১৯ মে, ২০২৪, রবিবার

বিনাসরিষা’ চাষে তেল আমদানিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে

Advertisement

আধুনিক প্রযুক্তিতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি উৎপাদন। দেশের কৃষি গবেষক-বিজ্ঞানীরা প্রতিদিন নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে কৃষিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। অন্য সব ফসলের ক্ষেত্রে ভালো অগ্রগতি থাকলেও তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশ। অথচ এই খাতেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপ-প্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমনের দাবি, দেশের ২২ লাখ হেক্টর পতিত (দুই ফসলের মাঝের) জমিতে যদি বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ আবাদ করা যায় তাহলে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব।

এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, দেশে যে ২২ লাখ হেক্টর জমি পতিত আছে (দুই ফসলি জমির মাঝের সময়ের)। আমন আর বোরোর মাঝে যদি আমরা এই পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে পারি তাহলে বছরে তেলের উৎপাদন আট থেকে ১০ লাখ টন বাড়বে। এতে এখন যে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেলটা আমদানি করতে হয় সেটা আর আমদানি করতে হবে না।

দেশে এখন ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরিষার তেল উৎপাদিত হয় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। বাকি থাকে ১৯ লাখ মেট্রিক টন। সয়াবিন আমদানি হয় তিন লাখ মেট্রিক টন, পাম অয়েল আমদানি হয় ১২ লাখ মেট্রিক টন। এই ১৫ লাখ মেট্রিক টন তেল আমদানি না করে যদি আমরা পতিত জমিতে বিনাসরিষা-৯ ও ৪ চাষ করি তাহলে ১৭ হাজার কোটির যে তেল আমদানি করতে হয় সেটা আর করতে হবে না। এর জন্য অবশ্যই দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে হবে বিনাসরিষার মাধ্যমে।’

বিনা সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে প্রধানত সরিষা আবাদ করা হয়। এতে প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ তেল এবং ২০-২৫ শতাংশ প্রোটিন থাকে। যদিও দেশের তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকায় সরিষা চাষ করা হয়, তারপরও ২০১৯ সালে প্রায় দশমিক ৪৬ লাখ টন সরিষা আমদানি করা হয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই সরিষা আবাদ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৮ সালে দেশে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে ২৭ দশমিক ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যদিও আমদানি করা তেলের বড় একটি অংশ শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হয়েছিল। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় ২২ লাখ) এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ায় বিগত তিন বছরে এই আমদানি হার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আশংকাজনক হারে বেড়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম হারে ২০২১ সালে দেশে ভোজ্যতেলেরই মোট চাহিদা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ মেট্রিক টনে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পাম তেল, আর ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমদানি হয় ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন পাম ও সয়াবিন তেল। এতে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে পাম তেল এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন তেল

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহের তথ্য অনুযায়ী, বিনাসরিষা-৯ এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- জাতটি অল্টারনারিয়াজনিত পাতা ও ফলের ঝলসানো রোগ প্রতিরোধী, ভারি বৃষ্টিজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা সহনশীল, মাটির অতিরিক্ত আর্দ্রতায় চাষবিহীন জমিতে বপনযোগ্য ও নাবিতে বপনযোগ্য। ৬-৮ ডিএস/মি. মাত্রার লবণাক্ত জমিতেও চাষযোগ্য এই সরিষা।

বিনা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিনাসরিষা-৯ এর প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৭৫-৯০টি এবং প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ২৫-২৮টি। বীজের আকার তুলনামূলকভাবে বড় ও ১০০০ বীজের ওজন ৩.৫-৪.০ গ্রাম। বীজের রং লালচে কালো ও বীজে তেলের পরিমাণ ৪৩ শতাংশ।

এ সরিষার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো কম সময়ে ফসল সংগ্রহ করা যায়। মাত্র ৮০-৮৪ দিনে ফসল তোলা যায়।

চাষাবাদের জমি নিয়ে কোনো চিন্তা নেই কৃষকের। সব ধরনের জমিতে চাষ করা যায়। তবে বেলে দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে জাতটি ভালো জন্মে। জমি তৈরির সময় খেয়াল রাখতে হবে ৪-৫টি চাষ দেওয়া হয় ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি হয়। জমিতে যেন বড় বড় ঢিলা ও আগাছা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সাধারণত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য নভেম্বর (কার্তিকের দ্বিতীয় হতে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত এ জাতের সরিষা বপন করার উপযুক্ত সময়। তবে নাবিতে বপনযোগ্য বিধায় ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ (পৌষের প্রথম সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজ বপন করলেও সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, আমরা চাচ্ছি কৃষকের আয় বাড়াতে। সেটা করতে গেলে লক্ষ্য রাখতে হবে জমি যেন পতিত না থাকে। সমস্যা হলো আমনের পর আমাদের বিপুল জমি পতিত আছে, সেটা সিলেট, বরিশাল, উত্তরাঞ্চল সবখানে। অনেক কৃষক জানেনও না যে এরপর তিনমাসে মধ্যে অন্য একটি ফসল করা যায়। কিন্তু শর্ত হলো আমনের সময় কম হতে হবে। স্বল্পমেয়াদী চাষ করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে ১১০ দিনের মধ্যে করার। বীজতলায় চলে যায় ২৫ দিনের মতো।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের বিশাল সংকট। আমদানি করতে হয়। ফলে তেলের জন্য সরকারকে প্রতি বছর খরচ করতে হয় ২৭-২৮ হাজার কোটি টাকা। আর এই তেলটা অধিকাংশ ভেজাল তেল। পাম অয়েলের সঙ্গে সয়াবিন অন্য কিছু মেশানো হয়। যেটা ক্ষতিকর। টানা ধান করলে তো মাটির স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে না। এর মধ্যে অন্য ফসল করতে হবে। সেখানে যদি সরিষা দেই আর অল্প সময়ে ফসল পেয়ে যাই তাহলে আমাদের ঘাটতি পূরণ হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement