ের চ্যাম্পিয়নরা: দুর্গম পথ পেরিয়ে আদিবাসী ক্রীড়াবিদদের দুর্বার পথচলার গল্প

Advertisement

সুরা চাকমা, সুশান্ত ত্রিপুরা কিংবা মারিয়া মান্ডা; লড়াইয়ে নেমে কেউই নিজেদেরকে শুধু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অংশ ভাবেন না। তখন তাদের পরিচয় একটাই, তারা প্রতিনিধিত্ব করছেন লাল-সবুজের।

বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিয়মিত রাঙামাটি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তালিম নিতে যাওয়ার ব্যাপারটা শুরুতে পরিবারের থেকে গোপন করেছিলেন। যখন ধরা পড়লেন, পরিবারের সদস্যদের হাতে মারই খেতে হলো। না ছিলো সুযোগ-সুবিধা, না ছিলো ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত সরঞ্জাম।

কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়া যে তার ধারাপাতে নেই। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে লেকি চাকমার স্বপ্ন পূরণ হয় গত বছর, জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেট দলে।

‘লেকি ভয়ডরহীন একজন ক্রিকেটার। শুরু থেকেই সে কঠোর পরিশ্রম করেছে, সুযোগ পেলে তো ছেলেদের সাথেও খেলেছে। বহু বাধা পেরিয়ে সে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এটা কেবলই শুরু। কথাগুলো বলছিলেন লেকির কোচ টেলেন্ট চাকমা।

লেকির গল্পটা অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে শুধু লেকি নয়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে যে কারও জন্যই ক্রিকেট বা অন্য খেলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা বেশ কঠিন। তবে সব প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করা আদিবাসীর সংখ্যা নেহাত কম নয়।

যদিও প্রশ্ন থেকেই যায়- যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকলে আরও বেশি আদিবাসীকে ক্রীড়াঙ্গন মাতাতে দেখা যেতো?

বরুণ বিকাশ থেকে সুরা কৃষ্ণ চাকমা: উজ্জ্বল নক্ষত্র

সুরা কৃষ্ণ চাকমা; আন্তর্জাতিক ট্রফিজয়ী এই বক্সার বর্তমানে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত নামগুলোর একটি। রাঙামাটির এক ক্রীড়ামোদী পরিবারে বেড়ে ওঠা সুরার বাবা-চাচারা তাদের সময়ে সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন খেলায়।

টিবিএসকে সুরা বলেন, ‘খেলাধুলা আমার রক্তে। প্রথমে আমি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ফুটবল ট্রায়াল দিই, কিন্তু উচ্চতার কারণে বাদ পড়ে যাই। এরপরই আমার বক্সিংয়ে আসা।’

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আরেকজন প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ রংপুরের বরুণ বিকাশ দেওয়ান, যিনি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জাতীয় দলের হয়ে ২১ ম্যাচ খেলা বরুণ খেলেছেন ১৯৯০ এশিয়ান গেমসেও। তার বড় ভাই অরুণ বিকাশও খেলেছেন জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে।

নব্বইয়ের দশকে ফুটবলে অসামান্য কৃতিত্ব ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গত মাসে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান বরুণ বিকাশ।

বরুণ বিকাশ দেওয়ান

‘এটা আমার জন্য, পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর জন্য অত্যন্ত গর্বের একটা মুহূর্ত। আমি মনে করি, দেশের জন্য, ফুটবলের জন্য যা করেছি, তার যথাযথ স্বীকৃতি আমাকে দেয়া হয়েছে।’ বলেন বরুণ বিকাশ।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ ফুটবলারদের একজন সুশান্ত ত্রিপুরা। প্রতিভাবান এই ফুটবলার ইতোমধ্যে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন, খেলেছেন আটটি ম্যাচ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে আগে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেললেও এখন খেলছেন এতিহ্যবাহী আবাহনী লিমিটেডের হয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন অনেক নারী ফুটবলারও। গত বছরের ডিসেম্বরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সেরার মুকুট জেতে বাংলাদেশ। দলটার হয়ে খেলেছেন মনিকা চাকমা, ঋতু পর্ণ চাকমা, আনাই মোগিনি, আনুচিং মোগিনি ও মারিয়া মান্ডার মতো আদিবাসী ফুটবলাররা। আনাই মোগিনির জয়সূচক গোলেই সাফের শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ।

শুধু ফুটবলারই নয়, বাংলাদেশের প্রথম ফিফা নারী রেফারি জয়া চাকমাও এই জনগোষ্ঠীর অংশ। ফুটবলের তুলনায় ক্রিকেটে আদিবাসীদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলা আদিবাসী ক্রিকেটার রাঙামাটির চম্পা চাকমা।

২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাংলাদেশ নারী জাতীয় দলে খেলেছেন চম্পা, যদিও তখনও বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ পায়নি। ২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে রৌপ্য পদকজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন চম্পা।

এর বাইরে ভারোত্তোলনে ফুলপতি চাকমা ২০১৬ এসএ গেমসে রৌপ্যসহ জিতেছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ট্রফি।

স্থানীয় দৃশ্য: আগে ও এখন

গত কয়েক বছরে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে সত্যি, কিন্তু স্থানীয়ভাবে নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে না, যা নিয়ে খেলোয়াড় ও প্রশিক্ষকদের মধ্যে কাজ করছে হতাশা।

ফুটবলটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ব্যাডমিন্টনও জনপ্রিয়, তবে খেলাটা শীতকালীন। তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশই ফুটবল পছন্দ করে। যদিও ধীরে ধীরে অন্যান্য খেলার দিকে ঝুঁকছে তারা, তবু ফুটবল এখনও বেশ ভালো ব্যবধানেই এগিয়ে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো নিয়মিত। শূন্য দশকে তা চলমান থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করে।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে বরুণ বিকাশ কাজ করেছেন সংগঠক ও প্রশিক্ষক হিসেবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা নিয়মিত আন্তঃ স্কুল টুর্নামেন্ট, গোল্ড কাপ টুর্নামেন্ট খেলেছি। ফুটবল তখনকার সময়ে এখনকার চেয়ে জমজমাট ছিলো। এখন তো সেসব স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলো আর নিয়মিত হয় না।’

খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার লাইসেন্সধারী রেফারি ডেভিড চাকমা খেলেছেন ক্রিকেট-ফুটবল দুটিই। তার মতে, স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলো নিয়মিতভাবে না হওয়ার কারণেই তুমুল জনপ্রিয়তার পরও জাতীয় পর্যায়ে আদিবাসী ক্রীড়াবিদের সংখ্যা এখন অনেক কম।

শূন্য দশকের মাঝামাঝিতে পার্বত্য এলাকায় জনপ্রিয় হতে শুরু করে ক্রিকেট। তবে সুযোগ-সুবিধা ছিলো নাম মাত্র, আর নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ খেলতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। এ ছাড়া ক্রিকেট-ফুটবলের জন্য আলাদা জেলা স্টেডিয়ামও নেই।

‘স্থানীয়ভাবে টুর্নামেন্টও খুব একটা আয়োজিত হচ্ছে না, তাই স্বভাবতই লোকজনের আগ্রহ কম। অগত্যা তারা ফুটবল বা ব্যাডমিন্টন খেলে। শীতের মৌসুমে দুই-একটা টুর্নামেন্ট হয়। কয়েকটা একাডেমি আছে, কিন্তু তাদেরও নিয়মিত কার্যক্রম নেই।’ বলছিলেন ডেভিড চাকমা।

আরেক স্থানীয় কোচ টেলেন্ট চাকমা বলেন, ‘তিন-চার বছর পর পর একটা স্থানীয় টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়। এখন তো অবস্থা আরও খারাপ, কয়েক মাস আগে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়েছিল, তার আগেরটা হয়েছিলো ছয় বছর আগে।’

সমস্যা বেড়েই চলেছে

স্থানীয় খেলোয়াড়দের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় অন্তরায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা। স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে পাওয়া আর্থিক পুরস্কার যথেষ্ট নয়, তাই ক্যারিয়ার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগাটাই স্বাভাবিক।

‘স্থানীয় ফুটবলে ম্যাচ ফি নেই এবং এটাই এখানে চলে আসছে। খেলোয়াড়দেরও তো আর্থিক নিরাপত্তা দরকার। ম্যাচ খেলে ৫০০ টাকাও আয় হয় না। একজন দিনমজুরও এক ঘণ্টা কাজ করে এর চাইতে বেশি টাকা উপার্জন করে।’ বলেন ডেভিড।

‘স্থানীয় ক্রিকেটেও টাকা নেই। সংগঠকরা বিসিবির কাছ থেকে ঠিকই টাকা পান, কিন্তু সেটা আর ক্রিকেটারদের হাতে পৌঁছায় না।’ যোগ করেন তিনি।

বান্দরবনের শোভন ও জীবন ত্রিপুরা একসঙ্গেই শুরু করেন ফুটবল খেলা। দুজনের মধ্যে বেশি প্রতিভাবান হওয়ার পরও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ফুটবল ছেড়ে দেন জীবন, উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা ও চাকরি খোঁজা। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শোভন খেলেন আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল দলের হয়ে।

‘আমাকেও বোধহয় ছেড়েই দিতে হবে (হাসি)। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি, তাই জীবিকা নির্বাহ আমাকেই করতে হবে, পাশাপাশি পরিবারের দেখাশোনাও করতে হবে। আর যদি ফুটবল চালিয়েও যাই, জাতীয় পর্যায়ে কখনও খেলতে পারবো, তার নিশ্চয়তাও তো নেই।’ বলেন শোভন।

স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতে খেলোয়াড়দের শুধু হোটেল ভাড়া আর সকালের নাস্তা দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিসি গোল্ডকাপে খেলোয়াড়দের জনপ্রতি ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে, যেটা আগে কখনও দেখা যায়নি, জানান ডেভিড।

স্থানীয় ক্রিকেটারদের অগ্রগতির পথে আরেক বাধা ‘কোটা প্রথা’। ডিসি গোল্ডকাপে দলপ্রতি তিনজন খেলোয়াড়কে বাইরে থেকে আনার অনুমতি দেয়া হয়। দলগুলো তাই বাইরে থেকে খেলোয়াড় আনা এমনকি বিদেশি খেলোয়াড় পর্যন্ত নিয়ে আসার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে স্থানীয় খেলোয়াড়রা নিজেদের মেলে ধরার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না।

বক্সার সুরা কৃষ্ণ চাকমা মনে করেন, ভালো অ্যাকাডেমির অভাবও এর একটা বড় কারণ। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সাহায্য প্রয়োজন, তার জন্য পর্যাপ্ত একাডেমি দরকার, যা এখানে নেই বললেই চলে, বিশেষ করে রাঙামাটিতে। যদিও প্রতিভার কোনো কমতি নেই।’

সুরা চাকমা, সুশান্ত ত্রিপুরা কিংবা মারিয়া মান্ডা; লড়াইয়ে নেমে কেউই নিজেদেরকে শুধু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অংশ ভাবেন না। তখন তাদের পরিচয় একটাই, তারা প্রতিনিধিত্ব করছেন লাল-সবুজের। লেকি চাকমা যেমন বললেন, ‘আমি বান্দরবানের নাকি রাঙামাটির, তাতে কিছু যায় আসে না। আমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’

সংশ্লিষ্ঠ বোর্ড, অ্যাসোসিয়েশন ও ফেডারেশনগুলোর তাই উচিত প্রতিভার এই স্বর্ণখনিকে কাজে লাগানো, নয়তো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে মৃত্যু ঘটবে অসংখ্য সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদের স্বপ্নের।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement