২৬ এপ্রিল, ২০২৪, শুক্রবার

বন্ড লাইসেন্স নবায়নের দীর্ঘসূত্রিতা, ঘাটে ঘাটে ভোগান্তি- ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিমুখী শিল্প

Advertisement

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সার্টিফিকেট নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে বন্ড লাইসেন্সের প্রাপ্যতা নবায়নে ৭ কার্যদিবস সময় নেওয়ার কথা থাকলেও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এর ভয়াবহ সিন্ডিকেট এটি নবায়নে ৩ থেকে ৫ মাস সময় নিয়ে নেয়। ফলে এক বছরের প্রাপ্যতা নবায়নের বেশিরভাগ সময়টাই ব্যবসায়ীদের ঘুরতে হয় বিভিন্ন ঘাটে।

বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি পোশাক রপ্তানি করে এলআর কম্পোজিট টেক্সটাইল (ছদ্মনাম)। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে তাদের ইউটিলিটি পারমিশন সার্টিফিকেট (ইউপি) নবায়নের আবেদন করে, যা বন্ড সুবিধার মাধ্যমে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য দরকার হয়। তবে আবেদনের পরও পোশাক রপ্তানিকারক কোম্পানিটি দিনের পর দিন ঘুরেও কোনো সাড়া পায়নি। 

এরই মধ্যে গত আগস্টের শুরুতে টেক্সটাইল কোম্পানিটির আমদানি করা এবং পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক এসে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দরে। তবে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি পণ্যে ইউপি সুবিধা (ইউটিলিটি পারমিশন বা কাঁচামালের প্রাপ্যতার অনুমোদন) সনদের মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ায় তা আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস।

নবায়নের আবেদনে সাড়া না পাওয়ায় গত ১৪ জুলাই অস্থায়ী সনদের জন্যেও আবেদন করেছিল ওই কম্পোজিট টেক্সটাইল। কিন্তু এই সনদও তারা গত ৮ আগস্টের আগে পায়নি।  ফলে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে না পেরে উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তাদের। 

এটি শুধু একটি উদাহরণ। বন্ড লাইসেন্স ও ইউপি সনদ নবায়নের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় কারখানা খুলে যাওয়ার পর উৎপাদন চালু রাখতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেক রপ্তানিমুখী কারখানার মালিক।  গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোও কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এর দুর্নীতিবাজ কালো চক্রের হাতে জিম্মি। তারা গণমাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগের কথা তুলে ধরলেও কেউই ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চান না। কারন প্রাপ্যতা নবায়নে ঘুষ বা স্পিডমানি ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা হলেও গণমাধ্যমে কথা বললে সেই রেট ৪০ থেকে ৫০ লাখে গিয়ে ঠেকে।  

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর নবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয় লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রায় ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠানকে। বন্দরে কাঁচামাল আটকে থেকে বিপুল লোকসান দিতে হয় রপ্তানিকারকদের। রাসায়নিকের চালান বন্দরে আটকে যাওয়ায় বায়ারদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনও অনেক সময় ব্যাহত হয়।

নাম-পরিচয় না প্রকাশের শর্তে একটি টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন,”বিদেশি চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে কিছু কাঁচামাল অন্য ফ্যাক্টরি থেকে ধার করেছি। সব ফ্যাক্টরি তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল আমদানি করে মজুদ করে। ফলে চাইলেও শুধু ধার করে সম্পূর্ণ উৎপাদন কাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই লাইসেন্স নবায়ন করতে না পেরে উৎপাদন কমাতে হয়েছে।”

“নবায়নের জন্য বারবার চেষ্টা করেও ফল পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, আবেদন করার পর নিয়মিতই বন্ড কমিশনারেটে যোগাযোগ করা হয়েছে। একদিকে করোনার কারণে লিমিটেড লোকবল দিয়ে বন্ড কমিশনারেট চলেছে, এটি আসলে তাদের অজুহাত। অন্যদিকে ঘুষ ছাড়া পিয়ন থেকে বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে মূল কর্মকর্তার কাছে পৌছানোই যাচ্ছে না।’’ 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বন্ড লাইসেন্সের জটিল নিয়ম ও সময়ক্ষেপণের কারণে বিপাকে দেশের রপ্তানি খাতের সব প্রতিষ্ঠান।

বন্ড লাইসেন্সিং হলো শতভাগ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ। পণ্য আমদানির পর প্রতিবছর ইউপি সনদ নিয়ে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে রেখে ওই কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয়।

এনবিআরের বন্ড লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুযায়ী- বন্ডারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাৎসরিক ফি, অডিট রিপোর্ট এবং লাইসেন্সের অডিটের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বন্ড অফিসে জমা দিতে হয়। 

বন্ড কর্মকর্তারা কারখানা অডিট করে পূর্বে আমদানিকৃত কাঁচামালের সঠিক ব্যবহার সাপেক্ষে তা নবায়ন করেন। গার্মেন্টস শিল্পকে তিন বছর ও অন্য সব শিল্পকে এক বছরের জন্য এ নিবন্ধন দেয়া হয়। তবে সব প্রতিষ্ঠানকেই প্রতিবছর সনদ নবায়ন করতে হয়।

সব ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে নবায়নের জন্য ৭ কার্যদিবসের কথা বলা হলেও বিপুল অংকের ঘুষ দিয়েও কোনো প্রতিষ্ঠানই এই সময়ের মধ্যে তা হাতে পায় না বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের। অন্যদিকে অডিট সময় সাপেক্ষ হওয়া আইনে সাময়িক সনদপত্র দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা পেতে বহু হয়রানির শিকার হতে ব্যবসায়ীদের। 

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ) পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মতি কেটিভি প্রতিদিনকে বলেন, কাস্টমস বন্ড কমিশনারের অদক্ষতা, অনিয়মসহ নানান কারনে প্রাপ্যতা লাইসেন্স নবায়নে ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তির মুখে পড়েন। তাদের লোকসান গুনতে হয় এসব জটিলতায়। ৭ দিনের মধ্যে প্রাপ্যতা নবায়ন পাওয়ার কথা থাকলেও মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে। সেই বৈঠকে এই বিষয়গুলো উত্থাপন করা হবে।

দেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন (বিজিএমইএ) এর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া সহজ করাসহ অস্থায়ী সার্টিফিকেট ইস্যু করার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করে আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের অনেক সদস্য ফোন করে অভিযোগ করছেন যে তাঁরা অস্থায়ী সনদ পেতে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। দেশের আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া বাধাহীন করতে খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা হবে- বলে আমরা আশা করছি।

অন্যদিকে, আমদানি প্রাপ্যতার ইউপির মেয়াদ এক বছরের বেশি দিলে বা নবায়ন ছাড়াই ব্যবহারের সুযোগ দিলে- তা অপব্যবহার হয় বলে দাবি করছে এনবিআর।

ঢাকা বন্ডের কমিশনারেট এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, লাইসেন্স নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল এনে কেউ কেউ খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। ইউপি সনদ নবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল ব্যবহারের প্রতিবেদন জমা দেয় না। তখন হিসাবও পায় না এনবিআর। আর এ কারণেই প্রতিবছর নবায়ন জরুরি। ’’

তবে তিনি প্রাপ্যতা নবায়নে কোন অনিয়ম দুর্নীতির কথা অস্বীকার করেন।   

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement