প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘একটি দেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলে প্রতিটি সেক্টরে এর প্রভাব পড়বে। তাই একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিকল্পিত জনসংখ্যা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার পূরণের পাশাপাশি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে পরিকল্পিত জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এ উপলক্ষ্যে দেওয়া বাণীতে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা জনসংখ্যাবিষয়ক বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা, পরিকল্পিত পরিবার গঠন, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাভাবিক প্রসবসংক্রান্ত সব সেবা, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা এবং আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতার হার বৃদ্ধিকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দিয়েছি। নিরাপদ মাতৃত্ব, কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য, নারী শিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীরা প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে দম্পতি পরিদর্শনের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে এবং এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ অর্জন করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস অতিমারি মোকাবিলা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এ সময় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। অতিমারির সময় জন্মহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা সীমিত রাখতে হলে এ সময় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহ যাতে সঠিক মাত্রায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’ সুস্থ-সবল জাতি গঠনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুর প্রজনন-বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের সেবা অবকাঠামোগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সহযোগী সংগঠন, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আরও নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
মিনিটে দেশে ৬ শিশু জন্মগ্রহণ করে : বাংলাদেশে ২০২১ সালের প্রথম দিনে জন্ম নিয়েছে ৯ হাজার ২৩৬ শিশু। আর বিশ্বজুড়ে প্রথম দিনে ভূমিষ্ঠ হয়েছে তিন লাখ ৭১ হাজার ৫০৪ শিশু। এই তথ্য দিয়েছে ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেনস ফান্ড (ইউনিসেফ)।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে ১৪ কোটি নবজাতক জন্ম নিতে পারে। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে আট হাজারের বেশি শিশু জন্ম নেয়। সেই হিসাবে পহেলা জানুয়ারি প্রায় এক হাজার শিশু বেশি জন্মগ্রহণ করেছে। গড়ে প্রতি মিনিটি দেশে প্রায় ছয় শিশু জন্মগ্রহণ করে। মহামারির সময় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এর প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকট আরও জটিলতার মুখে পড়বে। পরিবার পরিকল্পনায় এখনই যথাযথ উদ্যোগ গৃহীত না হলে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাধাগ্রস্ত হবে সব উন্নয়ন।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ২০২১ সালের করোনা মহামারি বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা : প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে।’
গত ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত ইউএনএফপিএর ‘আমার শরীর, কিন্তু আমার পছন্দ নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ৫৭টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি নারী যৌন মিলন, জন্মনিয়ন্ত্রণ এমনকি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। এরই ধারাবাহিকতায় কোভিড-১৯ বাস্তবতায় সারা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা, স্বাস্থ্যসেবায় বিঘ্ন, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে এ দেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তাবোধ এবং বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়া ও বাল্যবিয়ের কারণ।
২০২০ সালে অক্টোবরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাসে (মার্চ- জুন ২০২০) সারা দেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, গত জুন মাসে ৪৬২টি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়। এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের আন্তরিক সক্রিয় উদ্যোগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়।
সেভ দ্য চিলড্রেনের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক পাঁচ লাখ মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে। আর বাল্যবিয়ের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় দুই লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারির কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ছয় কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।
মেরিস্টোপস বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ও কমিউনেশন হেড মনজুন নাহার বলেন, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।