১৮ মে, ২০২৪, শনিবার

অলৌকিক এক ঘটনায় মালদ্বীপে প্রচার হয় ইসলাম

Advertisement

মালদ্বীপকে একটি মুসলিম দেশ হিসেবে সবাই চিনলেও এক সময় আজকের মালদ্বীপে কোনো মুসলমান ছিল না। দেশটিতে এখন প্রায় শতভাগ নাগরিক মুসলমান। কীভাবে মালদ্বীপে ইসলাম ছড়াল ? এ নিয়ে আছে এক অলৌকিক কাহিনীর বর্ণনা— যা মালদ্বীপের ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ রয়েছে।

বলা হয়ে থাকে, মালদ্বীপে নেমে ইবনে বতুতা দেখেন সবাই মুসলমান। সেখানে কোনো ইসলাম প্রচারক যাননি। তবে কিভাবে প্রচার হলো ইসলাম? তিনি সেখানকার অধিবাসীদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। দেশটির বাসিন্দারা এক অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা শোনায়।

ঘটনাটি হল— আরবের কোনো এক বাণিজ্য জাহাজ পূর্ব দিকে যাত্রা করে তুমুল সমুদ্র ঝড়ে পড়ে । জাহাজের অভিযাত্রী সকলেই মারা যান। যাত্রী দলের একজন মাত্র লোক কোনোমতে ভেঙে যাওয়া জাহাজের একখণ্ড কাঠকে অবলম্বন করে বেঁচে যান এবং দ্বীপেই আশ্রয় নেন। তিনি ছিলেন এক আরব যুবক ও হাফেজে কুরআন। তার নাম হাফেজ আবুল বারাকাত অথবা কোনো কোনো বর্ণনায় এই আলেমের নাম ইউসুফ বারবারী মাগরীবী বলা হয়েছে।

এই অচেনা অপরিচিত দ্বীপে কোথায় যাবেন তিনি? কে তাঁকে আশ্রয় দেবে? শেষতক এক বৃদ্ধার ঘরে আশ্রয় মিলল আরব যুবকের। সদ্য যুবক ছেলেটির দাঁড়িগোঁফ ওঠেনি তখনো। তিনি জংগলে কাঠ কেটে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। এভাবেই চলছিল তাঁর জীবন। একদিন যুবক বাড়ি ফিরে দেখে তার আশ্রয়দাত্রী বৃদ্ধা কাঁদছেন, পাশে তার তরুণী মেয়েটিও কাঁদছে। যুবকটি বলল আপনারা কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে আপনাদের? বৃদ্ধা বললেন, আজ আমার মেয়ে মারা যাবে। যুবক বলনে, কেন? তিনি মারা যাবেন, কেন? তিনি তো সুস্থ! বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বললেন, ওই যে দেখ। মৃত্যু আমাদের সামনে। যুবক বাড়ির সামনে তাকিয়ে দেখে সেখানে রাজার সৈন্যরা দাঁড়ানো।

যুবক বলল, তারা কি আপনার মেয়েকে হত্যা করবে? বৃদ্ধা বললেন, না। ব্যাপারটি তা নয়। রাজার সৈন্যরা আমার মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। কেননা, আমাদের এই দ্বীপে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে এক সামুদ্রিক বিপদের উদ্ভব হয়। যার থেকে রক্ষা পাবার উপায় হল— আমাদের দ্বীপবাসীদের পক্ষ থেকে একজন তরুণীকে ঔদিন সূর্য ডোবার পর সমুদ্র উপকূলে যে একটি মন্দির আছে, সেখানে রেখে আসতে হয়। পরের দিন সকালে সরকারি লোকজন সমুদ্রের কিনারা থেকে ওই মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করে আনে।

প্রতিবারই লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়— কোন্‌ মেয়েকে পাঠানো হবে। এবার লটারিতে আমার মেয়ের নাম উঠেছে। তাই আজ রাতে তাকে সমুদ্র উপকূলে পাঠাতে হবে। সেখানে তার মৃত্যু অনিবার্য। পরোপকারী এবং কৃতজ্ঞ স্বভাবের যুবক বৃদ্ধার এমন বেদনাবিধূর কথা শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, আজ আপনার মেয়েকে সেখানে পাঠানোর দরকার নেই। আজ রাতে আমি নিজেই সেখানে যাব। দেখি সেখানে কী হয়। প্রয়োজনে আপনার মেয়ের পরিবর্তে আমার জান দিয়ে দেব।

এরপর যুবক বললেন, রাজার সৈন্যরা যাতে চিনতে না পারে, তাই আপনার মেয়ের পোশাক আমাকে পরিয়ে দিন এবং সেভাবেই সাজিয়ে দিন। আমিই আজ তাদের সাথে যাব। উল্লেখ্য যে, দেখতে সুন্দর যুবকের বয়স ছিল কম। সদ্য কৈশোরীত্তীর্ণ। তার দাড়ী গোঁফ কিছুই গজায়নি। কাজেই মেয়ের বেশে তার ধরা পড়ার আশংকা তেমন ছিল না। তবে আশ্রয়দাত্রী বৃদ্ধা যুবকটিকে নির্ঘাত মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু যুবকটি বললেন, তিনি মুসলমান। এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না মুসলমান। আর জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আল্লাহর হুকুম না হলে কেউ কাউকে মারতে পারে না। তা ছাড়া তিনি হাফেজে কুরআন। তাই তাঁর বিশ্বাস আল কুরআনের বরকতে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে রক্ষা করবেন।

শেষ পর্যন্ত উপকারীর উপকারে বদ্ধপরিকর যুবকের অত্যধিক পীড়াপীড়িতে বৃদ্ধা রাজী হলেন। এরপর মেয়ে সেজে রাজার সৈন্যদের সঙ্গে সে চলে গেল। তরুণীরূপী যুবককে সৈকতের ওই মন্দিরে রেখে চলে এল সৈন্যরা। যুবক সেখানে ভাল মতো অজু করে এশার নামাজ আদায় করল। তারপর খোলা তলোয়ার সামনে রেখে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগল এবং একইসঙ্গে আপন মনে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগল।

রাত গভীর হতে লাগল। চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। প্রকৃতি নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল যেন। চরাচরে শুধুমাত্র তিনটি প্রাণ জেগে রইল, যাদের চোখের নিদ্রা বিদুরিত হয়েছে। এক হল আরব যুবক, যাঁর চোখ ছিল সমুদ্রের দিকে আর বুকে ছিল ঈমানের বল। আরেক জন জাগ্রত ছিল, তিনি ছিলেন গরীব সেই বৃদ্ধা। উদার হৃদয় আরব যুবকের চিন্তায় তিনি ছিলেন অস্থির। আর তৃতীয় যে প্রাণটি জেগে রইল সে হচ্ছে সেই তরুণী কন্যা, যে আরবের যুবকের চিন্তায় অনবরত কেঁদেই চলছিল।

হাফেজে কুরআন যুবকটি অন্ধকার রাতের এ নিথর পরিবেশে সমুদ্রের কিনারায় সেই ‘ভয়ংকর মন্দিরে’ বসে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী সুরে কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছিল। এ মুহূর্তে সকল অপশক্তির মোকাবিলায় কুরআনই তার অমোঘ হাতিয়ার। সময় বয়ে চলে। হঠাৎ করে দিগন্ত থেকে বিশাল আকৃতির এক ভয়ংকর দৈত্যের উদয় হল সমুদ্রে। দৈত্যটি ধীরে ধীরে দ্বীপের সৈকতে মন্দিরের অভিমুখে আসতে লাগল। মন্দিরের কাছাকাছি এসে দৈত্যটি থেমে গেল। যুবক কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছিল কুরআন তিলাওয়াতের আবেশে কোনো এক অলৌকিক কারণে দৈত্যটি সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। অবশেষে হার মানল ভয়ংকর দানবটি।

কিছু সময় অবস্থান করে ভয়াবহ দানবটি যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরে গেল। এক-সময় সমুদ্রে মিলিয়ে গেল দৈত্যটি। অপরদিকে, কিছু সময় পর সকাল হল। সরকারি লোকজন যথারীতি মেয়েটির লাশ নেওয়ার জন্যে মন্দিরে এলো। এসে তারা হতভম্ব হয়ে গেল। সেখানে কোনো লাশ নেই কোনো মেয়েও নেই। তার পরিবর্তে এক মুসলিম যুবককে দেখতে পেল সেখানে। সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে এলো রাজার কাছে। যুবক রাজাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। বিস্মিত রাজা তখন বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই মেয়েটিকে ডেকে আনলেন। মেয়েটি ও তার মৃদ্ধা মা রাজার কাছে ঘটনার সত্যায়ন করলেন।

এ ঘটনায় রাজা সীমাহীন প্রভাবিত হলেন। তিনি বললেন, হে যুবক! এত বড় বিপদের সামনে তুমি একাকী দাঁড়ালে কীভাবে? যুবক বলল, আমি একা ছিলাম না আমার সঙ্গে আমার আল্লাহ ছিলেন। আর আমার হাতিয়ার ছিল মহান আল্লাহর পবিত্র কুরআন। রাজা ফের জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ভয় পাওনি কেন? যুবক জবাব দিল, মুসলমান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ। এরপর রাজা বললেন, আগামী বছর এভাবে একা থামাতে পারবে দানবকে? যুবক দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল, আল্লাহর হুকুমে একাই যেতে পারব।

তখন রাজা অতি উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন, যদি তুমি পার, তাহলে আমরা সবাই ইসলামের সততার সামনে মাথা নত করব। রাজার এ কথাকে সবাই সমর্থন করল। এরপর পরবর্তী বছর নির্ধারিত তারিখের ঘটনা সবাই প্রত্যক্ষ করল, অর্থাৎ ওই যুবকের মোকাবিলায় সাগর দানো এবারও ব্যর্থ হয়ে ফিরল। এ ঘটনার পর থেকে সেই মহাবিপদ মালদ্বীপে আর আসেনি। তখন রাজা ও তার দরবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর পুরো রাজ্যের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। প্রথম দিনেই পঁয়ষট্টি হাজার লোক মুসলমান হয়।

জানা গেছে, এটা ১১৪০ সালের ঘটনা। আর ওই রাজার নাম ছিল সনুরাজা। মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার সফরনামায় এই ঘটনার বয়ান আছে। প্রসঙ্গত, ইবনে বতুতা মালদ্বীপে বিয়ে করেছিলেন কয়েকটি। তাঁর সন্তানও জন্ম হয় সেখানে। স্ত্রীদের একজন ছিলেন রাজ পরিবারের। তিনি সেখানে কাজীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ভারতেও তিনি কাজীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে শাসকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারণে মালদ্বীপ ছাড়তে হয় তাঁকে।

সূত্র- ইন্টারনেট, ছবি-কেটিভি প্রতিদিন।

Advertisement

আরও পড়ুন

Advertisementspot_img
Advertisement

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন

Advertisement