৮ মে, ২০২৪, বুধবার

মহররমের মহলে

Advertisement

চটজলদি রওনা দিলাম, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেলও গড়ানোর পথে। গুলিস্তান পৌছে বুকে দম ফিরলো। সহচর ভ্রমিকে সাথে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে রিকশা হাঁকাহাঁকি শুরু। অবশেষে গন্তব্য বিরিয়ানি পাড়া খ্যাত নাজিমুদ্দীন রোড। তবে বিরিয়ানি নয়, মূল আকর্ষণ ছিলো অন্যকিছু। নগর ভবন পার হতে হতে বন্ধুকে বলছিলাম ওসমানি উদ্যানে অনাদরে পরে থাকা ‘বিবি মরিয়ম’-এর কথা। বঙ্গবাজারের বিপরীতে দাঁড়ানো পুরনো ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন দেখতে দেখতে চোখ পড়লো উপরে। অনন্ত অম্বর তখন সন্ধ্যার জানান দিচ্ছে।

তাড়া দেয়া রিকশা চাঁনখারপুল ঢুকতেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বলে দিলো জায়গামত পৌছে গেছি। রাস্তাজুড়ে থাকা সবার পোশাকে কালোর আধিক্য। শোকেরই প্রতীকে সবাইকে ছেয়েছে একরঙে। হালের যুবারা টি-শার্টও বানিয়েছে ইমাম হুসাইন-এর শোকের জবানে। পুরো রোড জুড়ে ভীড়। নেমে যেতে হলো রিকশা থেকে। এবার হন্টন প্রণালী… পুরো চানখাঁরপুল-নাজিমুদ্দীন রোড জুড়েই মানুষ। রাস্তার পাশে বসেছে পসরার দোকান। বসেছে লাড্ডু, নাড়ু আর ফুলের দোকানও। দেখতে দেখতেই চলে এলাম হুসনী দালানের মূল ফটকে। ধবল সাদা অবকাঠামোর মাথাগুলো লাল আর দরজা/জানালাগুলো সবুজ। পরে দেখলাম নকশার আবহ সব জায়গায় একই রঙ। শুধু খিলান বাদে।

নিরাপত্তা বলয় আর ভীড় পেরিয়ে আরেক আইনজীবী বন্ধুকে নিয়ে ঢুকে গেলাম দালানের মূল চত্ত্বরে। চোখের সামনেই ইতিহাস জড়িত দালান। শুধু ধর্মীয় আবহেই নয়, ধারণ করে আছে বাংলা মুঘল ইতিহাসের টুকরো আয়না। ফার্সি শিলালিপিতে লেখা ‘হোসাইনি দালান’ কালের আবহে সাধারণের ভাষায় হয়ে গেছে ‘হুস্নি দালান’। কিন্তু নিরবধি সময় ধারণ করেছে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হওয়া ইমাম হোসাইন(রঃ) কে। পথঘাট জুড়ে আতর আর আগরের সুগন্ধ। তাজিয়া না দেখলেও বুঝতে পারছিলাম যে শেষ হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.)। সেই শোক ও স্মৃতির স্মরণেই তৈরী হয় হোসেইনি দালান।

হুসাইনি দালানে মানুষের পদচারণা আজ থেকে নয়। সতেরোশ শতকে গড়ে ওঠা এ ইমারতের শিলালিপি অনুযায়ী পাওয়া যায় মীর মুরাদের নাম। যিনি ছিলেন সুবা বাংলার নৌ সেনাপতি। বলা বাহুল্য সতেরোশ শতকের বাংলায় সুবেদার ছিলেন শাহ সুজা। তাই হোসাইনি দালান তৈরীর মূল নায়ক ধারণা করা হয় মুঘল সম্রাট শাহজাহান তনয়কে। আবার অনেকে এ কৃতিত্ব দিতে চান ঢাকার নায়েব-ই-নাজিম বাহাদুর জসরত খানকে। কারণ ঢাকার বেশকয়েকজন নায়েবে নাজিমের কবর রয়েছে হুসেইনি দালান সংলগ্ন কবরস্তানে। তবে নায়েব-ই-নাজিম বাহাদুর জসরত খান ঢাকার কর্তৃত্ব পান শাহ সুজার আরো অনেক পরে। সেসূত্রে ইতিহাসের প্রথম দাবিটিই ধোপে টেকে বেশি।

ঢাকার প্রাচীণ এই নিদর্শনের মূল রূপ আমরা কেউই দেখতে পাইনি। হোসাইনি দালান সংস্কার হয়েছে দফায় দফায়। তবে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জেমস টেলরের বই অনুযায়ী ১৮৩২ সালেও দালানের আদিরূপ ছিলো। ব্রিটিশ শাসনামলে দু’বার এর সংস্কার হয়। তবে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে সংস্কার করেন নওয়াব খাজা আহসান উল্লাহ।

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক এই হোসেনি দালান ইমামবাড়া নামেও পরিচিত। হোসেনি দালান মূলত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ এবং কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি বাংলাদেশে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্রভূমি।
হোসেইনি দালান চত্বরকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমে মূল ফটক। তারপর ঢুকেই রাস্তার দু’পাশে কবরস্তান। তারপর মূল অবকাঠামো ও এর পেছনে অবস্থিত বর্গাকৃতির পুকুর।

মূল ফটক দিয়ে ঢুকে সোজা হেটে ডানপাশের কবরস্তানের কর্ণারে এসে দাঁড়াই। বাঁধাই কবরের দিকে তাকাই। বাধানো কবর মেরুন রঙ করা হয়েছিলো। রোদে জ্বলে, বৃষ্টিতে ভিজে রঙ ক্ষয়াটে হয়ে গেছে। খেয়াল করে পড়তেই বুঝলাম শায়িত রয়েছেন একজন নারী। আর মারা গেছেন ১৮৩২ সালে। বুঝে নিলাম এখনও কোন পরিজন এখনও সংস্কার করেন কবরের। ভালোবাসেন তার বংশবীজকে। নইলে দেড়শ বছরের বেশি পেরোনো কবর বাঁধাই করবার সময় কোথায় আমাদের। যেখানে ডিজিটাল ডিভাইসে বন্দী হয়ে গেছে পারিবারিক বন্ধন। ভাবালুতা পেয়ে বসে নিমেষেই, মানুষের মতো কবরেরও তো বয়স হয়, তারাও প্রাচীণ হয়। শুধু চোখের আড়ালে বলে তাদের বয়স গুণি না আমরা। অ্যালেক্স হ্যালির শেকড় খোঁজার বেদনার্ত উপন্যাস The Roots-এর উক্তি মনে পড়ে, “Through this flesh, which is us, we are you, and you are us!” আদ্র হৃদয়ে, ত্রস্ত পায়ে এগোতে শুরু করি আবার।

সবশেষ হোসাইনি দালান সংস্কার কার্যক্রম হয় ২০১১ সালে। এতে অংশগ্রহণ করে ইরান। ফলে ইরানি স্থপতি ও শিল্পীদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নতুন রূপ পায় আজকের হুসাইনি দালান। প্রতিটি থামে স্থান পায় ক্যালিগ্রাফি। আয়াতে আয়াতে সব খিলান যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। মূল কাঠামো মঞ্চের উপর তৈরী। নিচটা ফাঁকা। আবার সিলিঙ অন্তত ৩০/৪০ ফুট উঁচু। হাওয়া যেন খেলে বেড়ায় ইমামবাড়ায়। উপর থেকে দেখা যায় পুকুর। ভীড় এড়াতে নিচে নেমে এলাম ধীরে।

মহররম দিয়েই মূলত ইসলামি বছর শুরু। নানান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় এ মাসের গুরুত্বই অন্যরকম। তারমধ্যে একটি হলো মহররম। মাসের শুরুর প্রথম দশদিন নানান আমলে কাটান মুসলিমরা। দশম দিনই হলো আশুরা। এ দিনই তাজিয়া বের হয়। আবেগঘন শোকে পালন করা হয় ১০ই মহররম। এ উপলক্ষে রোজা রাখেন অনেকে। মাগরেবের আযান পড়বে একটু পরই। অনেকেই ইফতার নিয়ে ভেতরে বসে পড়লো। হোসাইনি দালানের শেষ অংশ হলো এর পুকুর। পুকুরের আশপাশে প্রচুর মানুষ। ফুল, মালা, ককসিট আর বোতলে পুকুরের রূপ পেত্নীর মত হয়ে আছে। অফ সিজনে পুকুর বেশ স্নিগ্ধ রূপে থাকে। একদিকে ইমামবাড়া আর পুকুরের অন্য তিনদিকে তিনটি ঘাট। কেউ কেউ ফুল ভাসাচ্ছে পুকুরে।

মাগরেবের পরপরই লোকজন কমতে শুরু করলো। আকাশে তখনও সন্ধ্যারাতের আলো। ইমামবাড়ার পেছনে গাঢ় নীলচে আকাশ। কাজল কালো জলে আলো ঝলমলে ইমামবাড়ার প্রতিবিম্ব। মন কেমন করা সন্ধ্যায় আমিও রাতের ইমামবাড়ার ছবি তোলার লোভ ছাড়তে পারলাম না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে পুকুরপাড় থেকে ইমামবাড়ার ৫৬, ৬৭, ৭২, ৯০ সালের ছবি দেখেছিলাম। এই সময়ের সাথে মেলাচ্ছিলাম।
পথেঘাটে ব্যস্ততা কমে এসেছিলো। চাঁদের দেখা নেই। হেটে বেরিয়ে এলাম হোসেনি দালান থেকে। রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সে রাত !

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement